কিক অফের আগে: সোলশারের বিপদ সংকেত; গার্দিওলার মাথায় এবার কোন ট্যাকটিকস?
ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড-ম্যানচেস্টার সিটি
ওল্ড ট্র্যাফোর্ড, ম্যানচেস্টার, সন্ধ্যা ৬:৩০ মিনিট
ডাগআউটে হাত দুটো ভাঁজ করে পিচের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবেন সোলশার; তাঁর কাঁধে যে পাহাড়সম প্রত্যাশার চাপ, একটু এদিক-ওদিক হলেই আবারো সবকিছু ভেঙ্গে পড়তে পারে তাসের ঘরের মত। লিভারপুলের কাছে ৫ গোল হজম করেও সর্বনাশ হতে গিয়েও হয়নি; বোর্ডের সদস্য, এমনকি স্যার অ্যালেক্স ফারগুসন পর্যন্ত স্বীকৃতি দিয়েছেন- সোলশারেই তাঁদের ভরসা। সে ভরসার প্রতিদান দিয়েছেন টটেনহামের বিপক্ষে ৩ গোলের জয় এনে দিয়ে। উলটো চাকরি চলে গেছে স্পার্স বস নুনো এসপিরিতো সান্তো’র। তবে প্রিমিয়ার লিগের দৃশ্যপট যে ক্ষণে ক্ষণে বদলায়, আর তাই এক সপ্তাহ আগের সমাদর আর প্রশংসা বাণী দুয়োতে পরিণত হতে সময় লাগবে না এক মুহূর্তও, যদি এবার সোলশার হেরে বসেন ম্যানচেস্টার ডার্বিতে; নগরের অন্য প্রান্তের ‘সর্দার’ পেপ গার্দিওলা যে তাঁর সামনে নিয়ে আসছেন মৌসুমের আরো এক বড় চ্যালেঞ্জ!
ডার্বিটা যখন ডাগআউটেও!
ম্যানচেস্টার ডার্বি মানেই শহরে উত্তেজনা, বিশেষ করে গত দশ বছরে সে উত্তেজনার পারদ ছুঁয়েছে অন্য মাত্রায়। ২০১৯ থেকেই এই ডার্বির পোস্টারে সোলশার এবং গার্দিওলা। পরিসংখ্যানের ডার্বিতে অবশ্য গার্দিওলাকে আউটক্লাস করেছেন ওলে গানার সোলশার, অন্তত প্রিমিয়ার লিগের মঞ্চে তো বটেই। পেপ গার্দিওলা সোলশারকে হারিয়ে হেসেছেন একবারই, সেটাও তাঁদের প্রথম দেখা ২০১৯ এর এপ্রিলে। এরপর এখন পর্যন্ত সোলশারকে প্রিমিয়ার লিগে ধরাশায়ী করতে পারেননি ম্যানচেস্টার ডার্বিতে। নগর দ্বৈরথে বিজয়ীর আসনে বসতে তাঁর যে তৃষ্ণা, সে তৃষ্ণার ঝাঁঝটা টের পাওয়া গেছে পেপের সবশেষ প্রেস কনফারেন্সে। চ্যাম্পিয়নস লিগে ক্লাব ব্রুশজকে হারিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁর মাথায় এখন শুধুই ম্যানচেস্টার ডার্বি- সিজনে তাঁর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচ।
অন্যদিকে পরিসংখ্যানের জয়ের মুকুট মাথায় দিলেও ডাগআউটের মুকুট যে যেকোন সময়ই হারানোর শংকায় ভুগছেন ওলে গানার সোলশার। ম্যাচে ফলাফল একদিন নিজেদের হয়ে কথা বলছে তো অন্যদিন ডুবছেন পরাজয়ের ক্লান্তিতে। এমন নয় যে ম্যাচে অনেক কিছু চেষ্টা করেও হেরে বসেছেন, অন্তত লিভারপুল কিংবা লেস্টারের সঙ্গে ম্যাচ সে সাক্ষীই দিয়ে যায়। ৫-০ গোলে হার বা ২ গোলে এগিয়ে থেকে ৪-২ গোলে হার- এসব এখনোও তাঁর জন্য অশনী সংকেত। পেপ গার্দিওলার বিপক্ষে তাঁর জয়ের ট্যালি তিন থেকে চারে নেওয়া ছাড়া আর কোন পথ খোলা নেই সোলশারের, এর উলটোটা হলে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডের তাঁর পথের শেষ হয়ে যেতে পারে শনিবার সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই।
সাম্প্রতিক ফর্ম ও দুই ম্যানেজারের মাথাব্যথা
যেমনটা আগেই বলা হচ্ছিল, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ দুটোই দেখতে হচ্ছে সোলশারকে। যদিও শেষ সপ্তাহে এপিঠটাই দেখেছেন একটু বেশি। মাঠে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ফরমেশনে দলকে নামিয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন টটেনহামের বিপক্ষে। ৩-৪-১-২ ফরমেশনে নুনোর স্পার্স খাবি খেয়েছিল পুরো ম্যাচ জুড়ে। সোলশারও তাই পেয়েছিলেন প্রত্যাশিত তিন পয়েন্ট। আটালান্টার বিপক্ষে একই ট্যাকটিকসের পাঠ অবশ্য অত কাজে দেয়নি। অসম্ভব এক ‘মিরাকল’ এর জন্যই অবশ্য বারগামো থেকে ২-২ গোলের ড্র নিয়ে ফিরতে পেরেছিল তাঁর দল। সে মিরাকলের প্রসঙ্গ একটু পরে।
সোলশার যদি শুধু মুদ্রার এপিঠটাই দেখে থাকেন এই সপ্তাহে, পেপের ক্ষেত্রে হয়েছে এপিঠ-ওপিঠ দুটোই! এতিহাদে নিজেদের মাঠে তিন পয়েন্ট খুঁইয়েছেন ক্রিস্টাল প্যালেসের সঙ্গে ২ গোলে হেরে বসে। গার্দিওলার জন্য আরো মাথাব্যথার বিষয়- সেদিন তাঁর দল ফাইনাল থার্ডে কোন গোলমুখী চান্সই তৈরি করতে পারেনি। অবশ্য সে হারের ক্ষত কিছুটা কমেছে চ্যাম্পিয়নস লিগে এসে। বেলজিয়ান ক্লাব ব্রুশজকে ৪-১ গোলে হারিয়ে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে ম্যানচেস্টারের নীল শিবিরে। রেড ডেভিলদের ঘায়েল করা ছাড়া আর কোন চিন্তা পেপ গার্দিওলার মাথায় নেই।
ইনজুরি, প্লেয়ার ফর্ম ও সাসপেনশন
ইনজুরি সমস্যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি চিন্তিত সোলশার। টটেনহামের বিপক্ষে চোট কাটিয়ে রাফায়েল ভারানে ফিরে আসলেও আটালান্টার সঙ্গেই হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে তাকে। সোলশার জানিয়েছেন, আরো একমাসের জন্য ছিটকে গেছেন তিনি। ভারানেকে ছাড়া ব্যাকলাইন সাজাতে বেশ বেগ পেতে হবে সোলশারকে। দলের ক্যাপ্টেন হ্যারি ম্যাগুয়ার এবং লেফট ব্যাক লুক শ’ অফ ফর্মে ভুগছেন দীর্ঘ সময় ধরে। আর মিডফিল্ডে অসংলগ্নতা তো এই মৌসুমে সোলশারের জন্য চিরাচরিত এক সমস্যার নাম। ফরোয়ার্ডদের থেকে গোল পেয়েছেন সবশেষ পাঁচ ম্যাচে (লিভারপুল বাদে), সেটা তাঁর একমাত্র ভরসার জায়গা। পল পগবা আছেন লাল কার্ডের সাসপেনশনে।
ম্যানসিটি ব্যাকলাইনে এই মৌসুমে নিয়মিত আয়মরিক লাপোর্তেও কাটা পড়েছেন লাল কার্ডে গত ম্যাচে। তাই ডার্বিতে তাকে পাচ্ছেন না গার্দিওলা। তাঁর জন্য সুসংবাদ, চোট সেরে এখন ফিট জিনচেংকো এবং গুন্দোয়ান। তবে দলের অন্যান্য খেলোয়াড়রাও যে ভালো ছন্দেই খেলছেন, সেক্ষেত্রে এই দুইজনকে দলে জায়গা দেওয়াটা গার্দিওলার জন্য একটু মুশকিলই বলা চলে। কাইল ওয়াকার হালকা চোট পেয়ে অবশ্য মাঠ ছেড়েছিলেন চ্যাম্পিয়নস লিগে, তবে সেটা বড় কোন সংকট তৈরি করার মত গুরুতর কিছু নয়।
সম্ভাব্য একাদশ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড: ৪-২-৩-১
ডি গেয়া; ম্যাগুয়ার, এরিক বায়ি, লুক শ, অ্যারন ওয়্যান বিসাখা; ফ্রেড, ম্যাকটমিনে; র্যাশফোর্ড, ফারনান্দেজ, গ্রিনউড; রোনালদো
সম্ভাব্য একাদশ, ম্যানচেস্টার সিটি: ৪-৩-৩
এদেরসন; দিয়াস, স্টোনস, ওয়াকার, কানসেলো; রদ্রি, বেরনাদো সিলভা, ডি ব্রুইনা; গ্রিলিশ, জেসুস, ফোডেন
এক্স ফ্যাক্টর: ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মিরাকল, সোলশারের জন্য মিরাকল- সিআরসেভেন। ডুবতে বসা রেড ডেভিলদের জাহাজ যিনি বাঁচিয়ে এসছেন পুরো মৌসুম জুড়ে। যে মিরাকলে ভর করে একে একে ভিয়ারিয়াল, আটালান্টা, টটেনহামকে জয় করা গেছে- সেই মিরাকলের জন্য আবারো প্রার্থনায় থাকবেন ওলে গানার সোলশার। মৌসুমে ১১ ম্যাচে ৯ গোল; চ্যাম্পিয়নস লিগে ৪ ম্যাচে ৫ গোল, সবশেষ প্রিমিয়ার লিগ ম্যাচে একটি করে গোল-অ্যাসিস্ট-- সব পরিসংখ্যান বাদ দিলেও মাঠে রোনালদোর উপস্থিতি যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা রেড ডেভিল দল, ম্যানেজমেন্ট-সমর্থক সবাই টের পাচ্ছেন। রোনালদো ডিফেন্সিভ ওয়ার্ক রেট নিয়ে অবশ্য কথা থেকে যাচ্ছে, তবে আটালান্টা ম্যাচে দেখিয়েছেন- দলের প্রয়োজনে সবচেয়ে নিচে নেমেও লড়াই করতে পারেন তিনি।
এক্স ফ্যাক্টর: ফিল ফোডেন
ইনজুরি সেরে দলে ফিরেছেন বেশিদিন হয়নি, ফিরে এসেই জানান দিয়েছেন তিনি কতটা জরুরি পেপ গার্দিওলার দলের জন্য। প্রিমিয়ার লিগে সিটির জন্য সবচেয়ে বেশি তিনটি গোল করেছেন তিনিই, শেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ ম্যাচে গোল করেছেন, করিয়েছেনও। এবারে সিটির ফরমেশনে তিনি খেলছেন ফলস নাইনে। কখনো কখনো জেসুসের সঙ্গে জায়গা রোটেট করে সেন্টার থেকে ওয়াইডে গিয়ে বল নিয়ে বক্সে ঢুকছেন, কিংবা পকেট স্পেস থেকে বল নিয়ে চান্স তৈরি করছেন। একজন সম্পূর্ণ নাম্বার নাইনের অভাব সিটি দলে অনেকদিন ধরেই, তার মধ্যেও অবশ্য গার্দিওলাকে গোল এনে দেওয়ার জন্য তিনি ভরসা করে থাকবেন ২১ বছর বয়সী এই ‘ওয়ান্ডার কিড’-এর দিকেই।
প্রেডিকশন: ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ১-৩ ম্যানচেস্টার সিটি