• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    সোলশারের দুঃসময়: নেপথ্য কারণ, টালমাটাল ড্রেসিংরুম ও সামনে কী হবে?

    সোলশারের দুঃসময়: নেপথ্য কারণ, টালমাটাল ড্রেসিংরুম ও সামনে কী হবে?    

    ম্যাচের বয়স তখন ৫১ মিনিট। ক্যামেরা ওল্ড ট্রাফোর্ডের স্ট্যান্ডে খুঁজে নিল সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বস স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনকে। চেহারায় রাগ, ক্ষোভ আর অসহায়ত্বের ছাপ, হতাশায় তাকিয়ে আছেন মাঠের দিকে। এরপরই ক্যামেরা কাট করে খুঁজে নিল আরেক কিংবদন্তিকে, অল রেডদের ‘গ্রেট’ স্যার কেনি ডালগ্লিশ। হাসছেন প্রাণ খুলে, সে হাসির মধ্যে তৃপ্তি, প্রাণোচ্ছ্বলতা। স্টেডিয়ামের স্কোরবোর্ড বলছে, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ০- ৫ লিভারপুল।

    নিচে ডাগআউটের বাইরে দাঁড়িয়ে ওলে গানার সোলশার, একবার হাত ভাঁজ করে তো আরেকবার পকেটে ঢুকিয়ে। কপালের ভাঁজ আর মুখে হতাশার ছাপ বলে যাচ্ছে- বিদায়বেলা টের পেতে শুরু করেছেন সোলশার।

     

    সোলশারের বিদায়- সময়ের অপেক্ষা মাত্র?

     

    ওলে গানার সোলশার ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব বুঝে পেয়েছিলেন অন্তর্বতীকালীন সময়ের জন্য, জোসে মরিনিয়োকে মৌসুমের মাঝে বরখাস্ত করার পর। ২০১৮-১৯ ডিসেম্বরে দায়িত্ব নিয়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে মৌসুম শেষে নিয়ে গিয়েছিলেন টেবিলের ষষ্ঠ স্থানে। স্থায়ী ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ পাবার পর উন্নতির গ্রাফ আরো ভালো, ২০১৯-২০ মৌসুমে রেড ডেভিলরা পায় টেবিলের তৃতীয় স্থান। সবশেষ মৌসুমে রানার আপ হয়ে মৌসুম শেষ করেছিল সোলশারের শিষ্যরা। বোঝাই যাচ্ছে, সোলশারের অধীনে ঠিক পথেই আছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড।

    কিন্তু খালি চোখে লিগ টেবিলে অবস্থান, কিংবা কয়েকটা ম্যাচের ফলাফল আর ম্যাচে পিছিয়ে থেকেও ফিরে আসার গল্প থেকে টের পাওয়া যাচ্ছে না- কতটা সংকটময় পরিস্থিতি পার করছে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড। লিভারপুলের কাছে ৫ গোল খেয়ে অসহায় আত্মসমর্পণ, লিগ কাপে ওয়েস্ট হামের কাছে হেরে বাদ পড়া, মাঝমাঠে লেজেগোবড়ে পরিস্থতি, ডাগআউটে অস্থিরতা- সবদিক থেকেই চাপের মধ্যে আছেন নরওয়েইজিয়ান কোচ এবং একসময় ম্যান ইউনাইটেডের ‘সুপারসাব’ সোলশার। বায়ার্নের বিপক্ষে তাঁর চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ মুহূর্তের গোল থেকে ট্রফি জেতার আনন্দ এখন স্বর্ণালী অতীত। বরং, ম্যান ইউনাইটেড সমর্থকরা তাঁকে বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যর্থতার বোঝাটাই চাপিয়ে দিতে চাইবেন। 

    সবচেয়ে বড় সংকট- সোলশারের ট্যাকটিকাল সীমাবদ্ধতা, এবং একই সঙ্গে ড্রেসিং রুম সামলাতে হিমশিম খাওয়া। যে মাঝমাঠ নিয়ে এত এত সমালোচনার তীর, এই মাঝমাঠ ‘ধাঁধাঁ’র সমাধান সোলশারের এখনো অজানা। যে সিস্টেমে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলে আসছে, ‘লো ব্লক’ কিংবা কাউন্টার প্রেসিংয়ে খেলা দলের সঙ্গে সেটা কাজে লাগলেও বড় দলগুলো, কিংবা প্রিমিয়ার লিগের ‘বিগ সিক্স’- এর সঙ্গে এই সিস্টেম পুরোপুরি ব্যর্থ। লিভারপুলের কাছে ওল্ড ট্রাফোর্ডে ৫ গোল হজম করাটা তারই বড় প্রমাণ। আর সাম্প্রতিক ফর্ম অন্তত এমন ইঙ্গিতই দিচ্ছে, বোধহয় শেষের কাছাকাছি এসে পৌঁছেছেন সোলশার।

     

    সাম্প্রতিক ফর্ম- ফলাফল কী বলছে?

     

    ম্যাচশেষে জয়-পরাজয়টা অবশ্যই মুখ্য, তবে তা থেকে একটি ক্লাবের সার্বিক পরিস্থিতি বুঝে পরিসমাপ্তি টানাটা মোটেও যৌক্তিক নয়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাম্প্রতিক ম্যাচগুলোর ফলাফল বিবেচনা করলেই সেটা টের পাওয়া যায়।

    এই লিভারপুল ম্যাচের ঠিক আগেই ওল্ড ট্রাফোর্ডে চ্যাম্পিয়নস লিগের ম্যাচে প্রথমার্ধে ২ গোলে পিছিয়ে থেকেও আটালান্টাকে তারা হারিয়েছিল ৩-২ গোলে। আর এর আগের ফিক্সচারে ভিয়ারিয়ালকে ২-১ গোলে হারিয়ে মিটিয়েছিল তাদের কাছে ইউরোপা লিগ ফাইনালে হারার যন্ত্রণা। 

    কিন্তু সব ম্যাচে তো ‘মিরাকল’ সম্ভব নয়, আর মাঠের খেলার ছন্দ ঠিক না হলে এমন কিছু আশা করাটাও বাস্তব কিছু নয়। আটালান্টা ম্যাচেই প্রথমার্ধে যে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড খেলেছে, সে অর্ধে ডিফেন্স এবং মিডফিল্ডে ছিল না কোন ছন্দ। ফ্রেড-ম্যাকটমিনে বল পেয়েছেন ভুল জায়গায়, আর সেটা সামনে ডিস্ট্রিবিউট করার ক্ষেত্রেও তারা ছিলেন দুর্বল। দুই রাইট উইংব্যাক মেইলে এবং জাপাকস্তার কাছে বারবার পরাস্ত হয়েছেন ইউনাইটেডের দুই ফুল ব্যাক। ৩০ মিনিটের মধ্যেই ২ গোল খেয়ে বসাটা তাই অবাক করা কিছু ছিলনা। সে ম্যাচের মিরাকল হয়তো পুনরাবৃত্তির আশা করেছিলেন রমরমা রবিবারে ওল্ড Tর্ডে আসা প্রতিটি সমর্থক, কিন্তু ম্যাচের শুরু থেকেই সোলশারের দল ছিল ক্লপের লিভারপুলের কাছে ‘ট্যাকটিকালি আউটপ্লেড’। ম্যাচের ৫০ মিনিটে ৫ গোল দিয়ে দেওয়ার পর লিভারপুল বাকি ৪০ মিনিট কোন গোল দেওয়ারই চেষ্টা করেনি, ম্যান ইউনাইটেডও পারেনি কোন গোল বের করে আনতে।

    কিংবা লেস্টারের মাঠে ৪-২ গোলে হেরে আসাটাও ছিল তাদের দলের জন্য ভীতিকর। শেষ ১৫ মিনিটে ৩ গোল হজম করে ম্যাচ হেরে বসাটা ইঙ্গিত দিচ্ছিল দলে অসঙ্গতির পরিস্থিতির প্রকটতা। 

    প্রিমিয়ার লিগ, লিগ কাপ, ইউয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মিলে সবশেষ ৯ ম্যাচে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড জিতেছে মাত্র ৩ ম্যাচ। এই ৯ ম্যাচ মিলে তারা গোল হজম করেছে ১৮টি, যার মধ্যে ১১টিই সবশেষ তিন ম্যাচ মিলে। আর গোল দিয়েছে মাত্র ১০টি। এর মাঝে লিগ কাপ থেকে ওয়েস্ট হামের কাছে বাদ পড়ে গেছে তারা। প্রিমিয়ার লিগে ৯ ম্যাচের ৪টিতে জিতে তারা আছে নবম স্থানে ১৪ পয়েন্ট নিয়ে, লিগের শীর্ষে থাকা চেলসির চেয়ে ৮ পয়েন্ট পিছিয়ে। 

    রোনালদো ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে ফেরার পর যে উৎসবময় আবহ, সেটাও বোধহয় ফিকে হতে শুরু করেছে অনেক আগে থেকেই। চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ দুই ম্যাচে গোল পেয়েছেন, পর্তুগালের হয়েও গোল পেয়েছেন- প্রিমিয়ার লিগে সিআরসেভেন নিষ্প্রভ, সবশেষ গোল পেয়েছিলেন ওয়েস্ট হামের বিপক্ষে সেপ্টেম্বরে ১৯ তারিখে। 

     

    ড্রেসিংরুম ও ক্লাব পরিস্থিতি   

    ওলে গানার সোলশার তার স্কোয়াডের কাছে যথেষ্ট সম্মানিত, বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই তাকে পছন্দ করেন। কিন্তু সেই দলেও এমন অনেকেই আছেন যারা সোলশারের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। ড্রেসিংরুম ভর্তি সুপারস্টার সামলাতে যে তিনি হিমশিম খাচ্ছেন, তার স্কোয়াড সিলেকশন দেখলে সেটা আঁচ করা যায়। যেখানে তাঁর ফরোয়ার্ড লাইন ডিফেন্সিভ প্রেসিংয়ে ততটা কার্যকরি নয়, তারপরও তিনি তাঁর গৎবাঁধা ট্যাকটিক থেকে সরতে পারছেন না। ব্যাকওয়ার্ড প্রেসিংয়ে পারদর্শী কাভানিকে দিতে পারছেন না শুরুর একাদশে জায়গা। ডর্টমুন্ড থেকে বিগ মানি সাইনিং সাঞ্চো এখনোও প্রিমিয়ার লিগে নিষ্প্রভ। ইনজুরিতে মাঠের বাইরে ভারানে, ডাবল পিভট ফ্রেড-ম্যাকটমিনে জুটির সমস্যার মিলছে না সমাধান। 

    এদিকে ক্লাব কর্তৃপক্ষ এখনো নিশ্চিত নয় সোলশারকে নিয়ে তারা কি করতে চান। গত গ্রীষ্মেই ক্লাব তাঁর সঙ্গে তিন বছরের নতুন চুক্তি করেছে। এমনকি ক্লাব থেকে এটাও বলা হয়েছে, ক্লাবকে সঠিক দিকেই এগিয়ে নিচ্ছেন এই নরওয়েইজিয়ান। কিন্তু সাম্প্রতিক ফর্ম-পারফরম্যান্স পালটে দিয়েছে সব সমীকরণ। বোর্ড থেকে জরুরি সভায় বসার কথা এই সপ্তাহে বলে জানিয়েছে বিভিন্ন ব্রিটিশ মিডিয়া। এদিকে ক্লাবের সাবেক খেলোয়াড় গ্যারি নেভিল অবশ্য বলছেন, সোলশারকে এখন বরখাস্ত করাটা হবে ‘ভুল’ সিদ্ধান্ত। মৌসুমের মাঝে কোচ বদলানোর রীতিতে ভরসা রাখতে পারছেন না তিনি, মৌসুমের শেষ পর্যন্ত এই অস্থির ‘হুইল’-এ সোলশারকেই চান আপাতত। সিদ্ধান্ত এখন পুরোপুরি বোর্ড কত দ্রুত এ বিষয়ে সমাধানে পৌঁছাতে পারে।

     

    সোলশারের পর তবে কে?  

    অনেক জোরেশোরেই শোনা যাচ্ছে, সোলশার চলে যাবার পর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড সামলানোর গুরুদায়িত্ব এসে পড়বে সাবেক ইন্টার মিলান ম্যানেজার আন্তোনিও কন্তের উপর। স্কাই স্পোর্টস ইতালির সাংবাদিক এবং ট্রান্সফার মার্কেট বিশেষজ্ঞ ফাব্রিজিও রোমানো অন্তত এরকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন, রেড ডেভিলদের ম্যানেজারের দায়িত্ব নিতে আগ্রহ আছে কন্তের। তাঁর ক্যারিয়ার ট্র্যাক রেকর্ড নিয়ে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বও নেই ক্লাব কর্তৃপক্ষের। যেখানেই গিয়েছেন, ক্লাবকে এনে দিয়েছেন ট্রফি। আর এই ট্রফির জন্যই তো ক্লাবে এখন হাহাকার। তবে সরাসরি কোন প্রস্তাব কিংবা অফিশিয়াল কোন কিছু এখনো কন্তের কাছে আসেনি, তাই কন্তের আসা-না আসাটা এখন শুধুই সম্ভাব্য পরিস্থিতি।

    তবে কন্তেকে নিয়ে আসার ব্যাপারে বোর্ডের কিছু ইতস্ততাবোধও কাজ করবে। কন্তে যে সিস্টেমে দলকে খেলান, তার জন্য পরিবর্তন আনতে হবে পুরো স্কোয়াডে। খেলোয়াড়ও কিনতে হবে কন্তের সিস্টেমের সঙ্গে মানানসই, যার ফলে ব্রাত্য হয়ে পড়বেন বর্তমান স্কোয়াডের অনেক খেলোয়াড়ই। আর কন্তের সঙ্গে বোর্ডের উপরের কর্তাদের ‘দ্বন্দ্ব’ নতুন কিছু নয়, ইন্টারের মালিকদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ছেড়ে দিয়েছিলেন স্কুদেত্তো জেতার পরও। চেলসিও ছেড়েছিলেন একই কারণে। কন্তেকে নিয়ে আসার আগে এসব সমীকরণ নিয়ে ভাবতে চাইবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কর্তৃপক্ষ।

    শোনা যাচ্ছে জিনেদিন জিদানের নামও। রিয়াল মাদ্রিদ কোচিং ছাড়ার পর তিনিও আছেন ছুটিতে। রোনালদো আছেন ক্লাবে, ম্যানেজার হিসেবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে দেখাটা অবাক করার মত কিছু হবে না। জিদানের জন্য একটাই ছোট বাধা- ইংলিশ সিস্টেমের সঙ্গে পরিচিত নন তিনি। ইংলিশ কোন ক্লাবে খেলা বা কোচিং অভিজ্ঞতা না থাকাটা কিছুটা তাঁর বিপক্ষে কথা বলবে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মত ক্লাবের দায়িত্ব নেওয়ার ব্যাপারে।

     

    নতুন ‘মিরাকল’-এর জন্য প্রার্থনা?  

     

    লিভারপুলের সঙ্গে ম্যাচ হারার পর প্রেস কনফারেন্সে ওলে গানার সোলশার বলেছিলেন, নিজের প্রতি এখনো বিশ্বাস আছে তাঁর। ক্লাবকে তিনি ঠিক লক্ষ্যেই নিয়ে যাচ্ছেন। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড এখন ঠিক কোন পথে হাঁটছে সে নিয়ে একপাক্ষিক বিতর্ক চললেও তাঁর আত্মবিশ্বাস ধরে রাখাটা যে বড়ই জরুরি- যদি চাকরিটা এ দফায় বেঁচে যায়, তাহলে পরের সপ্তাহে মাঠে নামতে হবে টটেনহাম হটস্পার্সের বিপক্ষে, যারা গত মৌসুমেই দিয়ে গিয়েছিল ৬-১ গোলে হারের ক্ষত। আর তারপরই আবার আটালান্টা চ্যালেঞ্জ চ্যাম্পিয়নস লিগে, আর তারপর অপেক্ষা করছে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী ম্যানচেস্টার সিটি। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে নিজের উপর বিশ্বাস রাখা ছাড়া আর বেশি কিইবা করতে পারেন সোলশার। আর যদি এই চাপ থেকে তাঁকে ‘মুক্তি’ দেওয়া হয়, নতুন ম্যানেজারকে নিতে হবে অস্থির এই সময় সামলানোর ভার।