• টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ২০২১
  • " />

     

    হারিস রউফ: খ্যাপ খেলে বেড়ানো 'টেপ টেনিস সুপারস্টার' বা 'মিস্টার ওয়ান ফিফটি'

    হারিস রউফ: খ্যাপ খেলে বেড়ানো 'টেপ টেনিস সুপারস্টার' বা 'মিস্টার ওয়ান ফিফটি'    

    রাতের আঁধারে কৃত্রিম আলোয় চলছে ব্যাট-বলের খেল। চারিদিকে সমবেত জনতা উচ্ছ্বসিত। গোলা হাতে প্রস্তুত তিনি। মাইকে কেউ একজন বললো, হারিস পিন্ডি... 

    অন্য অনেকের মতোই হারিসেরও ক্রিকেটার হওয়ারই স্বপ্ন ছিলো। অন্য অনেকের মতোই পরিবারের সমর্থন ছিল না। বন্ধুর বাসায় কিটব্যাগ রেখে পরিবারের অগোচরে খেলা চালিয়ে গেছেন। বল হাতে গোলা ছুড়তেন। হয়ে গিয়েছিলেন টেপ বলের সুপারস্টার! হারিস ইসলামাবাদি, কিংবা হারিস পিন্ডি। পাকিস্তানের এদিক-সেদিক, খেলতেন সবখানে গিয়ে!

    ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরের কোন একদিন। এক বন্ধু বললো, লাহোর কালান্দার্স ট্রায়াল নিচ্ছে, চল যাই! বন্ধু ক্লাব ক্রিকেট খেললেও হারিস খেলতেন না, কখনো ক্রিকেট বলেই খেলা হয়নি তার। দুদিনের ট্রায়াল। টেপ বলের স্পন্সর ছিল তার গুজরানওয়ালায়, থাকার ব্যবস্থা তাই হয়ে যাবে। নিজ শহর পিন্ডিতেও হয়েছিল সে ট্রায়াল, কিন্ত হারিস তা দেননি। বন্ধুর কথায় দেখি কী হয় ভেবে এবার তিনি পিন্ডি থেকে ছুটলেন গুজরানওয়ালায়…

    ভোরে রওয়ানা হয়ে যখন পৌছুলেন, গিয়ে দেখতে পেলেন, গেটে তালা দেওয়া! বলা হলো, দেরি হয়ে গেছে, এখন আর ঢুকতে দেওয়া যাবে না। কি করা যায়! হারিস ভাবলেন, এসেছি যখন ট্রায়াল তো দিতেই হয়! মাঠে ঢুকবার জন্যে পিছন দিয়ে আরেকটা গেট ছিল। সেটা তারা ভেঙ্গে দিলেন ধুড়ুম-ধাড়ুম করে! সেই বন্ধু তো হাজার হাজার লোককে দেখে ঘাবড়ে গেলেন। এত মানুষ! আমাদের কিভাবে হবে? হারিস বললেন, ভিতরে যা আছে সব বের করে দাও! এত মানুষদের না দেখে এতটাই জান-প্রাণ দিয়ে চেষ্টা কর যে এই হাজার মানুষ যেন দিনশেষে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকে! 

    রাউন্ডের পর রাউন্ড, হারিস পার করে গেলেন একেবারে শেষ রাউন্ডে। মাঝখানে লাঞ্চের সময়ে খাবার দেওয়া হয়েছিল, তাতে চাল ছিল বলে খাননি হারিস। চাল খেলে ভারী হয়ে যাবেন, বোলিংয়ে পুরোদমে ছন্দ পাবেন না বলে পেস কমে যাবে। 'দেখি কি হয়' ভেবে আসা হারিস এখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ!

    শেষ রাউন্ডে স্পিডগান ছিল। একে একে কয়েকজন বল করল, বাকি রইলেন হারিস। স্পিডগানে সর্বোচ্চ তুলতে পারলেন একজন, ৮৭ এমপিএইচ। হারিস মনস্থির করলেন, এর চেয়ে বেশি করবেন। করেও ফেললেন ৮৮ এমপিএইচ গতির এক বল। এরপর বলা হলো আরও বল করতে। দুই-তিন বল বাদেই এক বল করলেন, সাথে সাথেই স্পিডগানে ভেসে উঠলো ৯২.৩ এমপিএইচ। অর্থাৎ ১৪৮.৫৪ কিমি! 

    পরদিন একটা কল এলো তার ফোনে। কেউ একজন বললো, আকিব জাভেদ তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান। ওপাশ থেকে এপাশে আওয়াজ এলো, অস্ট্রেলিয়া যেতে চাও? 

    ****

    হারিফ রউফের আইডল ডেল স্টেইন। স্টেইন প্রথমবারের মতো বিগ ব্যাশে নাম লিখিয়েছেন, ২০১৯-২০ সালের মৌসুমে। হারিস রউফও আছেন বিগ ব্যাশের আঙ্গিনায়। হোবার্ট হারিকেনসের একজনের ইনজুরি তাকে এনে দিয়েছে সুযোগ। প্র‍্যাকটিস ম্যাচও খেললেন হারিস, কিন্ত মুল ম্যাচে মাঠে নামার আগেই ওই ক্রিকেটার ইনজুরিমুক্ত! 

    এদিকে স্টেইন পড়ে গেলেন ইনজুরিতে। তার জায়গায় হারিসকেই ডেকে নিলো মেলবোর্ন স্টার্স। হোবার্টের পথ বন্ধ হয়ে হারিসের জন্য এই যে পথ খুলল, তাতে হারিস তার আইডলকেই পেয়ে গেলেন একই ড্রেসিংরুমে। তবে হারিসের চুক্তিটা হলো শুধু তিন ম্যাচের জন্যেই। হারিস ভাবলেন, সুযোগ পেয়েছেন যখন তা এমনভাবে কাজে লাগাবেন যাতে এক ম্যাচ তাকে আরও একশ ম্যাচের সুযোগ এনে দেয়!

    প্রথম ম্যাচেই দুই উইকেট নিলেন। দ্বিতীয় ম্যাচে মাঠে পৌঁছে ম্যাচের আগে ড্রেসিংরুম থেকে বেরিয়েছেন৷ বাইরে সিকিউরিটি গার্ডকে দেখে 'বিদেশ বিভুইয়ে আপন' কেউ মনে হলো তার, ভাবলেন পাকিস্তানি কিংবা ভারতীয় হবেন। জানলেন তিনি ভারতীয়, হারাস জানালেন তিনি পাকিস্তানি, লাহোর কালান্দার্সের খেলোয়াড়। ওই সিকিউরিটি গার্ড বললেন, খেলা শেষে বুকে একবার জড়িয়ে যেতে। হারিস বললেন, খেলা শেষে কেন? এখনই নয় কেন বলে তখনই তাকে জড়িয়ে নিলেন বুকে।

    হারিস দেখলেন, তার চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে, আবেগের সাগরে ডুবন্ত তিনি। তা দেখে হারিস ড্রেসিংরুমে ফিরে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলেন, তাকে যেন পাচঁ উইকেট পাইয়ে দেন। ম্যাচ শেষে মাঠ থেকে বেরিয়ে আসছেন হারিস, হাতে তার বল। বিগ ব্যাশের মতো মঞ্চে নিজের প্রথম পাচঁ উইকেটে পাওয়া বল এসে দিয়ে দিলেন সেই সিকিউরিটি গার্ডকে।  

    হারিস স্টার্স একাদশের নিয়মিত নাম হয়ে ওঠার পথেই। নিজের আইডলের সাথেও খেলতে নামার সৌভাগ্য হয়ে গেলো। তবে স্টেইনের আবার চুক্তি ছিল ছয় ম্যাচের। এরপর তার জায়গায় আসার কথা ছিল ইংল্যান্ডের প্যাট ব্রাউনের। এবার ইনজুরিতে পড়ে গেলেন ব্রাউন৷ পুরো মৌসুমের জন্যই হারিসকে তাই রেখে দিল স্টার্স৷ ওই পাচঁ উইকেটের পর হ্যাটট্রিকের দেখাও পেয়ে গেলেন। ১১ ম্যাচ খেলে ৭.০৬ ইকোনমিতে বল করে নিলেন ২০ উইকেট। ততদিনে বিশ্বক্রিকেটে তার গতির ঝড় সাড়া ফেলে দিয়েছে। 

    পাকিস্তানের ক্রিকেট মহলে তার নামের সঙ্গে জুড়েও গিয়েছিল 'ওয়ান ফিফটি’। পাকিস্তানের অনেক ক্রিকেটারের ফোনে তার নাম্বার সেভ করা 'ওয়ান ফিফটি হারিস রউফ' নামে! হারিসের লাহোর কালান্দার্সের জার্সির পিছনে যে নাম্বার লেখা সেটিও ওয়ান ফিফটি। কেউ যদি তার কাছে অটোগ্রাফ চায়, সাথে তিনিও এও লিখে দিতে কার্পণ্য করেন না- ওয়ান ফিফটি!

    ****

    প্লেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম। নামেই বুঝতে পারছেন, এখানে-সেখানে লুকিয়ে থাকা প্রতিভাকে খুঁজে নেওয়ার সাথে লাহোর কালান্দার্সের এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য তাদের 'ডেভেলপ' করাটাও। ২০১৭ সালে এভাবে দেশ ঘুরেছিল প্লেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, সংক্ষেপে পিডিপি। গুজরানওয়ালায় ট্রায়াল নিয়ে পেয়ে গিয়েছিল এক রত্ন, হারিস রউফ যার নাম। 

    এখন যদি আপনি হারিসকে রত্ন বলেন, তবে সেই 'অপরিপক্ক' হারিসকে 'রত্ন'তে পরিণত করার কৃতিত্ব পিডিপিরই। ট্রায়ালে নির্বাচিত হওয়ার পর তাকে অস্ট্রেলিয়ায় পাঠিয়েছে। সেখানেই উন্নত সুযোগ-সুবিধার সাথে তিনি তার ক্রিকেট দীক্ষাটা নিয়েছেন। অস্ট্রেলিয়ায় ক্লাবের সঙ্গে জুড়িয়েও দিয়েছে হারসিকে। গ্রেড ক্রিকেট খেলেছেন। প্রায় দুবছর ধরে চলেছে তার গড়ে উঠার 'ট্রেনিং'। 'যেমন খুশি তেমন চলো' জীবনের সাথে দেখাসাক্ষাৎ বাদ দিয়েছেন ততদিনে। জীবন চলে রুটিনমাফিক, ডায়েটপ্ল্যানে একটু এদিক-সেদিক হয় না। হারিসও ছিলেন স্থির সংকল্প, তার উন্নতির ধারা চলে গেছে তাই। তাঁর পেসের কথাও ছড়িয়ে পড়তে লাগলো চারিদিকে।

    ভারত গেছে অস্ট্রেলিয়া সফরে। নেট প্র্যাকটিসে একদিন রবি শাস্ত্রী তার পেসারদের বিরতি দিতে চাইলেন। কিন্ত তার আবার পেস চাই! ম্যানেজারকে বললেন, যোগাড় করতে। হারিসের ডাক পড়ে গেলো ভারতের নেটে। রাহুল-কোহলিদের বল করলেন, প্রশংসাও যে কুড়াবেন তা তো জানেনই! 

    লাহোর কালান্দার্সের একাডেমিতেও চালিয়ে গেছেন ট্রেনিং। পিএসএলে দলের সাথেও তাকে রেখে শেখার সুযোগ করে দিয়েছে লাহোর কালান্দার্স। তার গড়ে উঠার প্রক্রিয়াটা চলেছে বেশ সুন্দরমতো! ২০১৮ সালে আবুধাবি ট্রফিতে চ্যাম্পিয়ন হয় লাহোর কালান্দার্স। হারিস ইয়র্কার, পেসে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সেখানে। ২০১৯ সালের পিএসএলে মূল দলেও তাকে নিয়ে নিলো লাহোর। ১০ ম্যাচ খেলে ৭.৪২ ইকোনমিতে বল করে হারিস নিলেন ১১ উইকেট। এরপর বিগ ব্যাশে যেই সুযোগ পেলেন, করলেন বাজিমাত, এবার বিশ্বই চিনে নিলো তাকে। একশো চল্লিশের বেশি গতিতে বল করলে পাকিস্তানে তিনি উপেক্ষিত হতে পারেন না, বলেছিলেন একবার। সেই বিবিএল পরেই স্বপ্নের পাকিস্তানের জার্সিটাও চলে এলো তার কাছে।  

    বয়স যখন তেইশ-চব্বিশের মধ্যিখানে, তখনই 'আসল' ক্রিকেট শুরু করা হারিস দুবছর পার করতে না করতেই পাকিস্তানের হয়ে অভিষেক করে ফেললেন। বাংলাদেশের সাথে অভিষেকের পর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচে ৭.৩০ ইকোনমিতে বল করে ৮ উইকেট নিয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হলেন। একটি ফ্র‍্যাঞ্চাইজি, লাহোর কালান্দার্স, একটি উদ্যোগ, পিডিপি- পাকিস্তানকে দিয়ে দিলো এক রত্ন। 

    ****

    ২০২০ সালে বাংলাদেশ গেলো পাকিস্তানে। সে সিরিজের টি-টোয়েন্টি দলে ডাক পাওয়ার পর মিডিয়ার সামনে এলেন হারিস। অনেক প্রশ্নের ভীড়েও এই প্রশ্নের হারিয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই, 'এই সিরিজে আপনার লক্ষ্য কী?'

    উত্তরটা একটু অনুমান করুন তো। না, ভালো খেলা কিংবা দলকে জেতাতে অবদান রাখা, হারিসের উত্তরে এসবের জায়গা হয়নি। ধপাস করে তিনি বলে দিলেন, এই সিরিজে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী হতে চাই। হারিস 'বড়' লক্ষ্যে চোখ রাখতে পারেন! 

    পিএসএলে সেবারই প্রথম খেলছেন। এক সাক্ষাৎকারে বলে দিলেন, গতি নিয়ে যেতে চান ঘন্টাপ্রতি ১৫৫-৫৬ কিমি তে। তার চূড়ান্ত গোল জিজ্ঞেস করা হলে বলতে দেরি করলেন না, ১৬১ পেরিয়ে যেতে চাই! সেটা কত কঠিন তারও নিশ্চয়ই অজানা নয়, তবু একটা কথা যে আছে, বড় লক্ষ্যে চোখ রাখলে ছোট লক্ষ্য সহজেই পূরণ করা যায়। যদিও ঘন্টায় ১৫৩ কিমি গতির বলকে তো আর 'ছোট' বলা যায় না। বিশ্বকাপে তার ঘন্টাপ্রতি ১৫৩ কিমির বলের চেয়ে বেশি গতির বল তো আর কেউই করতে পারেননি! 

    'সে প্যাশন ও আগ্রাসনের অনন্য মিশ্রণ’, বলেছিলেন আকিব জাভেদ। আগ্রাসনের কথা এলেই উঠবে শোয়েব আক্তারের নাম। আগ্রাসনে পরিপূর্ণ হারিস রউফের প্রশংসা করতে গিয়ে এক টিভি শোতে শোয়েবও বারবার হারিসের প্যাশনের কথাই বলছিলেন। শোয়েবের নামের সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডি নামও বরাদ্দ করে দেওয়া হয়ে গেছে। হারিসের তাই 'রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস' খেতাবটা পাওয়ার নয়৷ তাকে বরং 'ওয়ান ফিফটি'র বদলে 'ওয়ান সিক্সটি ওয়ান' বলা যেতে পারে!

    তবে সেটি করতে হলে যে ঘন্টায় ১৬১ কিমি গতির বল করার একটা শর্তও রয়েছে। আকিব জাভেদের মন বলে, হারিস তা করে ফেলবেন! আকিব জাভেদ, পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার, সম্ভবত তার চেয়ে বড় পরিচয় একজন কোচ। হারিসের জীবনে লাহোর কালান্দার্সের অবদানের কথা যত জায়গায় লেখা আছে, সেখানে লাহোর কালান্দার্সের বদলে আকিব জাভেদ পড়ে নিলেও খুব একটা ভুল হওয়ার নয়। হারিসের জীবনে আকিব জাভেদের অবদান এতটাই!

    এই লাহোর কালান্দার্স, তাদের প্লেয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম, আকিব জাভেদ। সবমিলিয়ে তাদের অবদানও পাকিস্তানের ভুলার নয়, তাদের বদৌলতেই যে পাকিস্তান পেল হারিস রউফকে। ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত ক্রিকেট বলের ধারেকাছে না থাকা হারিস আজ পাকিস্তান একাদশের নিয়মিত একজন। 

    ****

    রাতের আঁধারে কৃত্রিম আলোয় এখনও চলে ব্যাট-বলের খেল। গোলা হাতে এখনও প্রস্তত হন হারিস। আগে অচেনা-অজানা জায়গায় খ্যাপ খেলে বেড়ানো হারিস এখন লড়েন দেশের জন্য। এখন মাঠের চারিদিকের সমবেত জনতা যেমন উচ্ছ্বসিত থাকে, তেমনি থাকে পুরো পাকিস্তানই। 

    হয়তো দেশের সীমানা ছাড়িয়ে ভিনদেশি কেউও, কিংবা অনেকে!