মিশু বিশ্বাসের আয়রনম্যান যাত্রা
ছোটবেলা সাইকেল চালানোর খুব একটা সুযোগ হয়নি। বড় হয়ে যখন সাইকেল চালানো শিখতে গেলেন তখন ব্রেক ফেইল করে একদিন ট্রাকের সামনে পড়েছিলেন। ভাগ্য হয়তো সেদিন তার পক্ষে ছিল বলেই বেঁচে গিয়েছেন। চার মাস আগেও সাঁতার জানতেন না তিনি। দক্ষতা ছিল শুধুমাত্র দৌড়ে। তিনিই কিনা ৬ ঘণ্টা সাঁতার কেটে পাড়ি দিয়েছেন বাংলা চ্যানেল। সাঁতার-দৌড় ও সাইক্লিংয়ে এখন তিনি অনেক স্বচ্ছন্দ।
এই তিন ইভেন্টে যারা পারদর্শী তাদের নিয়ে বিশ্ব ট্রায়াথলন কর্পোরেশন আয়োজন করে থাকে “আয়রনম্যান ট্রায়াথলন” প্রতিযোগিতা। এ প্রতিযোগিতায় ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার, ১৮০ কিলোমিটার সাইক্লিং, ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করতে হয় ১৭ ঘণ্টার মধ্যে। যেখানে সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড় তিনটি ইভেন্টে একই সঙ্গে অংশ নিতে হয়। নিজের শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার চুড়ান্ত পরীক্ষা দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনটি ইভেন্ট শেষ করতে পারলেই পাওয়া যায় স্বীকৃতি।
আয়রনম্যান ট্রায়াথলন প্রতিযোগিতার সংক্ষিপ্ত আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতা। আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতায় সফল হয়েই পরবর্তীতে সবাই আয়রনম্যান ট্রায়াথলন প্রতিযোগিতায়অংশগ্রহণ করে থাকেন। এই প্রতিযোগিতায় সময় এবং তিনটি ইভেন্টের দৈর্ঘ্য আয়রনম্যান ট্রায়াথলন প্রতিযোগিতার প্রায় অর্ধেক। আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতায় ৮ ঘণ্টা ৩০ মিনিটে বিরতিহীনভাবে ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার সাঁতার, ৯০ কিলোমিটার সাইক্লিং এবং ২১ দশমিক ১ কিলোমিটার দৌড় শেষ করতে হয়। ১৮-৭৯ বছর বয়সের যে কেউ আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারেন। বয়সের ভিত্তিতে প্রতিযোগীদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়। এমনকি দুই পা ও এক হাত নেই এমন প্রতিযোগীও অংশ নিয়ে থাকেন এই প্রতিযোগিতায়।
এবারের আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতায় ৮৩ টি দেশ থেকে প্রায় ২১৫০ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করলেও প্রায় ১৫০০ জন সফলভাবে ইভেন্টটি শেষ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র প্রতিযোগী হিসেবে ছিলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিশু বিশ্বাস। শেষ করেছেন ৬ ঘণ্টা ৩৫ মিনিটে।
তার এই যাত্রার শুরুটা হয়েছিল ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে। অক্টোবরের শেষের দিক থেকে নিয়মিত সকালে হাঁটতে শুরু করেন মিশু। শরীরের ক্লান্তি দূর করতে এবং ফিটনেস ঠিক রাখার উদ্দেশ্যেই মূলত তিনি এই অভ্যাস গড়ে তোলেন। তারপর একটা রানিং কমিউনিটির সাথে পরিচয় হলে আস্তে আস্তে দৌড়াতেও শুরু করেন। দৌড় শুরু করার ১-১.৫ মাসের মধ্যেই ২০১৯ সালের নভেম্বরে সিঙ্গাপুর ও ডিসেম্বরে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হাফ ম্যারাথনে অংশ নেন মিশু। এরপরের গল্পটা এগিয়ে যাওয়ার। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত মেরিন ড্রাইভ ৫০ কিলোমিটার আল্ট্রা ম্যারাথনে অংশ নিয়ে ৩য় স্থান অর্জন করেছিলেন।
কিন্তু এর মধ্যেই আসে আরেকটা ধাক্কা। ২০২০ এর এপ্রিলে করোনা আক্রান্ত হন। সেজন্য পিছিয়ে যেতে হয় কিছুটা। সাঁতার আয়ত্তে না থাকায় সুস্থ হওয়ার পরপরই জুন-জুলাইয়ের দিকে শুরু করেন সাঁতার শেখা। দ্রুত দক্ষতাও অর্জন করে নেন। মিহসন এরপর বাংলা চ্যানেল পাড়ি। স্বপ্ন পূরণ করতে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জেটি থেকে ২০২০ সালের ৩০ নভেম্বর সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে সাঁতার শুরু করে ১৬ কিলোমিটার পথ সাঁতরে অতিক্রম করে বিকেল ৩টা ৪৮ মিনিটে সেন্টমার্টিন দ্বীপে পৌঁছান।
এর মধ্যেই আয়রনম্যান প্রতিযোগিতা নিয়ে আশেপাশে মানুষের কাছ থেকে টুকটাক শুনতে পেয়েছিলেন। তারপর বিস্তারিত জানতে ইন্টারনেটে খোঁজাখুঁজি শুরু করলেন নিজেই। সাইকেল চালানোর অভাবটা যেন তখনই টের পেলেন, তাই দেরি না করে সাইকেল চালানোর চর্চাও শুরু করে দিলেন এ বছরের শুরুতেই। সাইকেল চালানোর পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় বেশ কয়েকবার দুর্ঘটনায়ও পড়েছেন। এমনকি আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতায় যাওয়ার আগেও একবার সাইকেল থেকে পড়ে আহত হয়েছিলেন হাতিরঝিলে, তবুও থেমে যান নি।
ট্রেনিংয়ের জন্য সাধারণত ভোরবেলায় বেরিয়ে পড়তেন তিনি। সাধারণ চাকুরীজীবীদের মতন ৯টা-৫টা অফিস শিডিউল তার নেই, তাই কখনো হঠাৎ ফোন আসলে অপারেশনে বের হতে হতো, যেতে হতো ঢাকার বাইরেও। যার ফলে প্রায়ই মিস যেত ট্রেনিং। তবুও সময় পেলেই যেন নিজের প্রস্তুতিটা সেরে নিতেন।
মিশু বিশ্বাসের মতে আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার তিনটি ইভেন্টের মধ্যে দৌড় ও সাঁতারের চেয়ে সাইক্লিং তুলনামূলকভাবে কঠিন। প্রতিযোগীকে তিনটি সেক্টরেই নিজেকে পারদর্শী করতে প্র্যাকটিসের বিকল্প নেই এবং অবশ্যই প্রত্যেকটা ইভেন্ট সময় ধরে ধরে প্র্যাকটিস করতে হবে। কারণ, মুল প্রতিযোগিতায় সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড় তিনটি ইভেন্টে একই সঙ্গে অংশ নিতে হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তিনটি ইভেন্ট শেষ করতে পারলেই পাওয়া যায় স্বীকৃতি। তার মতে, এত বড় প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য পরিবারের সাপোর্টটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ফিনিশিং লাইন টাচ করার পর মাইকে নিজের নাম শোনার সাথে সাথে দেশের পতাকা ওড়ানোর অনুভূতিটা ছিল তার কাছে অন্যরকম। তবে মিশুর এখন লক্ষ্যটা আরও বড়। বাংলাদেশে আয়রনম্যান ৭০.৩ সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান প্রায় শূন্যের কোটায়। মিশু চান এ নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ুক, আরও প্রতিযোগী আসুক। সেই সঙ্গে নিজে যেতে চান আরও বড় মঞ্চে, নিতে চান আরও বড় চ্যালেঞ্জ।