লর্ডসের দুঃখ মুছে স্বপ্নের ফাইনালে মিচেল-নিশামদের নিউজিল্যান্ড
সেমিফাইনাল, আবুধাবি (টস- নিউজিল্যান্ড/ বোলিং)
ইংল্যান্ড ১৬৬/৪, ২০ ওভার (মঈন ৫১, মালান ৪১, সাউথি ১/২৪)
নিউজিল্যান্ড ১৬৭/৫, ১৯ ওভার (মিচেল ৭৩, কনওয়ে ৪৬, লিভিংস্টোন ২/২২)
ফলাফলঃ নিউজিল্যান্ড ৫ উইকেটে জয়ী
২৪ বল, ৫৭ রান। মিচেল-নিশাম পরে ব্যাটসম্যান বলতে স্যান্টনারই বাকি শুধু। ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড মুখোমুখি হলো, অথচ ম্যাচটা পৌছে গেলো এমন একপেশে অবস্থায়। হ্যাঁ, নিউজিল্যান্ডের ৫৭ রান নিতে দরকার হয়েছে মাত্র ১৮ বলের। জর্দানের ওভারে দুই ছয়ের সাথে এক চারে নিশাম শুরু করেছিলেন, ওকসের ওভারে দুই ছয়ের সাথে এক ওভারে শেষ করেছেন মিচেল। জর্দান সবমিলিয়ে ২২ দেওয়ার পর রশিদের ওভার থেকে আসে ১৫ রান। ১৩ বলে ২০ রান যখন লাগত, তখন আউট হয়ে যান নিশাম। তবে তার আগে ১০ বলে ২৭ রান করে তিনি ধ্বংসযজ্ঞের শুরুটা করেছেন, এবং আদতে কিউদের আশা জাগিয়ে তুলেছেন। এরপর ওকসের এক ওভারেই ২০ রান এনে মিচেল খেল খতম করেছেন এক ওভার বাকি রেখেই। ২০১৯ সালের সেই ‘বিখ্যাত’ ফাইনালের আগে গেলবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ড সেমিফাইনালে বিদায় নিয়েছিল ইংল্যান্ডের সাথেই হেরে। আজ টুর্নামেন্টের হট ফেভারিট ইংলিশদের ৫ উইকেটে হারিয়ে তারা পৌছে গেছে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে।
১৬৭ রান লক্ষ্যতাড়ায় প্রথম তিন ওভারে নিউজিল্যান্ডের রানও ইংল্যান্ডের সমানই ১৩ ছিল, কিন্ত পার্থক্য গড়ে দিয়েছে উইকেট! নিউজিল্যান্ড তিন ওভারের মধ্যেই তাদের অন্যতম দুই ভরসা উইলিয়ামসন ও গাপটিলের উইকেট খুইয়ে পড়েছে বিপদের মহাসাগরে। প্রথম বলেই চার মেরে ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিয়ে গাপটিল ওকসের বলে লিডিং এজে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেছেন। উইলিয়ামসনেরও কিছুতেই ব্যাটে-বলে হচ্ছিলো না, এরপর স্কুপ খেলতে গিয়ে শর্ট ফাইন লেগে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেছেন। মিচেল ও কনওয়ের ব্যাটে পাওয়ারপ্লেতে ৩৬ রান এনে তারা ঘুরে দাঁড়ায় কিছুটা।
তবে বোলিং-হেভি লাইনআপের জন্য স্বভাবতই নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং লাইনআপ ততটা চওড়া না। এজন্য ম্যাচে ফেরার জন্য এই মিচেল-কনওয়ে পার্টনারর্শিপেই ভরসা ছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের ৮২ রানের পার্টনারশিপ যখন ভাঙ্গে, তখন নিউজিল্যান্ডের স্কোর ৯৫ ছুঁয়েছে। কনওয়ে ডাউন দ্য ট্র্যাকে এসে খেলতে গিয়ে মিস করে স্টাম্পড হয়ে ফিরে যান ৩৮ বলে ৪৬ রানে। শেষ ছয় ওভারে কিউইদের লাগত ৭০ রান। ১৪তম ওভারে পাঁচ রান দিয়ে ১৬তম ওভারে এসে তিন রান দেন লিভিংস্টোন, সে ওভারে ফিলিপস লংঅফে ধরা খেয়ে ২ রানে ফেরেন। ইংল্যান্ডের চিন্তার বিষয় ছিল যে ডেথ বোলিং, সেই ডেথেই এসে তারা খেই হারালো। কনওয়ে-মিচেলের সাথে নিশাম ঝড়ে তাই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেল তারা।
এই বিশ্বকাপে মহাগুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে টস। টস ভাগ্য আজ উইলিয়ামসনের পক্ষেই থেকেছে। বোলিং নিয়ে সাউথি-বোল্ট সুইং পেলে তারা শুরুটাও করেছিলো দুর্দান্ত। প্রথম তিন ওভারে বাটলার-বেইরস্টো আনতে পেরেছেন মাত্র ১৩ রান, এই বিশ্বকাপে প্রথম তিন ওভারে যা ইংল্যান্ডের সর্বনিম্ন। পরের এক ওভারেই অবশ্য ইংল্যান্ডে এর চেয়ে বেশি রান পেয়ে গেছে। বোল্টকে বাটলার টানা দুই চারের মারের পর ওয়াইড বাইয়ে বোল্ট আরও পাঁচ রান দিয়ে ওভার শেষ করেছেন মোট ১৬ রানে। রয়ের ইনজুরিতে ওপেনিং নামা বেইরস্টো ভুগছিলেন অপর প্রান্তে। সাউথির মাথার উপর দিয়ে এক চার মেরে শেষমেশ তাঁর ইনিংসের সমাপ্তি ঘটেছে মিলনের বলে মিড অফে উইলিয়ামসনের দুর্দান্ত এক ক্যাচে।
১৭ বলে ১৩ রানে বেইরস্টো ফেরার পর ইংল্যান্ডের রানের চাকা স্লথ হয়ে যায় কিছুটা। বেইরস্টোর সে চারের ১৮ বল পর আসে আরেকটি বাউন্ডারি। স্যান্টনারকে রিভার্স সুইপে বাটলার চার মেরে আক্রমণের ইঙ্গিত দেন, তবে সোধিকে সুইচ হিট করতে গিয়ে এলবিডব্লিউর শিকার হয়ে তাকে ফিরে যেতে হয় ২৯ রানেই। পাওয়ারপ্লেতে ৪০ রান আনা ইংল্যান্ড পরের চার ওভারে আনতে পারে মাত্র ২৭ রান। মালানের ব্যাট কথা বলছে না বেশ কয়েক ম্যাচ ধরেই, শেষ ১০ ইনিংস মিলিয়ে তাঁর গড় ২১। আজ সেই মালানই ইংল্যান্ডকে এগিয়ে নেওয়ার কাজটা সামলেছেন। আর কোন উইকেট না হারিয়ে ১৪ ওভারে ১০০ পূর্ণ করে ফেলার পর ইংলিশদের লক্ষ্য হয়ে গিয়েছিল ‘শুধুই আক্রমণ’। তবে মঈন ১৮ বলে ১৯ রানে থাকা অবস্থায় বোল্টের নাকল বলে মারতে গিয়ে খাড়া ক্যাচ তুলেও ফেলেছিলেন, কিন্ত সাউদি দৌড়ে এসে ঠিক পৌঁছুতে পারেননি।
দৃষ্টিনন্দন ড্রাইভে চারটি চার মারার পরে সাউদিকে এক ছয়ের পর আরেকটি মারতে গিয়ে কনওয়ের হাতে ক্যাচ দিয়ে দেন মালানও। দশ রানে কনওয়ে মালানকে জীবন দিয়েছিলেন, এবার ক্যাচটা লুফে নিলে ৩০ বলে ৪১ রানে ফিরে যান তিনি, ভেঙ্গে যায় মঈন-মালানের ৬৩ রানের জুটি। মঈন এরপর ছন্দ পেয়েছেন, বল সীমানা ছাড়া করতে পেরেছেন কয়েকবার। শুরুতে কিছুটা ভুগলেও বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ফিফটির দেখা পেয়েছেন মঈন সেমিফাইনালে এসে। লিভিংস্টোন এসে তার সাথে একটি করে ছয় ও চারে ১৭ রান দিয়েছেন। শেষ পাঁচ ওভারে ৫৬ রান এনে তাই ইংল্যান্ড ১৬৬ রানের পুঁজি গড়তে সমর্থ হয়েছে। যাতে তারা কিউইদের দ্রুত উইকেট তুলে জয়ই দেখতে পাচ্ছিলো, নিশাম এসে লন্ডভন্ড করে দিলেন সব! ৭৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলে মিচেল নিউজিল্যান্ডকে নিয়ে গেলেন ফাইনালে। মিচেলের বাবা তা দেখেছেন গ্যালারিতে বসেই, এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গর্বিত বাবাও বোধহয় তিনিই!