শীতকালীন বাজারসদাই: কার দিকে নজর বেশি? কারা ছাড়বেন ক্লাব?
জানুয়ারি মাস এলেই একত্রিশ দিনের জন্য খুলে যায় শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডো। গ্রীষ্মের মত অতটা জমজমাট না হলেও এই সাময়িক ‘বাজার-সদাই’-এর আকর্ষণটা কোনভাবেই কম নয়। যারা টুইটার নিয়মিত ফলো করে থাকেন, ফ্যাব্রিজিও রোমানো’র ‘হেয়ার উই গো’ কিংবা ডেভিড অরনস্টিনের ‘ট্রান্সফার মেইলবক্স’-এর জন্য তারা রীতিমত নোটিফিকেশন খোলা রেখে বসে থাকেন। জানুয়ারিতে কারা হতে পারেন হট প্রসপেক্ট, কাড়ি কাড়ি অর্থ নিয়ে কারা ওঁত পেতে আছে, আর কারা এই জানুয়ারিতে ছেড়ে যাবেন ক্লাব- এসব নিয়ে প্যাভিলিয়নের আয়োজন- ‘শীতকালীন বাজার-সদাই’
ভ্লাহোভিচ তুমি কার?
শুধু শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোতে নয়, এ বছরের মার্কেটে সবচেয়ে বড় হট কেক প্রসপেক্ট ফিওরেন্তিনার সার্বিয়ান স্ট্রাইকার দুসান ভ্লাহোভিচ। এই মৌসুমে ফিওরেন্তিনার হয়ে করেছেন ১৬ গোল আর দুই অ্যাসিস্ট; সঙ্গে ছুঁয়েছেন এক পঞ্জিকাবর্ষে সিরি আ’তে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ৩৩ গোলের রেকর্ড। তার জন্য টাকার বস্তা নিয়ে বসে আছে ইউরোপের এলিট সব ক্লাব।
তবে বাস্তবতা একটু কঠিন, অন্তত আর্সেনালের জন্য তো বটেই। এই মুহূর্তে অর্থের দিক থেকে ভ্লাহোভিচকে গানারদের দলে ভেড়াতে আর্সেনালই সবচেয়ে এগিয়ে। ডেভিড অরনস্টিন বলছেন, ভ্লাহোভিচকে পেতে আকাশচুম্বী এক ট্রান্সফার ফি প্রস্তাব করা হয়েছে ফিওরেন্তিনাকে। কিন্তু বাধ সেধেছেন খোদ ভ্লাহোভিচ নিজেই, আর তার ব্যক্তিগত এজেন্ট। ক্যারিয়ারের এই মুহূর্তে নর্থ লন্ডনের আর্সেনালে যাবার ইচ্ছা সামান্যই ২১ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকারের। সেক্ষেত্রে ম্যান সিটি, রিয়াল মাদ্রিদ কিংবা জুভেন্টাস হতে পারে তার পরবর্তী ক্লাব- যদিও মাদ্রিদে তার ট্রান্সফারের ক্ষেত্রে অনেক জটিল ‘প্যাঁচ’ আছে।
ফিওরেন্তিনার সঙ্গে তার চুক্তি ২০২৩ গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত। কিন্তু এই সময়ে তাকে বিক্রি করতে পারলে রীতিমত পকেট ফুলেফেপে উঠবে ইতালির এই ক্লাবটির। এরই মধ্যে তার বদলি হিসেবে লিঁলের জোনাথন ইকোনেকে দলে ভিড়িয়েছে তারা। কথা চলতে ক্রিস্তফ পিয়াটেককেও নিয়ে আসার জন্য। তাই সঠিক সময়ে সঠিক মূল্যের জন্যই এখন অপেক্ষা করছে ক্লাবটি, ভ্লাহোভিচও চান এলিট কোন ক্লাবের জার্সি চড়াতে। আর শীতকালীন উইন্ডতে তার ট্রান্সফার সম্ভব না হলেও গ্রীষ্মের বাজারে নতুন কোন ক্লাবের হয়ে খেলবেন এই সার্বিয়ান তা প্রায় নিশ্চিত।
হুলিয়ান আলভারেজ- লাতিন পল্লী ছাড়িয়ে ইউরোপে?
রিভার প্লেটের হয়ে একের পর এক গোল করে শোরগোল ফেলে দিয়েছেন আর্জেন্টিনার প্রিমেরা ডিভিশনের ২১ বছর বয়সী তরুণ হুলিয়ান আলভারেজ। ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর ট্রান্সফার রাডারে একদম পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। ক্ষিপ্র, চতুর মুভমেন্টের কারণে বক্সে কার্যকর এই ফরোয়ার্ডের সাক্ষর পাওয়ার জন্য চেষ্টা করছে রালফ রায়নিকের ম্যান ইউনাইটেড। যদিও শোনা যাচ্ছে, ১৭ মিলিয়ন ইউরোর অফার টেবিলে থাকলেও ওল্ড ট্রাফোর্ডকে আপাতত নিজের গন্তব্য ভাবছেন না আলভারেজ ও তার এজেন্ট। আলভারেজের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদও। এই শীতে না হলেও গ্রীষ্মের মধ্যে বড় অর্থের বিনিময়ে ইউরোপে পাড়ি জমানোটা এখন আলভারেজের জন্য সময়ের ব্যাপার।
কিপ মি ইফ ইউ ক্যান- আন্তোনিও রুডিগার
বয়স আর ফর্ম- সবমিলিয়ে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময় কাটাচ্ছেন চেলসি সেন্টারব্যাক আন্তোনিও রুডিগার। কিন্তু বেতনের হিসেব করলে চেলসিতে সবচেয়ে বেশি আয় করার তালিকায় তার অবস্থানটা বেশ নিচে। তার দাবিটাও সরল- চেলসি তাকে রাখতে চাইলে দিতে হবে সপ্তাহে অন্তত ২ লাখ ৩০ হাজার পাউন্ড বেতন। চেলসি তার সাথে সমঝোতা করতে চেয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার পাউন্ড দিয়ে, তাতে মোটেও রাজি নন জার্মান এই সেন্টারব্যাক।
আর এজন্যই রুডিগারকে সাইন করানোর জন্য উঠে পড়ে লেগেছে ইউরোপের অন্যান্য বড় ক্লাবগুলো। গ্রীষ্মেই ফ্রি এজেন্ট হয়ে যাওয়া রুডিগারকে রিয়াল মাদ্রিদ প্রস্তাব ২ লাখ পাউন্ডের কাছাকাছি বেতন। যদিও ফ্যাব্রিজিও রোমানো জানিয়েছেন, আপাতদৃষ্টিতে রুডিগারের রিয়ালে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। অন্যদিকে রুডিগারের জন্য নতুন ২ লাখ ২০ হাজার পাউন্ড বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতির কথা বলছে প্যারিস সেন্ট জার্মেইন। কিন্তু চেলসিও চাচ্ছে তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই খেলোয়াড়কে রেখে দেওয়ার জন্য। ভালো কোন প্রস্তাব পেলে চেলসিতেই থেকে যাবার আশ্বাস দিয়ে স্কাই স্পোর্টসকে জানিয়েছেন রুডিগার। সবকিছুই এখন তাই নির্ভর করছে ব্লুজদের উপর। রুডিগারকে সন্তুষ্ট করতে পারলে পরের মৌসুমেও চেলসিতেই থাকবেন তিনি, নাহলে তাকে দেখা যাবে ইউরোপের অন্য কোন দলের জার্সিতে।
পিআইএফের ভূঁড়ি ভূঁড়ি টাকা, স্ভেন বটম্যান ও নিউক্যাসলের রেলিগেশন লড়াই
আশ্চর্য শোনালেও সত্যি, ইউরোপের সবচেয়ে ধনী ক্লাব লড়াই করছে রেলিগেশন থেকে বাঁচার জন্য! গত অক্টোবরে নিউক্যাসলের মালিকানা পরিবর্তন হয়ে চলে গিয়েছে সৌদি আরবের পাবলিক ইনভেস্টমেন্ট ফান্ডের কাছে। এরই মধ্যে ১২ মিলিয়ন ইউরোতে তারা সাইন করিয়েছে ইংলিশ রাইটব্যাক কিরান ট্রিপিয়ারকে। কিন্তু পারফরম্যান্সে দুর্দশাগ্রস্থ আর ইনজুরিপ্রবণ এক নিউক্যাসল প্রিমিয়ার লিগে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে যাচ্ছে। স্কোয়াডের প্রায় প্রতিটি জায়গায় প্রয়োজন নতুন খেলোয়াড়; সবার আগে অবশ্য নিজেদের ডিফেন্সটাকেই শক্তপোক্ত করতে চাইছে ম্যাগপাইজরা।
‘এন্টার’ স্ভেন বটম্যান। ২১ বছরের তরুণ ডাচ সেন্টারব্যাক নজর কাড়ছেন তার দীর্ঘদেহী শারীরিক সামর্থ্য আর ব্যাকলাইনে নিজের কার্যকারিতা দিয়ে। এই সেন্টারব্যাককে শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোর ভেতর পেতে কাড়ি কাড়ি অর্থ খরচ করতে প্রস্তুত নিউক্যাসল। এরই মধ্যে লিঁলকে এক দফা প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছে নিউক্যাসল, কিন্তু ডেভিড অরনস্টিন বলছেন, মৌসুমের মাঝে দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রস্তুত নয় ফ্রেঞ্চ ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন লিঁল। কিন্তু এই ট্রান্সফার গুঞ্জনে নতুন হাওয়া দিয়েছেন স্কাই স্পোর্টসের কিথ ডাউনি, বলছেন অর্থনৈতিক সংকটে থাকা লিঁলকে বড়সড় কোন প্রস্তাব দিলে জানুয়ারির মধ্যেই তারা ছেড়ে দিতে পারে বটম্যানকে। বটম্যানও প্রস্তুত আছেন প্রিমিয়ার লিগে নিজেকে ঝালিয়ে দেখার জন্য।
মিডফিল্ডে সমস্যা? ব্রুনো গিমারেস নাকি অরেলিয়ান চুয়ামেনি- কাকে নেবেন?
সেন্ট্রাল মিডফিল্ড সমস্যায় বর্তমানে ভুগছে ইউরোপের বেশিরভাগ এলিট ক্লাব। স্পার্সের এনডম্বেলেকে দিয়ে চলছে না একদমই। ম্যান ইউনাইটেডে দরকার অতি দ্রুত সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে সমাধান। চেলসির সেন্ট্রাল মিডফিল্ড ‘ওয়ার্ল্ড ক্লাস’ হলেও আছে ইনজুরির সমস্যা। লিভারপুলে শেষ হচ্ছে অক্সালেড চেম্বারলেইন-হেন্ডারসনের চুক্তি, আরোও বুড়িয়ে যাচ্ছেন জেমস মিলনার। অন্তত ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে একজন এলিট সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের আগমন এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
অলিম্পিক লিঁওতে এবারের মৌসুম মাতিয়ে রাখছেন তাদের দুই ব্রাজিলিয়ান খেলোয়াড় লুকাস পাকেতা ও ব্রুনো গিমারেস। লুকাস পাকেতাও নিশ্চয়ই এলিট কোন ক্লাবে যাবেন সামনে, তবে এখন অন্যান্য ক্লাবগুলোর নজর পড়েছে ব্রুনো গিমারেসের দিকে। বক্সে প্রগ্রেসিভ পাস আর এক্সপেক্টেড অ্যাসিস্টের অক্ষ বিচারে রীতিমত এলিট লেভেলে পারফরম করছেন তিনি। ছন্নছাড়া ম্যান ইউনাইটেডের সেন্ট্রাল মিডফিল্ড কিংবা স্পার্সের সেন্ট্রাল মিডফিল্ড মজবুত করতে তিনিই হতে পারেন বড় হাতিয়ার। যদিও শোনা যাচ্ছে, উলভসের রুবেন নেভেসের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে ম্যান ইউনাইটেড।
অরেলিয়ান চুয়ামেনিকে গত মৌসুমেই দলে নিয়ে ফেলতে পারত চেলসি, শেষমেশ সেরকম কিছু আর হয়নি। এবার চেলসির সঙ্গে তাকে পাবার প্রতিযোগিতায় নামতে প্রস্তুত রাইভাল ক্লাব লিভারপুলও। সেক্ষেত্রে তরুণ এই ফ্রেঞ্চম্যানকে পাবার জন্য বড় অর্থ খরচের রেসে নামতে হতে পারে দুই দলকে।
পিয়ের এমরিক অবামেয়াংকে নিয়ে কোথায় যাবে আর্সেনাল?
দলীয় শৃংখলা ভঙ্গ করে আর্সেনাল ক্যাপ্টেন থেকে রীতিমত আর্সেনালে অদৃশ্য হয়ে বসেছেন গ্যাবনিজ স্ট্রাইকার পিয়ের এমরিক অবামেয়াং। ম্যানেজার মিকেল আরতেতার পরিকল্পনায় যে তিনি একেবারেই নেই- সেটা ভালোমতই বোঝা যাচ্ছে তার স্কোয়াড সিলেকশন দেখে। এই কয়দিনের মধ্যে তিনি যে ক্লাব ছাড়ছেন তা প্রায় নিশ্চিত। কিন্তু পড়ন্ত বয়সের এই ফরোয়ার্ডকে কে দলে ভেড়াবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
তার জন্য নতুন গন্তব্য হতে পারে নিউক্যাসল ইউনাইটেড। তাদের নিয়মিত স্ট্রাইকার ক্যালাম উইলসন হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরিতে মাঠের বাইরে চলে গেছেন আট সপ্তাহের জন্য। সাময়িক সময়ের জন্য হলেও অবামেয়াংকে দিয়ে নিজেদের ফরোয়ার্ড অপশনে আপাতত সমাধান খুঁজতে পারে নিউক্যাসল বোর্ড। আবার রোমানো ইঙ্গিত দিয়েছেন, সুযোগ পেলে ইতালি পাড়ি দেবার ব্যাপারে ভাবছেন অবামেয়াং। ভালো কোন প্রস্তাব পেলে উপরের সারির কোন ক্লাবের কাছেই তাই অবামেয়াংকে গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে আর্সেনাল।
এমবাপে-হালান্ড ট্রান্সফার সাগা- খেলা তো মোটে শুরু!
না- শীতকালীন ট্রান্সফার উইন্ডোতে তারা কোথাও যাচ্ছেন না। তবে গ্রীষ্মে তাদের সম্ভাব্য গন্তব্য নিয়ে মুখরোচক গুঞ্জন ডালপালা মেলছে প্রতিদিনই। কেউ একদিন হালান্ডকে ফটোশপ করছেন বার্সেলোনার জার্সিতে, আবার একদিন তাকে দেখা যাচ্ছে ম্যান সিটির জার্সিতে। আর এমবাপে যে রিয়াল মাদ্রিদেই আসছেন- এমনটা ভেবে সবাই অপেক্ষা করছেন ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার জন্য। আবার শোনা যাচ্ছে- এমবাপে রিয়াল মাদ্রিদ আর হালান্ড বার্সেলোনায় যেয়ে পুনরোজ্জীবিত করে তুলবেন ‘এল ক্লাসিকো’কে, ঠিক যেমন উত্তাপ ছড়িয়েছিল মেসি-রোনালদোর সময়। কিন্তু মোদ্দা কথা- আপাতত সবই গুঞ্জন।
দুজনেরই ট্রান্সফার নিয়ে আছে অর্থনৈতিক মারপ্যাঁচ, এবং ভেতরের রাজনীতি- বিশেষ করে এমবাপেরটা নিয়ে। দুজন কোথায় যাবেন না যাবেন সে নিয়ে খবরের শিরোনামে বারবারই ঘুরেফিরে আসবেন তারা- সে নিয়ে কোন সন্দেহ নেই।