মোস্তাফিজ-তেয়াগির শেষের জাদুতে পাঞ্জাবকে হারিয়ে নাটকীয় জয় রাজস্থানের
গ্রুপ পর্ব, দুবাই (টস- পাঞ্জাব/ বোলিং)
রাজস্থান রয়্যালস ১৮৫, ২০ ওভার (জয়সওয়াল ৪৯, লোমর ৪৩, লুইস ৩৬, আরশদিপ ৫/৩২, শামি ৩/২১, হারপ্রিত ১/১৭)
পাঞ্জাব কিংস ১৮৩/৪, ২০ ওভার (আগারওয়াল ৬৭, রাহুল ৪৯, পুরান ৩২, তিয়াগি ২/২৯, তেওয়াতিয়া ১/২৩, সাকারিয়া ১/৩১, মোস্তাফিজ ০/৩০)
রাজস্থান রয়্যালস ২ রানে জয়ী
ইয়াশাসভি জাইসওয়াল-এভিন লুইস ঝড়ের পর মাহিপাল লোমররের ঝড় সামলে দারুণ ডেথ বোলিংয়ে ঘুরে দাঁড়ানো পাঞ্জাব কিংস ১৮৬ রানের লক্ষ্যে ছুটলেও দারুণ ডেথ বোলিংয়ে লাগাম টেনে ধরে শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে ২ রানের জয় পেয়েছে রাজস্থান রয়্যালস। আরশদিপ সিংয়ের ডেথ ওভারে পূর্ণ করা পাঁচ উইকেটে উজ্জীবিত হয়ে মায়াঙ্ক আগারওয়ালের ৬৭ আর রাহুলের ৪৯ রানের পর নিকোলাস পুরান-এইডেন মার্করামের ঝড়ো জুটিতে পাঞ্জাবের জয় মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। ম্যাচের খোলনলচে পাল্টে দিয়ে দৃশ্যপটে তখনই আবির্ভাব হয় মোস্তাফিজ-তিয়াগির। ভাল শুরুর পর মাঝের ওভারে কিছুটা রান গুনলেও মোস্তাফিজুর শেষ ওভারে ম্যাচে ফিরিয়েছিলেন দলকে। উইকেটশূন্য থাকলেও দলকে যেই অসম্ভব জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল মোস্তাফিজের সেই ওভার, সেই সম্ভাবনাকেই বাস্তবে রুপ দিয়ে শেষ ওভারে মাত্র ১ রান গুনে রাজস্থানকে মাত্র ২ রানের অবিশ্বাস্য জয় এনে দিয়েছেন কার্তিক তিয়াগি।
বোলিংয়ে দুর্দান্তভাবে ঘুরে দাঁড়ানো পাঞ্জাবের ১৮৬ রানের জবাবে লক্ষ্যতাড়ার শুরুটা হয় কিছুটা নড়বড়ে। মোস্তাফিজুর রহমানের করা প্রথম ওভার থেকে মাত্র ৪ রান নেওয়ার পর চেতন সাকারিয়ার পরের ওভারেই ফিরে যেতে পারতেন লোকেশ রাহুল। পয়েন্টে থাকা এভিন লুইস তার ক্যাচ নিতে ব্যর্থ হলে সেই যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। সাকারিয়ার করা চতুর্থ ওভার থেকেই অবশ্য নিজেদের সামলে নিয়ে আক্রমণে যায় পাঞ্জাব। জীবন পাওয়া রাহুল দুই ছয় আর এক চারে ঐ ওভারে নেন ১৯ রান। তবে মরিসের করা পরের ওভারেই আরও একবার বেঁচে যান রাহুল, মিড অনে এবার সহজ ক্যাচ ছেড়ে দেন রিয়ান পরাগ। পরের ওভারেই রাহুলকে ফেরাতে পারতেন মোস্তাফিজ। তবে রাহুল এদিন বোধয় ভাগ্যদেবতার কাছে প্রার্থনা করে তবেই মাঠে নেমেছিলেন। মোস্তাফিজের দারুণ স্লোয়ার টেনে মারতে গিয়ে ক্যাচ তুলে দিলেও তা লুফে নিতে পারেননি সাকারিয়া। অন্যান্যগুলোর তুলনায় সেটা অবশ্য অপেক্ষাকৃত কঠিন সুযোগই বলা যায়। পাওয়ারপ্লেতে তাই কোনও উইকেট না হারিয়ে পাঞ্জাব তোলে ৪৯ রান।
তিন তিন বার জীবন পাওয়ায় বিচলিত রাহুল কিছুটা মিইয়ে গেলে আক্রমণের দায়িত্ব বুঝে নেন মায়াঙ্ক আগারওয়াল। তিয়াগির করা অষ্টম ওভারে ৩ চারে তিনি নেন ১৫ রান। গিয়ার পালটে এরপর থেকে চড়াও হন সব বোলারের উপর। মরিসের ওভারে দুই ছয়ে ৩৪ বলে পূর্ণ করেন নিজের ফিফটি। ঐ ওভারে দুই ছয় আর দুই চারে আগারওয়াল-রাহুল তোলেন ২৫ রান। ফিফটির দ্বারপ্রান্তে গিয়ে অবশ্য শেষমেশ থামেন পাঞ্জাব অধিনায়ক। তাকে একবার জীবন দেওয়া সাকারিয়ার গুড লেন্থের বল কাট করতে গিয়ে ব্যাটের কানায় লেগে তিয়াগির সহজ ক্যাচের শিকার হয়ে ৩৩ বলে ৪৯ রান করে ফেরেন রাহুল। তবে এর আগে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহকের তালিকায় শিখর ধাওয়ানের সাথে যৌথভাবে শীর্ষে উঠেছেন ৩৮০ রান নিয়ে। ১২০ রানের ওপেনিং জুটি ভাঙার পরের ওভারেই তেওয়াতিয়ার শিকার হয়ে ফেরেন আরেক ওপেনার আগারওয়াল। কাভারের অপর দিয়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ব্যাটের কানায় বল লেগে আকাশে তুলে দিলে তা সহজেই লুফে নেন লিভিংস্টোন, আগারওয়াল থামেন ৪৩ বলে ৬৭ রানের দারুণ ইনিংসের পর।
দুজন থিতু ব্যাটসম্যান ফেরার পরে যেখানে আরও চেপে বসার কথা সেখানে রাজস্থান অধিনায়ক সাঞ্জু স্যামসন বিস্ময়করভাবে আক্রমণে আনেন পার্ট টাইমার পরাগকে। ফলাফল তাই ছিল অনুমিতই। এবারের আইপিএলে ধুঁকতে থাকা নিকোলাস পুরান দুহাত ভরে সেই সুযোগ লুফে নিয়ে এইডেন মার্করামের সাথে মিলে ঐ ওভারে তোলেন ১৬ রান। পরের দুই ওভারে তিয়াগি আর মরিস কিছুটা সামাল দিলে শেষ চার ওভারে পাঞ্জাবের সমীকরণ হয়ে দাঁড়ায় ৩২ রান। একবার যখন আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছেন তখন তো আর ছেড়ে দেবার পাত্র নন পুরান। মোস্তাফিজের করা ১৭তম ওভারে চার ছয়ে তোলেন ১৪ রান, গড়েন এই মৌসুমে নিজের সর্বোচ্চ স্কোর। পরের ওভারে মরিসকে বিশাল এক ছয়ে স্বাগত জানান মার্করাম। মাত্র ২৮ বলেই ৫০ রান পূর্ণ করে এই জুটি।
জয় যখন মনে হচ্ছিল অবধারিত তখনই মঞ্চে আগমন মোস্তাফিজের। এর আগের ওভারটা কিছুটা খরুচে হলেও দারুণ বোলিংয়ে পুশিয়ে দেন সেটা। শেষ দুই ওভারে যখন প্রয়োজন মাত্র ৮ রান তখন ১৯তম ওভারে তিনি দেন মাত্র ৪ রান। ক্ষীণ সম্ভাবনার সেই যে জন্ম দিলেন সেটাকেই কী দারুণভাবেই না বাস্তবে রুপদান করলেন তিয়াগি! শেষ ওভারে পুরান তার বলে বিচক্ষণ শট খেলতে গিয়ে উলটো উইকেটের পিছনে ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ৩২ রানে। পরের তিন বলই ব্লকহোলে রাখেন তিয়াগি, ব্যাটসম্যানদের হাত খোলার জন্য কোনও জায়গাই দেননি। ফলাফল শেষ তিন বলে শূন্য রান, সাথে দীপক হুডার উইকেট। অসম্ভবকে সম্ভব করে তিয়াগি নায়ক বনে যান, দলকে এনে দেন ২ রানের অবিশ্বাস্য জয়!
টসে হেরে ব্যাটিংয়ে নামা রাজস্থানের শুরুটা হয় দারুণ। তরুণ ইয়াশাসভি জাইসওয়ালকে সঙ্গী করে ঝড় তোলেন এভিন লুইস। আরেক তরুণ পেসার ইশান পোরেলের করা ৫ম ওভারে তো ৪ চারে নিয়ে বসেন ১৭ রান। পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে আরশদিপ সিং আক্রমণে এলে থেমে যায় লুইস ঝড়। ফুল লেংথে স্লোয়ার দিলে সেটা ব্যাটে বলে করতে না পেরে আকাশে ভাসিয়ে দেন লুইস। আগারওয়ালের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে ২১ বলে ৩৬ রানের ইনিংস খেলে নিজের ভুমিকাটা অবশ্য ঠিকঠাক পালন করেই ফেরেন। পাওয়ারপ্লেতে ঐ এক উইকেট হারিয়েই রাজস্থান তোলে ৫৭ রান।
লুইস ফেরার পরে এতক্ষণ উইকেট আগলে রাখার ভুমিকায় থাকা জাইসওয়াল নেন আক্রমণকারীর ভূমিকা। তার মাঝেি পোরেলের বলে উইকেটের পিছনেকাচ দিয়ে ফিরে যান অধিনায়ক সাঞ্জু স্যামসন। তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে নিজের মত খেলে যান জাইসওয়াল। আইপিএলে এবার প্রথম খেলতে নামা লিয়াম লিভিংস্টোন তাকে যোগ্য সঙ্গ দেন। আরশদিপ পুনরায় আক্রমণে এলে তাকে বিশাল ছয়ে স্বাগত জানান লিভিংস্টোন। তবে শেষ হাসি হাসেন আরশদিপই। ঐ ওভারের পঞ্চম বলেই আরশদিপকে আবারও মাঠছাড়া করতে গেলে ফ্যাবিয়ান অ্যালেনের দুর্দান্ত ক্যাচের শিকার হয়ে ১৭ বলে ২৫ রান করেই থামতে হয় তাকে। উইকেটে নবাগত মাহিপাল লোমরর থিতু হতে কয়েক বল সময় নেন। আইপিএলে এবারই প্রথম নামা ইংলিশ লেগ স্পিনার আদিল রশিদের ওভারে টানা দুই ছয় মেরেই এরপর আভাস দেন কন ভুমিকায় নেমেছেন তিনি। অপর প্রান্তে থাকা জাইসওয়াল ফিফটির দ্বারপ্রান্তে এসে কিছুটা ছন্দ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তারই খেসারত দেন তিনি হারপ্রিত ব্রারের নিরীহ একটা বল লেগে ঠেলতে গিয়ে তার কাছেই ফিরতি ক্যাচ দিয়ে, থামেন ৩৬ বলে ৪৯ করে। জাইসওয়ালের বিদায়ের পরেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করেন লোমরর। দীপক হুডার করা পরের ওভারে দুই ছয় দুই চারে নেন চব্বিশ। এই মৌসুমের দ্রুততম ফিফটি মনে হচ্ছিল সময়ের বিষয়।
এরপরের ওভার থেকে অবশ্য পাঞ্জাব যে আদর্শ ডেথ বোলিংয়ের নিদর্শন স্থাপন করতে চলেছে সেটা বোধয় ঘুনাক্ষরেও টের পাননি রাজস্থানের শিবিরের কেউই। ১৬ ওভার শেষে যেই দল ছয় উইকেট হাতে নিয়ে ১৬৪ রান তুলে ফেলেছিল তাদের জন্য ২০০ ছোঁয়া তো সময়েরই ব্যাপার। সেখানেই বাধ সাধেন শামি-আরশদিপ বোলিং জুটি। ১৭তম ওভারে মাত্র ৪ রান দিয়ে শামি ফেরান রিয়ান পরাগকে। ১৮তম ওভারে আক্রমণে এসেই লোমররের স্টাম্প নিশানা করে দুল বল দেন আরশদিপ। আবারও মাঠছাড়া করতে গেলে সংযোগ ঠিকঠাক না হওয়ায় লং অনে মার্করামের সহজ ক্যাচের শিকার হয়ে তিনি থামেন ১৭ বলে ৪৩ করে। ঐ ওভারে মাত্র ৭ রান দেন আরশদিপ। পরের ওভারে শামি আরও এক ধাপ ওপরে গিয়ে মাত্র ৩ রান দিয়ে ফেরান রাহুল তেওয়াতিয়া আর ক্রিস মরিসকে। তুলির শেষ আঁচড়টা শেষ ওভারে এসে দেন আরশদিপই। ৭ রান দিয়ে শেষ দুই বলে তিনি ফেরান চেতন সাকারিয়া ও কার্তিক তিয়াগিকে। ৩৩ রান গুনে ৫ উইকেটও পূর্ণ করেন তিনি, যা পাঞ্জাবের বিপক্ষে আইপিএল ইতিহাসের দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগার। শেষ ৪ ওভারে মাত্র ২১ রান তুলতেই ৬ উইকেট হারিয়ে রাজস্থান গিয়ে থামে ১৮৫ রানে, যা আইপিএলে প্রথমে ব্যাট করে সব উইকেট হারানো দলীয় সংগ্রহের মধ্যে সর্বোচ্চ।