জালাল আহমেদ চৌধুরী: যদ্যপি আমাদের গুরু...
‘জালাল ভাই, আজকে সন্ধ্যা সাতটার সময় প্রোগ্রাম। আপনাকে একটু মনে করিয়ে দিলাম…’
‘হ্যাঁ, আমার মনে আছে। চলে আসব সময়মতো…’
ব্যস, আমি চিন্তামুক্ত তখনই। আমি জানতাম তিনি চলে আসবেন ঠিকমতো। ওই যে, সাতটার ঠিক আগেই রিকশা থেকে নামছেন বেগুনীরঙা পাঞ্জাবি পরে। আমি শশব্যস্ত হয়ে কাছে যেতেই সস্নেহে বলে উঠতেন, ‘আরে, আমার জন্য ব্যস্ত হতে হবে না। আমি তো ঘরের লোক।’
আসলেই, প্যাভিলিয়নের ঘরের লোকই হয়ে গিয়েছিলেন একরকম। বাংলাদেশের খেলাধূলা জগতের যে আকাশ, তাতে প্যাভিলিয়ন হয়তো এখনো অনেক দূরের টিমটিম করতে থাকা কোনো তারা। তবে নিজে দেদীপ্যমান নক্ষত্র হয়েও কেন যেন আমাদের প্রতি তার এক ধরনের অপত্য স্নেহ ছিল। প্যাভিলিয়নের পথচলার শুরু থেকেই তাই প্রতিটি অনুষ্ঠানেই তিনি ছিলেন। হোক সেটা দৃক গ্যালারির মিলনায়তন বা প্যাভিলিয়নের ছোট্ট অফিসে বা কলবাগানস্থ এমক্যাফে রেস্টুরেন্টের ঘরোয়া আয়োজন। ফোন করলেই বলতেন, ‘অবশ্যই, আমি থাকব।’ আমরাও নির্ভার হয়ে যেতাম। এভাবেই ‘অতিথির’ তকমাটা নিজেই একরকম সন্তর্পণে সরিয়ে ফেলে হয়েছেন ‘অভিভাবক’। এক বটবৃক্ষের ছায়া আমরা পেয়েছিলাম, যেটা আজ হারিয়ে ফেলেছি চিরদিনের মতো।
অভিভাবক শুধু আমাদেরই ছিলেন না, খেলাধূলা বা ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত আরও অনেকেরই ছিলেন। আর বটবৃক্ষের সঙ্গে ছিলেন পথিকৃৎও। জালাল আহমেদ চৌধুরীর নামটা আমার স্মৃতিতে প্রথম ঘাঁই দিয়ে গেছে সেই নব্বইয়ের দশকেই। তখনও আমার মাত্র হ্যাফপ্যান্ট ছেড়ে ফুলপ্যান্ট পরার বেশিদিন হয়নি, ডুবে থাকতাম দৈনিক পত্রিকার খেলাধূলার পাতায়। তখনই তার লেখনীর সাথে পরিচয়। রোববারের স্টেডিয়ামের জন্য অধীর হয়ে থাকতাম, আর সেখানে তার লেখা থাকত নিয়মিতই। একটা সময় সেই ক্রীড়া বিভাগের সঙ্গেই পাকেচক্রে জড়িয়ে যাওয়ার পর জালাল ভাই দেখা দিলেন রক্তমাংসের মানুষ হয়ে। কাওরানবাজারের অফিসে আসতেন প্রায় নিয়মিতই, গায়ে সেই চিরচেনা পাঞ্জাবি। এরপর প্রথম আলোর এক নৌবিহারে তাঁর সঙ্গে সাহস সঞ্চয় করে কথা হলো। আলাপের বিষয় যখন ক্রিকেট, বয়সের বাধাও কখন ঘুচে গেল টের পেলাম না। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, তিনি সত্যিকারের এক ক্রিকেট-সাধক।
এই সাধনা যে আসলে কতটা, সেই প্রমাণ এরপর পেয়েছি অনেক। নিজের সম্পর্কে বরাবরই নিস্পৃহ ছিলেন। তাকে একসময় চিনেছি ক্রীড়া-লেখক হিসেবে, কিন্তু এর বাইরে তার ক্রিকেটার, সাংবাদিক, কোচসহ প্রতিটি পরিচয়ই আলাদা করে বলার মতো, সেটা নিজ থেকে কোনো দিন টের পেতে দেননি। নিজের ফেসবুকের প্রোফাইল ছবিতে ক্রিকেট খেলার একটা ছবি দিয়ে রেখেছিলেন, সেটাই হয়তো আজন্ম আরাধ্য পরিচয় ছিল। তবে সবকিছুর পর ক্রিকেট-সাধনাই তার কাছে ছিল সবকিছু। ফেসবুকে যুক্ত থাকার জন্য ক্রিকেট নিয়ে তার স্ট্যাটাস সবসময়েই চোখে পড়ত। মাঝে মাঝে মন্তব্যও করতাম। মাঝে মাঝে বাংলাদেশের নাটকীয় কোনো হারে যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শোকের মাতম, জালাল ভাই তার মধ্যে থেকেই খুঁজে নিতেন ক্রিকেটীয় সৌন্দর্য। আবার বিতর্কিত কোনো ঘটনায় যখন কোনো ক্রিকেটারের শাপশাপান্ত চলে ফেসবুকে, জালাল ভাই তখন গ্লাসের পানি অর্ধেকটা ভরাই দেখেছেন, খালি নয়। ক্রিকেট ও ক্রিকেটারের ওপর তার আস্থা ছিল অটল। কখনো হয়তো সেই আস্থায় চির ধরেছে, কিন্তু সেই গভীর বেদনা বুঝতে দেননি কাউকে। ঝিনুকের মতো সয়ে গেছেন নীরবে। এই ক্রিকেটময় ফাঁপা জাতীয়তাবাদের যুগে তার ফেসবুক স্ট্যাটাস মনে করিয়ে দিত ‘সবার ওপরে ক্রিকেটই সত্য।’ ‘ক্রিকেট যে কঠিন, সে কঠিনেরেই ভালোবাসিলাম’- এই ছিল মূলমন্ত্র।
ক্রিকেটের সঙ্গে তার ভেতরে ছিল সত্যিকারের এক সাহিত্য ও শিল্পানুরাগী মন। ছোটবেলায় অনেক নতুন শব্দ তার লেখা পড়েই জেনেছি, আমাদের মতো অনেক হতে যাওয়া ক্রীড়া-লেখকদের তার শব্দচয়ন, লেখার শৈলীতে অনুপ্রাণিত করেছেন, প্রভাবিত করেছেন। পড়াড় তৃষ্ণা ছিল সীমাহীন, বই থেকে শুরু করে খেলা বিষয়ক সবকিছুই পড়তেন খুঁটিয়ে। দেখা হলেই কথা হতো সাম্প্রতিক কী পড়েছেন সেটা নিয়ে। দেখা যেত, শীর্ষস্থানীয় সংবাদমাধ্যম থেকে শুরু করে নতুন ওয়েবপোর্টাল, কারও লেখাই বাদ পড়ছে না। স্বীকার করতে কুন্ঠা নেই, অনেক সময় ফেসবুকে কোনো লেখা শেয়ার দেওয়ার পর তার মন্তব্যের জন্য বসে থাকতাম চাতকের মতো। নিরাশ হতে হতো না বেশির ভাগ সময়েই। ফেসবুকের মন্তব্য ঘরে এমনকি ফোনেও তার উৎসাহটা অন্যরকমের একটা প্রেরণা দিত।
আবার কখনো তাকে দেখেছি কোচের ভূমিকায়। সর্বশেষ যখন কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের কোচ ছিলেন, তখন অনুশীলনে দেখতাম কী একাগ্রতায় সময় দিচ্ছেন শিষ্যদের। অনেকেই হয়তো জানি না, পাতিয়ালা থেকে কোচিংয়ের ওপর ডিগ্রি নিয়ে এসেছিলেন সেই আশির দশকের আগে, যেটা তখন আর কারও ছিল না। মাঝে মাঝে অবাক হয়ে ভাবতাম, ক্রিকেট খেলা ও লেখালেখির মতো এমন ভিন্ন দুইটি ব্যাপার এতটা গভীরভাবে কী করে ধারণ করতেন? একবার প্রশ্নও করেছিলাম, মৃদু হেসে এড়িয়ে গেছেন তা।
জালাল আহমেদ চৌধুরী ছিলেন এমনই। নিজে ছায়া হয়ে আগলে ছিলেন বটবৃক্ষের মতো, কিন্তু বুঝতে দেননি তা। লন্ডনে গিয়ে শার্লক হোমসের বেকার স্ট্রিটে যেমন ফেলুদা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিল, ‘গুরু, তুমি ছিলে বলেই আমি আছি’; আমিও কুন্ঠাহীন চিত্তে বলতে পারি, ‘জালাল ভাই, আপনি ছিলেন বলেই আমি, আমরা আছি।’