নিউজিল্যান্ডকে উড়িয়ে অবশেষে টি-টোয়েন্টির সোনার হরিণের দেখা পেল ওয়ার্নার-মার্শদের অস্ট্রেলিয়া
ফাইনাল, দুবাই (টস- অস্ট্রেলিয়া/ বোলিং)
নিউজিল্যান্ড ২০ ওভারে ১৭২/৪ (উইলিয়ামসন ৮৫, গাপটিল ২৮, হেজলউড ৩/১৬)
অস্ট্রেলিয়া ১৮.৫ ওভারে ১৭৩/২ (মার্শ ৭৭, ওয়ার্নার ৫৩, বোল্ট ২/১৮)
ফলাফলঃ অস্ট্রেলিয়া ৮ উইকেট জয়ী
এই ট্রফিটাই বাদ ছিল তাদের কেবিনেটে। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে তারাই রাজা, কিন্তু টি-টোয়েন্টিতে সেটা অধরা ছিল অসিদের। অবশেষে প্রিয় প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ডকে পেয়ে অস্ট্রেলিয়া মেটাল সেই অতৃপ্তি। উইলিয়ামসনের দুর্দান্ত ইনিংস বৃথা করে দিলেন ওয়ার্নার-মার্শ। অস্ট্রেলিয়াকে এনে দিলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি শিরোপা।
নিউজিল্যান্ডের ব্যাটিং গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রথমেই চোখ থাকবে গাপটিল ও উইলিয়ামসনের উইকেটে। কিন্ত অজিরা সেই দুজনের ক্যাচই ফেলে দিলো! অস্ট্রেলিয়া সমর্থকদের তখন হয়তো মনে হয়েছে, এই বুঝি ম্যাচ গেলো! কিন্ত গাপটিল জীবনটা কাজে না লাগাতে পারলেও উইলিয়ামসন বিশ্বকাপের ফাইনালে যৌথভাবে সর্বোচ্চ রানের ইনিংস খেলেই থেমেছেন। যার ফলে নিউজিল্যান্ড বিশ্বকাপের ফাইনালে দলীয় সর্বোচ্চ রানের পুঁজি গড়তে পেরেছিল। কিন্ত এই বিশ্বকাপে দুবাইয়ে রাতের বেলায় লক্ষ্যতাড়ায় হারের কোন উদাহরণ নেই। ওয়ার্নারের ‘স্মার্ট’ ব্যাটিংয়ের সাথে মার্শের ভয়ডরহীন আত্মবিশ্বাসী ইনিংসে তা আর হলোও না! স্টার্ক যেদিন চার ওভারে ৬০ রান দিয়ে তাঁর ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বাজে দিন পার করলেন, অস্ট্রেলিয়ার কোন বোলার হয়ে বিশ্বকাপে কোন ইনিংসে সবচেয়ে বেশি রান দেওয়ার রেকর্ড গড়লেন, সে ম্যাচ শেষে তিনি মাঠে দৌড় দিয়ে নামলেন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েই।
উইকেটবিহীন বোল্টের প্রথম ওভার পেরিয়ে গেলেও সেই বোল্টেই ধরা খেয়েছেন ফিঞ্চ। তৃতীয় ওভারে তাকে চার মারার পরের বলেই ডাউন দ্য ট্র্যাকে এসেছিলেন ফিঞ্চ, বোল্ট চতুরতার সাথে বাউন্সার করলে ফিঞ্চ স্কোয়ার লেগে ক্যাচ তুলে দিয়ে ৫ রানে ফিরে যান প্যাভিলিয়নে। মার্শ এসে আত্মবিশ্বাসের সাথে খেলে বিপদে পড়ার শঙ্কা হাওয়ায় মিলিয়ে দেন! ৩ ওভারে ১৫ রান আনা অস্ট্রেলিয়া চতুর্থ ওভারে মিলনকে মার্শ নিজের প্রথম বলেই এক ছয়ের পর দুই চার মারলে পায় ১৫ রান। পাওয়ারপ্লের শেষ ওভারে মিলনে তিন রান দেওয়ার আগে সাউথি দশ রান দিলে অস্ট্রেলিয়া পাওয়ারপ্লেতে তুলে ৪৩ রান। বলপ্রতি রানেই এগুচ্ছিলেন ওয়ার্নার, সোধির এক ওভারেই এরপর মারেন এক ছয় ও দুই চার। নিয়মিত বাউন্ডারি খুঁজে নেওয়ার পাশাপাশি রানিং বিট্যুইন দ্যা উইকেটে দুর্দান্ত ছিলেন ওয়ার্নার-মার্শ।
৭ ওভারে পঞ্চাশ পূর্ণ করা অস্ট্রেলিয়া পরের ৫০ রান আনতে নেয় মাত্র ২৭ বল! ১১তম ওভারে নিশামকে ওয়ার্নার ছয় মেরে ৩৪ বলে ফিফটির দেখা পাওয়ার আগে মার্শও বল সীমানা ছাড়া করেন। ভয়ডরহীন মার্শের সাথে চতুর ওয়ার্নার কিউইদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। ১২ ওভারে ১০৬ রান এনে ফেলা অস্ট্রেলিয়ার এই জুটি ভাঙ্গতে উইলিয়ামসন তাঁর ভরসা বোল্টকে আনেন। বোল্ট এসে ওয়ার্নারকে ৩৮ বলে ৫৩ রানেই বোল্ড করে থামিয়ে দেন। সে ওভারে বোল্ট ৩ রান দিলে কিউইদের ম্যাচে ফেরার আশা জাগলেও তা মরে যায় পরের দুই ওভারে ২৭ রান এলে। সোধিকে ছয়-চারে সবমিলিয়ে ১৬ আনার পর মিলনে ১১ রান দিলে অস্ট্রেলিয়া পাঁচ ওভারে ৩৭ রানের সহজ সমীকরণে চলে আসে। ম্যাক্সওয়েলের ১৮ বলে ২৮ রানের ইনিংস খেলেছেন। সাউথিকে রিভার্স সুইপে চার মেরে যখন ‘উইনিং মোমেন্ট’ রচনা করলেন, তখন অপর প্রান্তে ৫০ বলে ৭৭ রানে অপরাজিত মার্শকে এসে জড়িয়ে ধরলো পুরো অস্ট্রেলিয়ান দল।
সেমিফাইনালে টস ভাগ্য ফাইনালে মুখোমুখি হওয়া দুই অধিনায়কের পক্ষে থাকলেও আজ তা একজনের পক্ষেই থাকতো। এবং সেই ভাগ্যবান আগের ছয় ম্যাচে পাঁচবার টস জেতা ফিঞ্চই। তবে টসে হারা কিউইদের ভাগ্য ভালো ছিল, শুরুতে সুইংয়ের দেখা পাননি অজি বোলাররা। স্টার্কের সুইং খুঁজার চেষ্টায় বাইরে বল করেছেন, গাপটিল সহজেই চারের পাশাপাশি রানের দেখা পেয়েছেন। স্টার্কের ৯ রানের ওভার শেষে হেজলউড টাইট লাইন-লেংথে ৪ রানের ওভার করলে ম্যাক্সওয়েলকে নিয়ে আসেন ফিঞ্চ। অস্ট্রেলিয়ার ফিফথ বোলিং অপশনের থেকে ফায়দা লুটতে চান কিউইরা, মিচেল প্রথম বলেই মাথার উপর দিয়ে ছয় মেরে সবমিলিয়ে সে ওভার থেকে আনেন ১০ রান। হেজলউড এসে গাপটিলের হাতে প্রথম বলেই চার খেয়ে পরের ওভার শুরু করেন, কিন্ত গতিবৈচিত্র্যে মিচেলকে ধোঁকা দিয়ে ওয়েডের ক্যাচ বানিয়ে ফিরিয়ে দেন ১১ রানে।
প্রথম চার ওভারেই বাউন্ডারির দেখা পাওয়া নিউজিল্যান্ড পরের চার ওভারেই কোন বাউন্ডারি খুঁজে নিতে পারে না অবশ্য। উইলিয়ামসনের সাথে গাপটিলও ঝুঁকিবিহীন ইনিংস এগিয়ে নেওয়ার দিকে মনযোগ দিয়েছেন। প্রথম চার ওভারে ২৮ রান আনা কিউইরা পরের চার ওভারে আনতে পারে মাত্র ১২ রান। সেই ৪৮ বলের মধ্যে নিউজিল্যান্ড ডট দেয় ২৬টি বল। আক্রমণের দায়িত্বটা এরপর উইলিয়ামসনই নেন। মার্শকে টানা দুই বলে মারেন দুই চার, প্রথম বাউন্ডারিটা আসে ৩২ বল পর। জাম্পা তাঁর দুই ওভারে মিলিয়ে ৮ রান দিলে ১০ ওভারে নিউজিল্যান্ডের সংগ্রহ হয় মাত্র ৫৭। পরের ওভারে স্টার্কের বলে ফাইন লেগে উইলিয়ামসনের ক্যাচ মিস দিয়ে দেন হেজলউড। ১০ রানে থাকা অবস্থায় গাপটিলের ক্যাচও কঠিন হলেও উইকেটের পিছনে ওয়েড তা লুফে নিতে ব্যর্থ হন। এই দুই ক্যাচ অজিদের বিশ্বকাপ স্বপ্নেরই মৃত্যু ঘটিয়ে দেয় কিনা!
গাপটিল জীবন কাজে লাগাতে না পেরে জাম্পার বলে মিড উইকেটে ধরা খেয়ে ৩৫ বলে ২৮ রানেই থেমে যান। কিন্ত উইলিয়ামসন থামেন যখন, ততক্ষণে মরুর বুকে ঝড় নেমে আসা সারা! স্টার্কের যে ওভারে জীবন পেয়েছিলেন উইলিয়ামসন, সে ওভারে টানা তিন চার মেরেছেন। এরপর তাঁর তৃতীয় ওভারে মেরেছেন চারটি চারের সাথে একটি ছয়। ১৬ তম ওভারে স্টার্কের কাছ থেকে ২২ আনার আগে উইলিয়ামসন ম্যাক্সওয়েলকে দুই ছয়ে সে ওভার থেকে এনেছেন ১৬ রান, ধীর শুরু করা ফিলিপসও জাম্পাকে ছয়ের পর মেরেছেন চার। ড্রিংক্স ব্রেকের পরের ছয় ওভারে নিউজিল্যান্ড আনে ৭৯ রান! কিন্ত পরের চার ওভারে ৩৬ রানের বেশি আনতে পারে না কিউইরা।
১৭তম ওভার কামিন্স বাউন্ডারিবিহীন ৮ রানে শেষ করতে পারেন। হেজলউডের পরের ওভারে উইলিয়ামসনের সাথে আউট হয়ে যান ফিলিপসও। ১৭ রানে জীবন পাওয়া উইলিয়ামসন গিয়ে থামেন ৮৫ রানে, তাঁর ৪৮ বলের ইনিংসে ছিল ১০ চারের সাথে তিন ছয়ের মার। সে ইনিংসের বদৌলতে ১০ ওভারে ৫৭ রান আনা নিউজিল্যান্ড পরের ১০ ওভারে ১১৫ রান এনে ১৭২ রানের পুঁজি গড়ে। কিন্ত সাত বল বাকি থাকতেই অস্ট্রেলিয়া তা পেরিয়ে গেলে নিউজিল্যান্ডের প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বপ্ন পূরণ হয় না। তাদের পাঁচবারের ওয়ানডে বিশ্বকাপজয়ী প্রতিবেশীরা পেয়ে যায় প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দেখা!