আজাজ প্যাটেল: মুম্বাইয়ের ছেলের চক্রপূরণ
৪ ডিসেম্বর, ২০২১, ওয়াঙ্খেড়ে স্টেডিয়াম। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নামা ভারত ততক্ষণে খেলে ফেলেছে ১০৯ ওভার। ১১০তম ওভার বল করতে আসলেন এই মুম্বাইয়ের মাটিতেই জন্ম নেওয়া নিউজিল্যান্ডের আজাজ পাটেল। ভারতের স্কোরবোর্ডে নেই ৮টি উইকেট, সৌজন্য: আজাজ পাটেল। একাই ৮ উইকেট নিয়ে ভারতের মাটিতে কোনও বিদেশি বোলারের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ ৮ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড স্পর্শ করে ফেলেছেন। কিন্তু পুরো নিউজিল্যান্ড দলের পাশাপাশি আজাজ নিজেও তখন এক স্বপ্নে বিভোর: ইনিংসে ১০ উইকেট।
প্রথম বলেই তাকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অফে ক্যাচ দিয়ে ফিরলেন জয়ন্ত যাদব, চলে গেলেন রেকর্ড থেকে হাত ছোঁয়া দূরত্বে। উইকেটে এসেই মোহাম্মদ সিরাজ মেরে বসলেন চার। তবে টেইল এন্ডার ব্যাট চালাচ্ছে, বোলারের জন্য তো সেটা সুসংবাদ বটে, তাও আবার স্পিনারের জন্য। আজাজ তাই আবারও ভাসিয়ে দিলেন বল। পায়ের কাছে বল পেয়েই দিগ্বিদিকশূন্য স্লগ করলেন সিরাজ; টপ পড়তে ব্যর্থ সিরাজ বল তুলে দিলেন সোজা আকাশে। কানপুরে প্রথম টেস্ট আজাজকে সঙ্গী করে যেই রচীন রবীন্দ্র ম্যাচ বাঁচিয়েছিলেন সেই রবীন্দ্রর হাত বরাবর সোজা নেমে আসছে বল; কানপুরে যেই স্নায়ুচাপ অনুভব করেননি সেটাও বোধহয় কিছুটা পেয়ে বসেছিল তাকে। কানপুরে দাঁতে চাত চেপে লড়াই করার মানসিক দৃঢ়তা যার আছে, মিলিসেকেন্ডের সেই চাপ তো তার কাছে নস্যি। রবীন্দ্র তাই কোনও ভুল করলেন না; আর আজাজের হাত ধরে রচিত হল ইতিহাস। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ইতিহাসের মাত্র ৩য় বোলার হিসেবে এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার অসামান্য কীর্তি গড়লেন আজাজ। এমন এক কীর্তি যাতে প্রতিপক্ষের ড্রেসিং রুমও দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন; অধিনায়ক ভিরাট কোহলি নিজে কিউই ড্রেসিংরুমে যেয়ে অভিনন্দন জানিয়ে এলেন আরও একবার। তবে এক দিকে দিয়ে আজাজের কীর্তি নজিরবিহীন। জিম লেকার, অনিল কুম্বলেরা এই কীর্তি গড়েছিলেন ঘরের মাটিতে। আজাজই প্রথম তার এই অর্জন এলো বিদেশের মাটিতে, তাও স্পিনে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে।
****************
ভারতের মাটিতে অনেক কিছুর স্বপ্নই শৈশবে দেখেছিলেন আজাজ, তবে ভারতের বিপক্ষে? সেই স্বপ্ন দেখতে তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ। এমনকি ক্রিকেট মাঠে কিছু করার কথা ঘুণাক্ষরেও শৈশবে ভাবেননি। মুম্বাইয়ে তাদের তখন একরকম দিন-আনি-দিন-খাই অবস্থা। বাবা ইউনুস পাটেল তখন পরিবারের রুটিরুজির একমাত্র ধারক ও বাহক; পরিবার সামলাতে তার তখন গলদঘর্ম অবস্থা। পরিবারের কিছু মানুষ তখন থাকেন অকল্যান্ডে। মুম্বাইয়ের দুর্বিষহ হয়ে ওঠা সেই জীবনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ইউনুস, পথ ধরলেন অকল্যান্ডের।
১৯৯৬ সালে সপরিবারে অকল্যান্ডে এসে ইউনুস কাজ শুরু করলেন রেফ্রিজারেটর মেকানিক হিসেবে, খুললেন ছোট খুপড়ির মত এক দোকান। বাবার এই কষ্ট দেখেই আজাজও ঠিক করলেন পড়াশোনাকেই ধ্যানজ্ঞ্যান বানানোর। স্কুলে তার তেমন নতুন বন্ধুবান্ধব হয়নি, তবে তা নিয়ে তার তেমন একটা বিকার নেই। বইয়ের পাতায় বুঁদ হয়েই দিন কাটাতে থাকলেন তিনি।
বইয়েই মুখ গুজে থাকা আজাজকে নিয়ে অবশ্য ভিন্ন পরিকল্পনা ছিল ফুপির। নিজের ছেলেকে তখন তিনি ভর্তি করবেন ক্রিকেট ক্লাবে, সাথে টানলেন আজাজকেও; ইউনুসও বাঁধ সাধলেন না। মুম্বাইয়ের গলিতে বন্ধুদের সাথে ক্রিকেট খেলতেন; সমবয়সীদের চেয়ে কিছুটা লম্বা হওয়ায় স্কুলে করতেন ফাস্ট বোলিং। আজাজ তাই ভাবলেন নিজের ফাস্ট বোলার সত্ত্বাকে বাজিয়ে দেখার। ক্লাবে নজর কাড়তে সময় নেননি তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় কলেজ ক্রিকেটেও কয়েক বছর পরে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নিয়মিত হলেন তিনি। আভোনডেল কলেজের লিড পেসার হয়ে গেলেন তিনি; দারুণ লাইন লেংথ আর স্বভাবজাত সুইংয়ে প্রতিপক্ষ দলগুলোর চিন্তার খোরাক যোগালেন। সতীর্থ মার্টিন গাপটিল আর জিত রাভাল তো রীতিমত মুগ্ধ আজাজে।
গাপটিলরা এরপর নিউজিল্যান্ড বয়সভিত্তিক দলের জন্য ডাক পেলেও অনূর্ধ্ব-১৯ পরিকল্পনার মধ্যে আসেননি আজাজ। ক্রিকেট নিয়েই স্বপ্ন দেখতে শুরু করা আজাজের তখন মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। ভাবতে শুরু করলেন, আদৌতে কি ঠিক পথে আগাচ্ছেন তিনি? ভাবলেন অকল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ এর তৎকালীন কোচ সাবেক কিউই স্পিনার দীপক পাটেলের সাথে খোলামেলা কথা বলবেন। ততদিনে বাড়ন্ত শরীর আর নেই বাড়ন্ত, আটকে ছিলেন ঐ এক উচ্চতায়। উচ্চতা আর নেটে মাঝেমদ্ধে স্পিন করার কথা শুনে দীপক তাকে বললেন কয়েকটা বল করে দেখাতে। যেই বলা সেই কাজ; আজাজ শুরু করলেন হাত ঘোরাতে। প্রথম স্পিনার হিসেবে বিশ্বকাপে বোলিং ওপেন করা জহুরী দীপকের চোখও হীরা চিনতে ভুল করেননি। তবে আজাজ যে তখনও সামান্যই কয়লার দলা, হীরা হতে পাড়ি দিতে হবে বহুদুর-সেটাও দীপক তাকে জানালেন সোজাসাপ্টা।
****************
কারিয়ায়ের এই পর্যায়ে এসে পেসার থেকে স্পিনার হওয়ার কথা হয়ত বেশিরভাগই ভাববেন না। নিজেকে নতুন করে ঢেলে সাজানর সেই সাহসটাই যে তেমন কারও হয়ে উঠবে না। তবে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া যে আজাজকে ভাবায় না; তিনিও জানিয়ে দিলেন তিনি প্রস্তুত। দিনের পর দিন হাত ঘোরাতে লাগলেন নেটে। এতোটাই একাগ্র ছিলেন নেটে যে দীপকও মাঝেমদ্ধে ক্লান্ত হয়ে উঠত, বলে উথত-এবার ক্ষান্ত দে, বাবা! তবে আজাজ যে ঠিক করেছেন দিনে অন্তত ১০০০ ওভার করবেনই তিনি; এর আগে মাঠ ছেড়ে যাবেন না।
অক্লেশে হাত ঘোরাতে থাকা আজাজ স্পিনার হিসেবে হয়ে উঠলেন আরও পরিশীলিত। তবে জীবন যার পরীক্ষা নিয়েই চলেছে সেই শুরু থেকে তার কি আর এতো সহজেই সব পাওয়া হয়? অকল্যান্ডের দলের স্পিন বিভাগ তখন একেবারে সাজানো। সেই লাইন ঠেলে নতুন স্পিনারের দলে জায়গা করে নেওয়া প্রায় দুঃসাধ্য। দীপক তখন তাকে পরামর্শ দিলেন নেপিয়ার দলে চেষ্টা করার। কোনও দিক না ভাবেই ৪০০ কিমি. পথ পাড়ি দিয়ে ঠিকই নেপিয়ের দলে খেলতে চলে এলেন তিনি। তবে পরিবার ছেড়ে থাকা যে কোনও দিন হয়নি তার। পরিবার, ঘরের জন্য তার মন কাঁদে; তবে একবার যখন চলেই এসেছেন হাল ছাড়বেন না বলেই সিদ্ধান্ত নিলেন।
টারাডেল ক্লাবে এসে আবারও শুরু হল সেই নতুন জায়গায় মানিয়ে নেওয়ার যুদ্ধ। বাগ্মী হিসেবে তার নামডাক নেই; নতুন জায়গায় বন্ধু বানাতে তাই বেশ বেগ পেতে হয় তাকে। তবে সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টসের হয়ে খেলতে হলে টারাডেলে নিজের এই দিকটা তাকে হয়ত ঢেলে সাজাতে হবে, ভাবলেন তিনি। নচেৎ মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়বেন, খেলায়ও হয়ত পড়বে তার প্রভাব। কিন্তু তাকে সেটা নিয়ে বেশি চিন্তার সুযোগ দেননি টারাডেলের সতীর্থরা। বুকে আগলে নিয়ে অধিনায়ক লুক কেনওয়ার্দি তো তাকে ঘরের অভাবটা টেরই পেতে দিলেন না। আজাজ সতীর্থদের এমন ভালবাসায় গলে গেলেন; মাঠেও দিতে শুরু করলেন তার প্রতিদান। প্রতি ম্যাচেই গড়ে ৩টার বেশি করে উইকেট থাকত তার।
****************
ক্লাব ক্রিকেটে তখন হাঁকডাক শুরু হয়ে গেল আজাজ পাটেল নামে এক বাঁহাতি স্পিনারকে নিয়ে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১২ সালের ডিসেম্বরে সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টসের কাছ থেকে পেলেন সেই বহুল প্রতীক্ষিত ডাক। তীর্থের কাকের মত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলার যেই সুযোগ খুঁজছিলেন তার দেখা মেলার পর আর পেছন ফিরে তাকাননি। প্লাঙ্কেট শিল্ডের শীর্ষ উইকেট শিকারিদের তালিকার শুরুর দিকেই থাকল তার নাম; প্রথম তিন মৌসুমেই ছিলেন শীর্ষ পাঁচের ভেতর। ২০১৫-১৬ মৌসুমে নিজেকে নিয়ে গেলেন আরও এক ধাপ ওপরে। যেই অকল্যান্ডের সমৃদ্ধ স্পিন ভান্ডারের জন্য বাড়ি ছেড়ে এসেছিলেন নেপিয়ারে, সেই অকল্যান্ডই তখন শিল্ড চ্যাম্পিয়ন। কি নিয়তি! প্রথম শিল্ড জয়ের জন্য নেপিয়ারে শেষ রাউন্ডের অঘোষিত ফাইনালে মুখোমুখি হতে হল সেই অকল্যান্ডেরই, যেখানে ছিলেন তার কলেজ ক্রিকেট সতীর্থ জিত রাভাল। প্রথম ইনিংসে রাভাল করলেন সেঞ্চুরিও। তা সত্ত্বেও চ্যাম্পিয়ন অকল্যান্ডকে থমকে দিয়ে সেবার শিরোপা ঘরে তুললো সেন্ট্রাল ডিস্ট্রিক্টসই; আজাজ দুই ইনিংসে নিলেন ৩ উইকেট। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে অবশ্য নিজেই ছিলেন অগ্রগামী ভুমিকায়। ৮ ম্যাচে ৪৯ উইকেট নিয়ে তিনি হলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি।
সেই মৌসুমের পর জাতীয় দলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন। তবে নিউজিল্যান্ডের তখন স্পেশালিস্ট স্পিনারের চেয়ে স্পিনিং অলরাউন্ডারের দিকেই ছিল বেশি নজর। ড্যানিয়েল ভেট্টোরি পরবর্তী যুগে তারা দেখা পেলেন সেরকমই একজনের-মিচেল স্যান্টনার। বাঁহাতি স্পিনের পাশাপাশি লোয়ার মিডল অর্ডারে বাঁহাতি ব্যাটিং, সাথে ছেলে আবার ব্যাটিংয়ের সময় চশমাও পরে! সব দিকেই নিউজিল্যান্ড তার মাঝে পেলো ভেট্টোরির ছায়া। জীবনটা যার কাছে কণ্টকপূর্ণ এক পথ সেই আজাজের কি আর এতো সহজে স্বপ্নপূরণ হয়? হলও না তাই সেবারও।
তাতে কী! থেমে থাকার পাত্রও যে তিনি নন। নতুন উদ্যমে নেমে পড়লেন পুরনো যুদ্ধে। খেলার প্রতি সেই ঝোঁকে পড়েনি বিন্দুমাত্র ভাঁটা; চোখেমুখে সেই একাগ্র অনুশীলনের স্পৃহা, সেই মাঠে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার অদম্য ইচ্ছা। আজাজ প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের পাশাপাশি আবার খেলতে শুরু করলেন ক্লাব ক্রিকেট, সেই টারাডেলের হয়ে। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা এক বোলার এই ক্লাব ক্রিকেটে এসেও একইভাবে অবিরাম হাত ঘোরাচ্ছেন, নেটে একের পর এক বল করেই যাচ্ছেন। বড়সড় ক্রিকেটার হয়ে যাওয়ার পরেও সেই পুরনো আজাজকে দেখে তার সেই পুরনো অধিনায়ক কেনওয়ার্দি তো অবাক। ক্লাব ক্রিকেটে কোনও প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট খেলা খেলোয়াড়কে যে এতোটা মন দিতে দেখেননি কখনও।
****************
নিউজিল্যান্ডের হয়ে ডাক পাই বা না পাই, আমার কাজ আমি করে যাব- সেই মন্ত্রেই চলতে থাকলেন আজাজ। কঠোর অধ্যবসায়ের ফল তো এক সময় পেতেই হয়; তবে যখন, যেভাবে পেলেন সেটা ছিল অপ্রত্যাশিত। আজাজ তখন অকল্যান্ডে, পরিবারের কাছে উৎফুল্ল মনে ফিরে এসেছেন ছুটি উদযাপনে। ২০১৮ সালের সেই পড়ন্ত বিকেলে পরিবারের প্রায় ৩০ জন মিলে খেতে বসেছেন, এমন সময় এল কল। ফোনের ওপাশ থেকে যা শুনলেন তা শুনে কিছুক্ষণ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন, শান্তশিষ্টভাবেই আলাপ শেষ করলেন। ধাতস্থ হতে কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে খাবার টেবিলে ফিরে এসে মুখ খুললেন- পাকিস্তান সফরের দলে ডাক পেয়েছি আমি। পরিবারের বাকিদের আর পায় কে! আজাজের মত অত ঠাণ্ডা থাকার বালাই নেই তাদের। বাবা ইউনুস, মা শাহনাজ, দুই বোন সানা ও তানজিল আর বউ নিলোফার গোল হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তারস্বরে চিৎকার করতে শুরু করলেন। কী ছেড়ে কী করবেন সেই হুঁশ পাচ্ছিলেন না তারা।
আজাজের উদযাপন কেন পরিমিত ছিল তা তো আর বলে দিতে হবে না। তার কাছে তো সেটা কেবলই নতুন এক যাত্রার শুরু। আরও অনেক কিছু করে দেখানোর প্রত্যয় নিয়েই নতুন স্বপ্ন বুনতে শুরু করেছেন তিনি। অবশেষে সেই বহুল আরাধ্য কালো ক্যাপ মাথায় চড়ালেন নভেম্বরের ১৬ তারিখে। তবে পাকিস্তানের দুর্গ আরব আমিরাতে যে জয় দুরুহ সেটাও জানেন তিনি। আবু ধাবিতে প্রথম টেস্টেই সেটার প্রমাণ পেতে থাকলেন হাড়েহাড়ে। প্রথম ইনিংসে পেলেন ২ উইকেট। তবে পাকিস্তানের জয়ের জন্য শেষ ইনিংসে প্রয়োজন মোটে ১৭৬ রান। আযহার আলী আর আসাদ শফিক জুটি সহজ এক জয়ের দিকেই নিয়ে যাচ্ছেন পাকিস্তানকে। হাতে আছে ৭ উইকেট, প্রয়োজন মোটে ৪৬ রান। নিল ওয়্যাগনার যখন শফিককে ফেরালেন তখনও পাকিস্তানের জয় ছাড়া অন্য কিছু কেউই ভাবছিল না। দৃশ্যপটে তখনি প্রত্যাবর্তন ঘটল আজাজের, একে একে তুলে নিলেন ৪ উইকেট, পূর্ণ করলেন নিজের প্রথম ৫ উইকেট। নিশ্চিত হারের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিউজিল্যান্ড ম্যাচ জিতে গেল ৪ রানে! আর অভিষেকেই ম্যাচে ৭ উইকেট নিয়ে আজাজ হলেন ম্যাচ সেরা।
স্বপ্নের মত যেই শুরু হয়েছিল সেই সিরিজে নিয়েছিলেন মোট ১৩ উইকেট, নিউজিল্যান্ড জয় করেছিল পাকিস্তানের দুর্গ, পেয়েছিল ২-১ ব্যবধানের সিরিজ জয়। পরের শ্রীলঙ্কা সফরেও একটি ৫-উইকেট সহ পেলেন ৯ উইকেট। তবে ঘরের মাঠে ফিরতেই এক স্পিনারের মন্ত্রে ফিরে যাওয়া নিউজিল্যান্ডের দল থেকে বাদ পড়লেন আজাজ। নিউজিল্যান্ডের সবুজ পিচে কালেভদ্রেই মিলল তার ডাক। তবে হাল ছাড়ার পাত্র তো তিনি নন।
****************
হাল তিনি ছাড়েননি; সাফল্যও খুঁজে নিয়েছে তাকে। শৈশবে ওয়াঙ্খেড়েতে খেলা দেখতে গিয়েছেন; একবার ছুটিতে ভারত গিয়ে মুম্বাই ইন্ডিয়ানসের নেটে বলও করেছেন। ভারত সফরের দলে যখন ডাক পেলেন আর দেখলেন সেই জন্ম তীর্থেই ফিরতে যাচ্ছেন তিনি, এবার লাল বল হাতে- তখনই বোধহয় বিশেষ কিছু করার অঙ্গীকার করেছিলেন নিজের কাছেই। ওয়াঙ্খেড়ের পিচে আরেক স্পিনার উইল সমারভিলকে রীতিমত আক্রমণ করছেন শুবমন গিল ও মায়াঙ্ক আগারওয়াল। সেই একই পিচে আজাজ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বোলার রুপেই আবির্ভূত হলেন। ৮০ রানের ওপেনিং জুটি যখন ভাঙলেন তখনই তার উদযাপনে যেন ঠিকরে পড়ছিল সেই অঙ্গীকার। জীবন যুদ্ধ জয়ের যে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে একের পর এক লক্ষ্য পূর্ণ করেছেন, সেটা করে দেখালেন আরও একবার। তবে করলেন এমন এক কাজ যেটা যে কারও মতেই একজন বোলারের জন্য সবচেয়ে কঠিন কাজ। ১০টির ১০টি উইকেট যখন পেলেন আজাজ তখনও তিনি তার এই অর্জনের পরিমাপটা হয়ত নিজেও করতে পারেননি। চারপাশ থেকে যখন সব কিংবদন্তিরা শুভেচ্ছা বার্তা পাঠানো শুরু করল; ১০-উইকেট ক্লাবে অন্তর্ভুক্তির জন্য অভিবাদন জানানো কুম্বলের স্বাগতম বার্তা যখন মুঠোফোনে দেখলেন তখন কাটল তার মোহ। বুঝলেন করে ফেলেছেন এমন কিছু যা একবিংশ শতাব্দীর বোলাররা স্বপ্নেও আজকাল ভাবে না। বিশাল ব্যবধানে নিউজিল্যান্ড হেরে গেলেও টেস্ট শেষেও তাই চলল আজাজ-বন্দনা, মুম্বাই টেস্ট হয়ে থাকল আজাজ “পারফেক্ট টেন ম্যান” পাটেলের হয়েই।
ইতিহাসের পাতায় নিজের নাম সিলগালা করে রাখলেও নিউজিল্যান্ড দলে জায়গাটা পোক্ত হয়নি হয়ত। নিউজিল্যান্ডের কেন্দ্রীয় চুক্তিতে নেই তিনি। নিউজিল্যান্ডের সেসব সবুজ পিচে ফিরে হয়ত আবারও দল থেকে বাদ পড়বেন। তবে আজাজ তো হার মানার পাত্র নন। এই ৩৩ বছর বয়সে ঠিকই পেয়েছেন অধ্যবসায়ের ফল; তবে তিনি পা রাখছেন মাটিতেই। এত অভিনন্দনের জোয়ারেও তিনি বিনম্র; মুখের সেই স্মিত হাসি নিয়েই মাথায় হয়ত আঁটছেন নতুন কোনও পরিকল্পনা, নিজেকে বেঁধে দিচ্ছেন নতুন কোনও লক্ষ্য। হার মানতে তিনি শেখেননি, হাল তিনি ছাড়বেনও না। ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, তবে আজাজ নেটে ফিরবেন সেই চিরচেনা একাগ্রতা নিয়েই। নিউজিল্যান্ডকে আরও একটি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতাতে ঢেলে দেবেন সামর্থ্যের সবটুকুই, বুড়িয়ে যেতে বসা শরীরের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও। কে জানে, হয়ত পেয়ে যাবেন কেন্দ্রীয় চুক্তিও।