• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    চেলসি-লিভারপুলের হেভি মেটাল তাণ্ডব শেষে বিজয়ী পেপ গার্দিওলা

    চেলসি-লিভারপুলের হেভি মেটাল তাণ্ডব শেষে বিজয়ী পেপ গার্দিওলা    

    যারা নিয়মিত আন্ডারগ্রাউন্ড কনসার্টে যান, তাদের জন্য এটা এক পরিচিত অভিজ্ঞতা- স্টেইজের সামনে দু’দিক ফাঁকা করে গানের তালে মশপিট। ইন্সট্রুমেন্টের ঝঙ্কারে সে দৃশ্য যেমন প্রলয়ংকারী, শ্বাসরুদ্ধকর- ঠিক তেমনি স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে চেলসি-লিভারপুলের ম্যাচটাও হলো সেরকম ঝড়ো গতির, কাউন্টার প্রেসিংকে কাউন্টার করে কাউন্টার অ্যাটাক- সে উত্তেজনা ছিটকে গিয়ে পড়ল যেন পুরো মাঠ ছাড়িয়ে আরো দূরে। এমন উপভোগ্য হেভি মেটাল ফুটবলের ফলাফলে অবশ্য খুশি হতে পারেনি কোন শিবিরই। ২-২ গোলের ড্রতে উল্টো নিজ বাসায় বসে স্বস্তির হাসি হাসছেন যেন ম্যানচেস্টার সিটির পেপ গার্দিওলা। আখেরে সবচেয়ে লাভবান যে হলেন তিনিই।

    চেলসির জন্য এই ম্যাচটা শুধু লিগের শিরোপা লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য ছিল না। একজন খেলোয়াড়ের ‘ইগো’র চাইতে যে ক্লাব বড়- সেটা প্রমাণে বদ্ধ পরিকর ছিলেন টমাস টুখেল ও তার শিষ্যরা। কোভিডের কারণে লিভারপুলের ডাগআউটে ছিলেন না ইউর্গেন ক্লপ। তাই জার্মান ফুটবল দর্শনের দুই ‘মাস্টার’-এর ডাগআউটের লড়াইটা ছিল অনুপস্থিত। 

    ম্যাচে যে তাণ্ডবের ঝড়ো হাওয়া বইবে তা টের পাওয়া গেল ঠিক ১৬ সেকেন্ডের মাথায়; হাই এয়ার চ্যালেঞ্জে আজপিলিকুয়েতাকে ফাউল করে হলুদ কার্ড দেখেন সাদিও মানে। ম্যাচের প্রথমার্ধে দুই দলই খেলেছে বিপজ্জনক হাই ব্যাকলাইন নিয়ে- এতটাই বিপজ্জনক যে কোন দলই বল হারানোর পর ডিফেন্সে তাদের স্বাভাবিক পজিশনে ফিরতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছিলেন। 

    কাউন্টার প্রেস আর ডিরেক্ট লং বলের সুযোগে ঠিক পাঁচ মিনিটের ব্যবধানে দুই অর্ধে এলো প্রায় কাছাকাছি দুটি সুযোগ- তবে এর ফলাফল হলো ভিন্ন। প্রথম সুযোগটা পেয়েছিলেন পুলিসিক। আলেক্সান্ডার আরনল্ডকে দারুণভাবে পেছন থেকে প্রেশারে রেখেছিলেন কাই হ্যাভার্টজ, যাকে নামানো হয়েছে বিস্ফোরক এক সাক্ষাৎকার দেওয়া লুকাকুর পরিবর্তে। বল ক্লিয়ার করতে গেলে আলেক্সান্ডার আরনল্ডের বল ইন্টারসেপ্ট করে সে বল চলে আসে পুলিসিকের পায়ে। একদম ফাঁকা বক্সে লিভারপুলের ডেপুটি গোলকিপার কুইমিন কেলেহার ছাড়া আর কেউই ছিলেন না। প্রায় পরাস্তই করে ফেলে গোল শট নিতে যাচ্ছিলেন তিনি; শেষ পর্যন্ত কেলেহারের গায়ে লেগে কোন ফল হলো না।

    ঠিক পাঁচ মিনিট পর জোটার দেওয়া বাঁকানো এক লো ক্রস থেকে বল চলে আসে ট্রেভর চালোবাহ’র কাছে। চাইলেই পা দিয়ে ধীরে সুস্থে বলের দখল নিয়ে ক্লিয়ার করতে পারতেন; কীংবা পাসিং লেন দেখে পাঠিয়ে দিতে পারতেন সামনে থাকা মার্কোস আলোনসোর কাছে। সিদ্ধান্ত নিলেন মাথা দিয়ে বল ক্লিয়ার করার! এমন সিদ্ধান্ত যে চরম আত্মঘাতী ছিল তা প্রমাণ করে ছাড়লেন চালোবাহর ছায়া ঘেঁষে দাঁড়ানো সাদিও মানে। ম্যাচের ১৬ সেকেন্ডে হলুদ কার্ড দেখা মানে ড্রিবল করে পার করে গেলেন স্বদেশী এদুয়া মেন্দিকে; তার নেওয়া গোলে শট কোন চেলসি ডিফেন্ডার দৌড়ে এসেও ঠেকাতে পারেনি। স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে প্রথম আঘাতটা তাই এলো লিভারপুলের কাছ থেকে। 

    এমন নয় যে চেলসি প্রথমার্ধে খারাপ খেলেছে। বরং মাঝমাঠে দখলটা তাদেরই ছিল বেশি; লিভারপুলেরই নিজ ছন্দে খেলতে অসুবিধা হচ্ছিল। ম্যাচের ২৫ মিনিটের সময় থেকে ঘুরতে শুরু করে মোড়; বল পজেশনে নিজেদের কর্তৃত্র নিতে শুরু করে অল রেডরা। আর ঠিক এমনিই এক সময় রাইট ফ্ল্যাংকে স্পেস ক্রিয়েট করে দৌড় শুরু করেন মো সালাহ। আলেক্সান্ডার আরনল্ডও সেই মুভমেন্টটা ধরতে পেরেছিলেন; লব করে বল যোগান দেন সালাহকে। সালাহ’র মার্কার আলোনসো কোনভাবেই পারলেন না তাকে ঠেকাতে। বাঁ পায়ের শটে মেন্দিকে পরাস্ত করে ২-০ গোলে লিভারপুলকে এগিয়ে দেন সালাহ। সেই সঙ্গে পূরণ করেন প্রিমিয়ার লিগে তার ১৫০ গোলের মাইলফলক; যার মধ্যে ১৪৮টি লিভারপুলের জার্সি গায়ে হলেও বাকি দুটো এসেছিল চেলসির জার্সিতে।

    ম্যাচটা এখানেই শেষ হয়ে যেতে পারত। চেলসির খেলোয়াড়দের মাঝেও দেখা যাচ্ছিল হতাশার প্রতিচ্ছবি। লিভারপুলের ঝড়ো তাণ্ডবে এলোমেলো হয়ে যাওয়া চেলসি যেন প্রাণ ফিরে পেল ৪০ মিনিটের মাথায়। বক্সের ডান কোণা থেকে মার্কোস আলোনসোর ফ্রি কিক সরাসরি ডিফ্লেক্ট করে ক্লিয়ার করেন কেলেহার। কিন্তু উঁচুতে উঠে যাওয়া বল নেমে মাটিতে পড়ার আগেই এক অসাধারণ শট করে বল জালে পাঠিয়ে দেন চেলসির মাতেও কোভাচিচ। প্রিমিয়ার লিগ ইতিহাসে এই গোল নিঃসন্দেহে সেরা গোলের তালিকার মধ্যে জায়গা করে নিবে। বাতাসে ভাসমান বলে বুট ছুয়ে যে জ্যামিতিক কোণ থেকে গোলটা হয়েছে- এমন দর্শনে বাঁধভাঙ্গা উল্লাসে ফেটে পড়ে পুরো স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ।

    আর ঠিক পাঁচ মিনিটের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো লিভারপুলের মাথায়। বহু কষ্টে গড়া গোলের লিডটাও ধরে রাখা গেলনা লিভারপুলের ডিফেন্সিভ শেইপ নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে। সে সুযোগ নিয়ে লেফট হাফ স্পেইস থেকে পুলিসিকের কাছে দারুণ এক বল পাঠান এনগলো কানতে। সামনে কোন কাভার না থাকায় ওয়ান-টু-ওয়ান পরিস্থিতিতে এবার কেলেহারকে হারিয়ে ম্যাচে সমতা ফেরান পুলিসিক।

    স্কোরলাইনটা ৩-২ ও হতে পারত যদি মেসন মাউন্ট একদম প্রথমার্ধের শেষে এমন মিসটা না করতেন। দ্বিতীয়ার্ধে দুই দল থেকে এমন তাণ্ডবীয় ফুটবল আশা করাটাই স্বাভাবিক;দুই দলই চাইবে সিটির সঙ্গে নিজেদের দুরত্বটা কমাতে। কিন্তু বাস্তবে অতটাও হয়নি।

    দ্বিতীয়ার্ধে দুই দলে হয়ে উঠে সাবধানী; অন্তত ডিফেন্সিভ শেইপ নষ্ট হয়ে মাঠে ফাঁকা জায়গা যেন তৈরি না হয় সে ব্যাপারে দুই দলই ছিল সতর্ক। যদিও হাই ব্যাকলাইনের সুযোগ নিয়ে প্রায় গোলটা পেয়েই গেছিলেন সালাহ; মেন্দি গোল লাইন থেকে বাইরে আছেন টের পেয়ে বল শট নিয়েছিলেন বক্সের অনেক বাইরে থেকে। শেষ পর্যন্ত নিজের জায়গায় ফিরে এসে সেইভ করে চেলসিকে ম্যাচে রেখেছেন তিনি। আবার ঠিক দুই মিনিট পরই মানের এক দারুণ সুযোগ ঠেকিয়ে দিয়েছেন তিনি। আর ঠিক দশ মিনিট পর মার্কোস আলোনসোর একদম ইঞ্চি পরিমাণ দুরত্বের জোরালো শট ক্লিয়ার করেছেন কেলেহার। দুই দল তাদের ট্যাকটিকসে পরিবর্তন আনলেও গোল আর হয়নি। ২-২ তেই শেষ হয়েছে প্রিমিয়ার লিগের আরও একটি চমৎকার দর্শনীয় ম্যাচ।

    দর্শনীয় বা উপভোগ্য যাই-ই হোক না কেন- সেটা শুধুমাত্র নিরপেক্ষদের জন্য প্রযোজ্য। তাই ম্যাচ শেষে নিরাশ হতে হয়েছে দুই দলের খেলোয়াড়-ম্যানেজারদের। যে কোনভাবেই ম্যাচটা জিতলে অন্তত সিটির সঙ্গে পয়েন্ট ব্যবধানটা কমানো যেত। আর তাই দ্বিতীয় স্থান থেকে কমপক্ষে দশ পয়েন্ট লিড নিয়ে চেলসি-লিভারপুল ম্যাচ শেষে শেষ হাসিটা হাসলেন পেপ গার্দিওলাই!