• ক্রিকেট, অন্যান্য
  • " />

     

    জাস্টিন ল্যাঙ্গারের পদত্যাগ: কেন ফিঞ্চ, কামিন্সদের আস্থা হারালেন?

    জাস্টিন ল্যাঙ্গারের পদত্যাগ: কেন ফিঞ্চ, কামিন্সদের আস্থা হারালেন?    

    জাস্টিন ল্যাঙ্গার যখন কোচ হয়ে আসেন, অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট তখন টালমাটাল। ২০১৮ সালে কেপ টাউন টেস্টে বল টেম্পারিং করে নিষিদ্ধ হন স্টিভেন স্মিথ ও ডেভিড ওয়ার্নার। টেম্পারিং কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকায় নিষেধাজ্ঞা জোটে ক্যামেরন ব্যানক্রফটেরও। পদত্যাগ করেন তৎকালীন কোচ ড্যারেন লেম্যান। অস্থির সেই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার দায়িত্ব নেন ল্যাঙ্গার। 

    সেই কেলেঙ্কারির পর সমালোচনায় জর্জরিত, হাজারটা প্রশ্নবিদ্ধ অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দল মাথা তুলে দাঁড়ায় ল্যাঙ্গারের অধীনে। দীর্ঘ এই পথে হারের বৃত্তে ঘুরপাক খেয়েছে দল। ফিরেও এসেছে তাক লাগানো পারফর্ম্যান্স দিয়ে। অর্জনের পাল্লাও বেশ ভারী। তবুও পদত্যাগ করতে হলো ল্যাঙ্গারকে। তার এই আচমকা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত বিস্ময় হয়ে এসেছে সবার কাছেই।

     

    কেন পদত্যাগ করলেন ল্যাঙ্গার?

    চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে চুক্তি ছিল ল্যাঙ্গারের। চুক্তির ভবিষ্যত নির্ধারণে ল্যাঙ্গারের সঙ্গে আট ঘন্টার ম্যারাথন বৈঠকে বসে অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড। তবে লম্বা সেই বৈঠকের পরেও আসেনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। কারো প্রস্তাবেই রাজি হয়নি কেউ। এর আগে কয়েক দফার আলোচনাও ফলপ্রসূ হয়নি।  

    অ্যাশেজ ও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার পর ল্যাঙ্গার চাচ্ছিলেন দীর্ঘমেয়াদে দলের দায়িত্বে থাকতে। কিন্তু বোর্ডে তাকে প্রস্তাব দেয় ছয় মাসের চুক্তির। সেই প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দেন ল্যাঙ্গার। এক বিবৃতিতে ল্যাঙ্গারের ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান ‘ডিএসইজি’ পদত্যাগের খবর জানায়।  


    ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া কেন দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি দিতে চায়নি?

    দুটো অ্যাশেজ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা, টেস্ট র‍্যাংকিংয়ের শীর্ষস্থান। ল্যাঙ্গারের অধীনে অস্ট্রেলিয়ার অর্জন তো কম নয়। তবুও তার সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদে চুক্তি নবায়নে রাজি নয় অস্ট্রেলিয়ান বোর্ড। কেন এমন সিদ্ধান্ত?

    ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী নিক হকলি বলছেন, দল এগিয়ে গেছে অনেকখানি। তাই কোচিং প্যানেল এবং কোচিংয়ের ধরনে আমূল পরিবর্তনের কথা ভাবছেন তারা। সেই ভাবনা থেকেই ল্যাঙ্গারের সঙ্গে স্বল্পমেয়াদে চুক্তি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। 

    কিন্তু এর নেপথ্যে আছে ক্রিকেটারদের সঙ্গে ল্যাঙ্গারের মনোমালিন্য। যার শুরু গত বছরের আগস্টে। সমাধান আসেনি এতদিনেও। দীর্ঘমেয়াদে যার প্রভাব পড়ে ড্রেসিংরুমে। অবশ্য উত্তাল ড্রেসিংরুম নিয়েই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজ জিতেছে অস্ট্রেলিয়া।

    মাঠের ফল পক্ষে এলেও বিভিন্ন কারণে কোচের ওপর নাখোশ ছিলেন সিনিয়র ক্রিকেটাররা। বোর্ডের কর্তাদের কাছে নালিশও করেছেন কয়েক দফায়। ক্রিকেট বোর্ডও সেই অভিযোগ আমলে নিয়েছে। বলা চলে শিষ্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনই কাল হলো ল্যাঙ্গারের। 


    ক্রিকেটারদের সঙ্গে ল্যাঙ্গারের কী সমস্যা?

    গত এক বছরে দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে ল্যাঙ্গারের সম্পর্কের কেবল অবনতিই হয়েছে। যার ফলাফলটা সাবেক অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার পেয়েছেন চুক্তি নবায়ন করতে গিয়ে। অনুমিতভাবেই ল্যাঙ্গারের পদত্যাগে বড় প্রভাব ছিল দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের মতামতের। 

    শুরুটা হয়েছিল ঘরের মাঠে ভারতের কাছে ওয়ানডে সিরিজ হারার পর। ল্যাঙ্গারের কোচিংয়ের ধরন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন দলের সিনিয়র ক্রিকেটাররা। সংবাদমাধ্যমে সেই আলোচনা ফলাও করে প্রচার হলে জনসম্মুখে আসে বিষয়টি। সেই আগুনে ঘি ঢালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও বাংলাদেশ সফরের ফলাফল। মাঠ ও মাঠের বাইরে ল্যাঙ্গারের আচার, আচরণ, পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া এবং ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রবল আপত্তি দেখা যায় ক্রিকেটারদের মাঝে। 

    বাংলাদেশ সফরে ৪-১ ব্যবধানে হারার পর অ্যাডিলেডের এক হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকাকালীন ক্রিকেটার ও কোচিং প্যানেলের বাকি সদস্যদের সঙ্গে জুম মিটিং করেন ল্যাঙ্গার। সেখানে তার কোচিংয়ের ধরন, দর্শন ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা করেন সাবেক টেস্ট অধিনায়ক টিম পেইন, বর্তমান টেস্ট অধিনায়ক প্যাট কামিন্স ও ওয়ানডে অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। 

    জুমে আলোচনার পর ক্রিকেটার ও সহকারী কোচদের মতামত আমলে নিয়ে ল্যাঙ্গার নিজের কোচিংয়ের ধরনে পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। ক্রিকেটার ও সহকারীদের চাওয়া ছিল, তাদের ওপর যেন ল্যাঙ্গার ভরসা করেন। সেই চাওয়া অনুযায়ী সম্মত হওয়ায় ক্রিকেট বোর্ডও তাকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজ পর্যন্ত সময় দেয়। 

    ল্যাঙ্গারও শিষ্যদের চাওয়া অনুযায়ী কোচিংয়ে বদল আনেন। এই ক্ষেত্রে ল্যাঙ্গারের দাবি, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও অ্যাশেজই তার প্রমাণ। পিঠাপিঠি এমন সাফল্যের পর ল্যাঙ্গারও ভেবেছিলেন দীর্ঘমেয়াদে কোচিংয়ের চুক্তি হয়তো পাবেন। কিন্ত দুই ফরম্যাটের অধিনায়ক ও সিনিয়র ক্রিকেটারদের সমর্থন পাননি। 

     

    ক্রিকেটারদের সঙ্গে বিরোধ নিয়ে ল্যাঙ্গার কী ভাবছেন? 

    মেলবোর্নে বোর্ডের সঙ্গে বৈঠকের ২৪ ঘন্টা পর পদত্যাগপত্র জমা দেন ল্যাঙ্গার। সেখানে উল্লেখ আছে  ক্রিকেটার ও কোচিং প্যানেলের  সদস্যদের, যারা চাননি দীর্ঘমেয়াদে ল্যাঙ্গার দলের কোচ থাকুক। 

    সেই চিঠিতে ল্যাঙ্গার লিখেছেন, ‘মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী সিনিয়র কয়েকজন ক্রিকেটার ও কোচিং প্যানেলের দুজন সদস্য আমাকে সমর্থন করেন না। ক্রিকেট বোর্ডের ভাবনাও সেদিকেই যাচ্ছে, এটাও স্পষ্ট। এই সিদ্ধান্তের প্রতি আমার পূর্ণ সম্মান আছে।’


    সাবেকরা সরব হলেও, বর্তমানরা নীরব কেন? 

    ল্যাঙ্গারের পদত্যাগ নিয়ে রীতিমতো ফুঁসে উঠেছেন তার সাবেক সতীর্থরা। ম্যাথু হেইডেন, রিকি পন্টিং, অ্যাডাম গিলক্রিস্টের মতো সোনালী প্রজন্মের তারকারা চরম সমালোচনা করছেন ক্রিকেট বোর্ডের। অভিযোগের তীর ছুটেছে টেস্ট অধিনায়ক কামিন্সের দিকেও। 

    গিলক্রিস্ট তো মেনেই নিতে পারছেন না সাবেক সতীর্থর পদত্যাগ। টুইটারে দুঃখপ্রকাশ করেছেন সাবেক এই অজি ক্রিকেটার। হেইডেনের দীর্ঘদিনের ওপেনিং সঙ্গী ছিলেন ল্যাঙ্গার। এর বাইরেও ভালো বন্ধু তারা। বন্ধুর পদত্যাগের পর অশ্রুসিক্ত এক সাক্ষাতকারে কামিন্সের কঠোর সমালোচনাও করেন তিনি।  

    ল্যাঙ্গারের পদত্যাগকে অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটে ‘দুঃখজনক দিন’ বলে উল্লেখ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম সফলতম অধিনায়ক রিকি পন্টিং।

    তবে এই বিষয়ে মুখে যেন কুলুপ এঁটেছেন অস্ট্রেলিয়া ক্রিকেট দলের বর্তমান সদস্যরা। অধিনায়ক কিংবা সিনিয়র ক্রিকেটারদের কেউই ‘টু’ শব্দটি করছেন না।