যে চার জায়গায় চট্টগ্রাম টেস্টে হেরে গেছে বাংলাদেশ
আরও একটি টেস্ট, আরও একটি পরাজয়- চট্টগ্রাম টেস্টে আবারও রচিত হল সেই পুরনো গল্প। ম্যাচের বেশ কিছু সময় চালকের আসনে থাকলেও বাংলাদেশ হেরে গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোতে। নিয়ে লিটন দাসের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, মুশফিকের ৯১, অবিরাম হাত ঘুরিয়ে চলা তাইজুলের ৭ উইকেট, অভিষেকে ইয়াসিরের মানসিক দৃঢ়তার পরিচয়-পাকিস্তান টেস্টে বাংলাদেশের বেশ কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও শেষ পর্যন্ত হারতে হয়েছে তেমন কোনো নাটক বা রোমাঞ্চ ছাড়াই। কিন্তু ম্যাচে লিড নিয়েও বাংলাদেশ এবার পারল না কী কী কারণে?
একাদশ নির্বাচন
সাকিব আল হাসান না থাকায় বাংলাদেশ বাড়তি একজন ব্যাটসম্যান নিয়ে নেমেছিল। তবে চট্টগ্রাম টেস্টে একজন বোলারের অভাব টের পাওয়া গেছে ভালোমতোই। বাংলাদেশের দুই স্পিনার তাইজুল ইসলাম ও মেহেদি হাসান মিরাজের মূল শক্তি এক লেংথে বল করে যাওয়া; ব্যাটসম্যানকে ভুল করতে বাধ্য করা। উইকেট অনুকুলে না থাকলে তারা সেই অর্থে বড় টার্ন ও আদায় করতে পারেন না। তাইজুল বা মিরাজ নিজেদের দিনে, অনুকুল পরিবেশে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কার্যকর বোলার। বিশেষ করে স্পোর্টিং পিচেও ব্যাটসম্যানকে কাবু করার ক্ষমতা যে তাইজুল রাখেন তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন এই টেস্টের প্রথম ইনিংসে। তবে তাইজুলকে বিষধর হয়ে উঠতে দরকার অন্য প্রান্তের সহায়তাও; নয়ত একটি জুটি গড়ে তোলা তুলনামূলক সহজ কাজ হয়ে দাঁড়ায়। পরিকল্পনামাফিক তাকে সামলে অন্য প্রান্ত থেকে বাউন্ডারি বের করে নিয়ে উইকেটে থিতু হয়ে যাওয়া যায়, যার ধারাবাহিকতায় তাইজুলের টানা এক লেংথে বল করে যাওয়ার শক্তিও প্রশমিত হয়ে পড়ে। অস্ট্রেলিয়াতে প্যাট কামিন্স যেমন ৮-১০ ওভারের স্পেলে ব্যাটসম্যানদের কোণঠাসা করে থাকতে পারেন বাংলাদেশের পেসারদের সত্যি বলতে সেই সামর্থ্য নেই। এবাদত হোসেন হয়ত টানা বল করার ক্ষমতা রাখেন; কিন্তু প্রতি ওভারেই ১-২টি খারাপ বলে ব্যাটসম্যানদের হাত খোলারও যথেষ্ট সুযোগ দেন। ৪ বোলার নিয়ে খেলার মত অবস্থায় বাংলাদেশ দুর্ভাগ্যজনকভাবে যেতে পারেনি। আর কোনও বলং অলরাউন্ডারও না থাকায় তা দ্বিতীয় ইনিংসে আরও ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে, নতুন পরিকল্পনা আঁটার ক্ষেত্রেও হয়ে দাঁড়িয়েছে বাধার ন্যায়।
ওপেনিং ও টপ অর্ডার দুর্বলতা
বাংলাদেশের ওপেনিংয়ে সমস্যা বর্তমানে সম্ভবত তিন ফরম্যাটেই আছে। সাদমান ইসলাম টেকনিক্যালি মোটামুটি হলেও কিন্তু তার শটের সীমাবদ্ধতা যে আছে এটা বোধহয় তিনিও অস্বীকার করবেন না। আর সাইফ হাসানের টেকনিক বা সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেছে এর মধ্যেই। চোখের রেখার নিচে ব্যাট রেখে ডিফেন্ড করা বা এক সমতলে চোখ, ব্যাটের অবস্থানের বিষয়টা সাইফের ব্যাটিংয়ে দৃষ্টিকটুভাবেই অনুপস্থিত। তবে হেড পজিশনিংয়ের দুর্বলতা অনেকেই পুষিয়ে দেন হ্যান্ড-আই কোঅর্ডিনেশন দিয়ে। সেটাও সাইফের ব্যাটিংয়ে এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি। শরীর থেকে অনেক বাইরে যেভাবে তিনি ড্রাইভ খেলেন তাতে আর যাই হোক শাহীন শাহ আফ্রিদির মত ভেতরে বল ঢোকানো বাঁহাতি পেসারকে মোকাবেলা করা কঠিন। তবে সাইফ দুই ইনিংসেই আফ্রিদির কাছে কাবু হয়েছেন বাউন্সারে। খাটো লেংথ এমনকি গুড লেংথেও বল পড়লে তিনি যেভাবে ব্যাকফুটে চলে যান তা যেন পাকিস্তানিদের এক প্রকার বার্তাই দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশের টপ অর্ডারের বাউন্সার ভীতি নিয়ে। মাহমুদুল হাসান জয়কে ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবে নিয়েছিল বাংলাদেশ। মিরপুরে সাইফের জায়গায় তার অভিষেক হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। প্রশ্ন উঠতে পারে কোয়ালিটি পেসের বিপরীতে নাজমুল হোসেন শান্ত এমনকি অধিনায়ক মুমিনুল হকের টেকনিক নিয়েও।
রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব
১২ রানে থাকার সময় আব্দুল্লাহ শফিক প্রথম ইনিংসে ফিরতে পারতেন যদি মুমিনুল হক রিভিউ নিতেন। তবে যদি-কিন্তুর আলাপ এখন কিছুটা হলেও অবান্তর। এমনকি এই ক্ষেত্রে মুমিনুলের ঘাড়েও পুরো দোষ চাপানোটা কিছুটা অন্যায় হয়ে যায়। বোলার বা উইকেটকিপারও যে সেই অর্থে আগ্রহ দেখাননি। যেখানে মুমিনুলের অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায় তা হলও ৮ উইকেট পড়ার পর দুর্দান্ত বল করে যাওয়া তাইজুলকে আক্রমণাত্মক ফিল্ডিংয়ের সহায়তা না দেওয়া। আর্ম বল দারুণভাবে ব্যবহার করা তাইজুল ব্যাট প্যাডের জন্য সেভাবে সহায়তা পাননি ফিল্ডিং থেকে। বেশিরভাগ সময়ই একজন স্লিপ, একজন শর্ট লেগ নিয়েই বল করতে হয়েছে তাকে; মাঝেমধ্যে পেয়েছেন লেগ স্লিপ। উইকেটের আশেপাশে ফিল্ডার রেখে টেইল এন্ডারদের মনে ভীতি সঞ্চার করা, এমনকি সিঙ্গেল বের করতেও ফাহিম আশরাফকে দুবার ভাবতে বাধ্য করার মত ফিল্ডিং মুমিনুল সাজাতে পারেননি।
প্রয়োগে গোলমাল নাকি সামর্থ্যের অভাব?
ব্যাটিংয়ে সেশনমাফিক পরিকল্পনা ও প্রয়োগের অভাব আরও একবার ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে। তৃতীয় সেশনে বাংলাদেশ যে ২৫ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে বসেছিল সেটাই এক অর্থে ম্যাচ থেকে তাদের ছিটকে দিয়েছে। সকালের সেশনে ব্যাট করা মোটেও সহজ কাজ নয়। তাই সকালটা যদি আপনি শুরুই করেন ৩০+ রান নিয়ে, হাতে ৬ উইকেট নিয়ে তখন আপনি এমনিই ব্যাকফুটে চলে যাবেন। মুশফিক হয়ত অন্য কোনও দিনে হাসান আলীর বলটা ঠিকই খেলতেন। হাসান আলীর বল ভেতরে ঢুকেছিল সামান্য; বলের মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তবে বলের লেংথ যে মুশফিক বিচার করতে পারেননি ঠিকঠাক সেটাও অস্বীকার করার উপায় নেই। ইনিংস মেরামতের চাপ মাথায় না থাকলে হয়ত সেটা হত না।
মুশফিকের ডিসমিসালে অনেক যদি-কিন্তুর ব্যাপার থাকলেও নুরুল হাসান সোহানের বেলায় সেই চিন্তার সুযোগ নেই। টেস্টে সোহানের এই শট যে ক্ষমার অযোগ্য তা তো ম্যাচের পর কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর উক্তিতেও স্পষ্ট। সত্যি কথা বলতে আগের দিন বিকেলে বাংলাদেশ যে চার উইকেট হারাল তাতে শাহীন আফ্রিদির যতটা না কৃতিত্ব তার চেয়ে বেশি অবদান বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের দুর্বল টেকনিক ও মানসিকতার।