১০ উইকেটের পাঁচকাহন
গত সপ্তাহেই দক্ষিণ আফ্রিকার ৪-দিনের ফ্র্যাঞ্চাইজি সিরিজের ডিভিশন দুইয়ের ম্যাচে অসামান্য এক কীর্তি গড়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এক অলরাউন্ডার শন ওয়াইটহেড। ২০১৬ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ খেলতে বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া এই অলরাউন্ডার সাউথ ওয়েস্টার্ন ডিসট্রিক্টের হয়ে ইস্টার্ন ডিসট্রিক্টের বিপক্ষে নিয়েছেন ম্যাচে ১৫ উইকেট। তবে দ্বিতীয় ইনিংসে বাঁহাতি অফ স্পিনের ঘূর্ণিজালে নিয়েছেন ১০ উইকেট; আর গড়েছেন দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের দ্বিতীয় সেরা বোলিং ফিগারের (১০-৩৬) রেকর্ড। ১৯০৬ সালে লেগস্পিনার বার্ট ভোগলারের বোলিং ফিগার (১০-২৬) তাই এখনও দক্ষিণ আফ্রিকার ঘরোয়া ক্রিকেটের সেরা বোলিং ফিগার হিসেবেই অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ইনিংসে ১০ উইকেটের ঘটনা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আছে মাত্র ২টি: ১৯৫৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জিম লেকার ও ১৯৯৯ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে অনিল কুম্বলে (১০-৭৪)। তবে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এই ঘটনা ঘটেছে বেশ কয়েকবার। ইনিংসে ১০ উইকেটের সেই ঘটনাগুলো নিয়েই চলুন ঘুরে আসা যাক ইতিহাসের দুনিয়ায়।
ইনিংসে ১০ উইকেটের প্রথম ঘটনা
১৮৪৮ সাল। ইংল্যান্ডের মুখোমুখি কেন্ট। দুই দিনের সেই ম্যাচে কেন্টের শেষ ইনিংসে লক্ষ্য ছিল ১০৫ রান। কিন্তু মাত্র ৪৯ রানেই গুঁটিয়ে যায় কেন্ট। সেই সাথে ঘটল এমন এক ঘটনা (একজন বোলারের ইনিংসে ১০-উইকেট) যা ক্রিকেট মাঠে আগে ঘটেছে; কিন্তু এগার জন বিশিষ্ট দুই দলের খেলায় ঘটল এই প্রথম-- এক ইনিংসে ১০ উইকেটের ১০টিই নিলেন একজন বোলার। কেন্টের সেই হন্তারকের নাম এডমান্ড হিঙ্কলি।
১৮৫০ সালে ঘটল সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ইংলিশ ঘরোয়া মৌসুমে মুখোমুখি উত্তর ও দক্ষিণ-দলের নাম শুধু এটুকুই। প্রথম ইনিংসে সাউথ পড়ল ৩৬ রানে গুঁটিয়ে যাওয়া লজ্জায়। দ্বিতীয় ইনিংসে করতে পারল আরেকটু বেশি-৭৬। দ্বিতীয় ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়ে দুই দিনের ম্যাচ একদিনেই শেষ করে দিয়েছিলেন জন উইজডেন, যার হাতেই জীবন পেয়েছিল ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত “উইজডেন ক্রিকেটারস অ্যালমানাক”। তবে উইজডেনের এই কীর্তি ছিল অসামান্য। ক্রিকেট ইতিহাসে সেটাই একমাত্র ঘটনা যেখানে এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়া কোনও বোলারের ১০টি উইকেট ছিল বোল্ড!
এই দুজনের মধ্যে মিলটা বেশ মজার: ঐ দুই ম্যাচেই কোনও বোলারের বোলিং ফিগারের লিখিত হিসেব নেই।
এক নয় দুই নয় তিন বার!
ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে তিনবার ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার কীর্তি আছে “টিক” ফ্রিম্যানের, পুরো নাম আলফ্রেড পার্সি ফ্রিম্যান। এক ইংলিশ ঘরোয়া মৌসুমে ৩০০ উইকেট নেওয়া একমাত্র এই ক্রিকেটার ক্যারিয়ার জুড়েই খেলেছেন কেন্টের হয়ে। লেগস্পিনের জাল বুনে প্রথম ১৯২৯ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে এই কীর্তি গড়েছিলেন ৪২ বছর বয়সে। এরপর যথাক্রমে ৪৩ ও ৪৪ বছর বয়সে তার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিলেন সেই ল্যাঙ্কাশায়ার ও পরে এসেক্সের বিপক্ষে।
অভিষেকেই বাজিমাত
১৮৮৯-৯০ নিউজিল্যান্ড মৌসুমে ক্যান্টারবারি-ওয়েলিংটন ম্যাচে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন এক আনকোরা ইংলিশ মিডিয়াম ফাস্ট বোলার। অভিষেকেই ওয়েলিংটনকে ৭১ রানে সেদিন গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন অ্যালান এডওয়ার্ড মস। ইনিংস শেষে তার বোলিং ফিগার ছিল: ২১.৩-১০-২৮-১০! অভিষেকেই ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার একমাত্র কীর্তি এখনও এটিই।
সর্বজ্যেষ্ঠ ও সর্বকনিষ্ঠ
১৯২১ সালে ৪৬ বছর ১১৬ দিন বয়সে কার্ডিফে গ্ল্যামরগানকে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৬ রানেই আটকে ফেলেছিলেন ডানহাতি মিডিয়াম ফাস্ট পেসার বিলি বেস্টউইক। ১৯ ওভারে ৪০ রান দিয়ে ইনিংসের ১০ উইকেট নিজেই তুলে নিয়ে সবচেয়ে বেশি বয়সে ইনিংসে ১০ উইকেটের রেকর্ড গড়েছিলেন, যা আজও অক্ষুণ্ণ। ঐ একই দিনে ইংলিশ ঘরোয়া ক্রিকেট দেখেছিল একই ধরনের কীর্তি। উস্টারশায়ারের হয়ে সমারসেটের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে ১০ উইকেট নিয়েছিলেন জ্যাক ওয়াইট। একই দিনে ইনিংসে ১০ উইকেটের দুটি ঘটনা ক্রিকেট ইতিহাসে এটিই একমাত্র, তারিখ: ২০ জুন, ১৯২১।
১৯৮৯-৯০ মৌসুমে বিসিসিপি প্যাট্রন্স ট্রফির ম্যাচে ফয়সালাবাদকে প্রথম ইনিংসেই গুটিয়ে দিয়েছিলেন বাহাওয়ালপুরের ডানহাতি মিডিয়াম পেসার ইমরান আদিল। ৯২ রান দিয়ে ইনিংসের ১০টি উইকেটই তুলে নেওয়ার সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর ৩৪৪ দিন। ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়া সর্বকনিষ্ঠ বোলার হিসবে ইতিহাসের পাতায় এখনও তার নামটাই খোদাই করা আছে।
লেকারের অমর কীর্তি
একই মৌসুমে দুইবার ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড আছে শুধুমাত্র একজনের:জেমস চার্লস লেকার। ইতিহাস তাকে চেনে জিম লেকার নামেই। ১৯৫৬ এর সেই মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ানদের জীবন একাই বিষিয়ে তুলেছিলেন এই ইংলিশ ডানহাতি অফব্রেক বোলার। ম্যানচেস্টারে অস্ট্রেলিয়াকে গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ১০-৫৩ বোলিং ফিগারের আখ্যান তো রীতিমত ক্রিকেট রূপকথারই অংশ হয়ে গিয়েছে। সেই “লেকার’স ম্যাচ” এর আভাসও তিনি দিয়ে রেখেছিলেন অ্যাশেজ শুরুর আগেই, সফরকারীদের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে। সারের হয়ে অস্ট্রেলিয়ানদের বিপক্ষে ওভালে এক ইনিংসেই নিয়েছিলেন ১০ উইকেট, ৮৮ রান দিয়ে। সেই ম্যাচটা অস্ট্রেলিয়ানরা হেরেছিল ১০ উইকেটে।
কিছুটা ভিন্ন যেসব ১০ উইকেট
ক্রিকেটের জন্মলগ্নে ১১-জন-প্রতি-দলের রীতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে ওঠেনি। বেশ কিছু সময় ধরেই প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে দল প্রতি ১২ বা তার বেশি খেলোয়াড় থাকত। সেই সময়ে ইনিংসে ১০ উইকেটের ঘটনা আছে ৫ টি; যার মধ্যে একটি আছে ডব্লিউ জি গ্রেসের, ১৮৭৩ সালে এমসিসির হয়ে কেন্টের বিপক্ষে (১০-৯২)। দলে ১২ বা তার বেশি খেলোয়াড় থাকায় ১০ উইকেট নেওয়াটা অবশ্য তুলনামূলক সহজ ছিল বলা চলে। ইনিংসে সব ব্যাটারকে সাজঘরে তো আর একাই ফেরানো হয়নি তাদের।