'দ্য মুস্তাফিজ ট্রায়াঙ্গল'
১.
‘স্লোয়ার ধরতে পারছি না!’
টেপ-টেনিস বলের একটা টুর্নামেন্ট। নীলফামারির সৈয়দপুর, সেখানকারই এক দলে খেলেন এক অলরাউন্ডার, আল-আমিন সিদ্দিক সুজন। বাঁহাতি পেসার, বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। পড়েন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। জগন্নাথ হলের মাঠে আন্তঃবিভাগীয় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট টুর্নামেন্টেই সেঞ্চুরি আছে সে ব্যাটসম্যানের। খেলতে এসেছেন দিনাজপুরের বিরামপুরে।
বলে টেপ পেঁচানোর দায়িত্ব যাঁর, তিনি হয়তো ভুলে গেছেন বা টেপ সঙ্কটে পড়েছেন তখন। ‘আসল’ ক্রিকেট বলের আদলে বাড়তি এক পরত টেপ পেঁচিয়ে ‘সিম’ দেয়া হয়নি তাই। তাতেই ওই ব্যাটসম্যানের আপত্তি জানানো, আম্পায়ারের কাছে। সে ব্যাটসম্যান পরে প্রিমিয়ার ডিভিশনেও খেলেছিলেন, ওল্ড ডিওএইচএস এর হয়ে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এবার দল পাননি শেষ মুহুর্তে এসে।
শুরুটা সুজনকে দিয়েই হোক। একটু যদি কিন্তুর ওপর ভর করতে হবে। যদি আল-আমিন সিদ্দিক দল পেতেন, মুস্তাফিজ যদি শেষের দিকে এসে প্রিমিয়ার খেলতেন, তাঁর দলের সঙ্গেই যদি খেলা পড়তো মুস্তাফিজের! সৈয়দপুরের সেই ব্যাটসম্যান কি ‘সিম’ দেখে ধরতে পারতেন মুস্তাফিজের ‘স্লোয়ার’? আচ্ছা, ‘যদি-কিন্তু’র হিসাব তোলা থাকুক আপাতত। বরং যা হচ্ছে, তাই নিয়েই কথা হোক। কথা হোক মুস্তাফিজকে নিয়েই, কথা হোক তাঁকে যাঁরা খেলেছেন তাঁদেরকে নিয়ে, তাঁর স্লোয়ার-কাটারের অমোঘ রহস্য নিয়ে!
২.
‘গ্রেট ফাস্ট বোলাররা তৈরী হয় না, জন্ম নেয়।’ ক্রিকেটে বহুল ব্যবহৃত প্রবাদ। ফাস্ট বোলারদের শারীরিক গঠন লাগে, স্ট্যামিনা লাগে অন্য অনেকের চেয়ে বেশী। গতি দরকার, দরকার স্কিল। সবই কি বংশপরম্পরায় পাওয়া যায়? কিছু পাওয়া যায়, বাকীটা কিন্তু তৈরী করেই নিতে হয়। অবশ্যই পরিবেশ একটা প্রভাব ফেলে। কারও প্রতিভা থাকে, চর্চার অভাবে হারিয়ে যায়। কেউ প্রতিভায় পিছিয়ে, তবে শেখার অদম্য ইচ্ছা আর লেগে থাকার মানসিকতায় এগিয়ে যায় দূর-বহুদূর! কেউ আবার ইচ্ছা-মানসিকতা পোষণ করেও শীর্ষ পর্যায়ে যেতে পারে না, ওই প্রকৃতিদত্ত প্রতিভার একটু ঘাটতির কারণে! ফাস্ট বোলাররা তাহলে জন্মগতও, আবার তৈরীও হয়!'
ফাস্ট বোলার, কথাটা শুনলে প্রথমে কি মাথায় আসে? গতি। ক্ষিপ্রতা। ব্যাটসম্যান নাচানো সুইং। ‘টো-ক্রাশিং ইয়র্কার’। ভয়ঙ্কর বাউন্সার। স্লোয়ার-কাটার।
৩.
মুস্তাফিজুর রহমান, করেন আসলে ফাস্ট মিডিয়াম বোলিং। সহজ কথায় যাঁদের বলে মিডিয়াম পেসার। মুস্তাফিজও ব্যাটসম্যানদের নাচান। বাউন্সার না দিলেও বিব্রত করেন ব্যাটসম্যানকে, স্লোয়ার-কাটার দিয়ে। তাঁর ইয়র্কার সামলাতে ভূপাতিত হন ব্যাটসম্যান।
'মুস্তাফিজ' নামটা শুনলে প্রথমে কোন ছবিটা ভাসবে মনে? হ্যাংলা-পাতলা শরীরের কৈশোরের ছাপ থাকা কোনো নিরীহ চেহারা? উইকেট পাওয়ার পর দুই হাতে তালি দিয়ে একটা মিষ্টি শিশুসুলভ হাসি? নাকি হতভম্ব কোনো ব্যাটসম্যান, খেই হারিয়ে ফেলা অথবা ইয়র্কার সামলাতে হিমশিম খাওয়া ভূপাতিত কোনো ব্যাটসম্যান?
আহা, কী আনন্দ বোলিংয়ে!
৪.
চিরায়ত বাঁহাতি মিডিয়াম পেসারের বল ডানহাতি ব্যাটসম্যান থেকে সুইং করে বেরিয়ে যাবে, কিছু বল ঢুকবে ভেতরের দিকে। কিন্তু তাঁর সুইংও তো তেমন যুৎসই নয়! উচ্চতার কারণে তেমন বাউন্সও দিতে পারবেন না উপমহাদেশের ধীরগতির নীচু উইকেটে। খুব একটা ভাবার কি কারণ আছে? ভারতীয়রা হয়তো তেমনই ভেবেছিলেন শুরুতে।
ভুল ভেবেছিলেন। প্রথম ধরা পড়লেন রোহিত শর্মা। লেগস্ট্যাম্পের ফুললেংথের বলটা খেলতে গিয়ে হলো ‘লিডিং এজ’। কাটার ছিল। এই 'কাটার' আসলে কী?
পেসারদের বল ঘোরানোর প্রধান উপায় অবশ্যই বলকে সুইং করানো। আউটসুইং, ইনসুইং, বল পুরোনো হয়ে গেলে 'রিভার্স সুইং'। সুইং হয় বাতাসে, তবে বলকে পিচে ফেলার পর বল ঘোরানোর উপায়টাই হলো কাটার। সোজা কথা, পেসারদের মতো গতি, তবে মুভমেন্ট স্পিনারদের মতো। লেগ কাটারের জন্য একরকম গ্রিপ, অফ কাটারের জন্য আরেকরকম। আবার বলের ‘সিম’ সোজা রেখে পিচে ফেলেও বলকে ঘুরতে দিয়েও হতে পারে কাটার। তবে শক্ত উইকেটে কাটার করানো শক্ত। একটু কোমল, ঘাসযুক্ত উইকেট, বল যেখানে পিচে বসে ঠিকমতো, এমন উইকেটে কাটার করা সহজ। আর সে কাটার যদি হয় ‘নিখুঁত’, ব্যাটসম্যানের জন্য তা হয়ে ওঠে রীতিমতো ‘আনপ্লেয়েবল’। সুইংয়ের সময় বল যেখানে হাত থেকে ছাড়ার পর থেকে বাতাসেই ঘোরে, কাটারের ‘মুভমেন্ট’ সেখানে হয় দেরীতে, বল পিচে পড়ার পর।
অফ কাটার, লেগ কাটার
৫.
এই কাটারের সঙ্গেই যদি যুক্ত হয় স্লোয়ার?
স্লোয়ার দেয়ার মূল উদ্দেশ্য অবশ্যই ব্যাটসম্যানকে ধন্দে ফেলানো। গতিতে দ্রুত একটা পরিবর্তন ব্যাটসম্যানের ভুল করার মাত্রা সবসময়ই বাড়িয়ে দেয়। স্লোয়ারের জন্যও গ্রিপিং আছে নানারকমের। ‘নাকল বল’, ‘লেগস্পিন গ্রিপ’, ‘অফস্পিন গ্রিপ’, ‘হাফ বল গ্রিপ’, ‘ওয়ান ফিঙ্গার গ্রিপ’, ‘পাম-বল গ্রিপ’। এটা পরিষ্কার, স্লোয়ারের জন্য গ্রিপিং পরিবর্তন করতে হবে। ব্যাটসম্যানের আগেই বুঝে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, যদি না শেষ মুহুর্তে গ্রিপ পরিবর্তন করার কৌশলটা না আয়ত্ত করা হয়।
ক্রিকেট ইতিহাসে এটা প্রায় দুর্লভ ঘটনা, কোনো বাঁহাতি পেসার অথবা যে কোনো পেসার স্লোয়ার আর কাটারের সমন্বয় করছেন। বল পিচে পড়ার পর কোনদিকে ঘুরবে, এটা নিয়েই যখন ভাবার কথা, ব্যাটসম্যানদের তার আগে ভাবতে হয়, গতির পরিবর্তন নিয়ে। বল আসে দেরীতে, তারপর আবার ঘুরে যায়! যেন একজন পেসার, দূর থেকে এসে করছেন স্পিন! গ্রিপিং বা সিম-পজিশন দেখে বুঝবেন, উপায় নেই তারও! মুস্তাফিজের সাধারণ ডেলিভারি আর স্লো-কাটার, দুইয়ের গ্রিপিং প্রায় একই! খোলা চোখে যা ধরতে পারা শুধু কঠিন নয়, বেশ কঠিন! খুব ভালভাবে দেখলে বোঝা যায়, তবে তাও শুধু বল হাত থেকে ছাড়ার পর! ততক্ষনে যে দেরী হয়ে যায় বড্ড!
গ্রিপের চেয়েও একদিক থেকে বেশী 'অনন্য' মুস্তাফিজ। তাঁর কবজি(রিস্ট)। রিস্টের উল্টো দিক থেকে কাটার করান, শেষ মুহূর্তে একটা ঝাঁকিও খায় কবজি। মুস্তাফিজের এই ক্ষমতা সহজাত, কিভাবে 'হয়ে যায়' তিনিও নিশ্চিত নন! ব্যাটসম্যান বোকা বনেন এই কারণেই, আরও বেশী করে।
শুধু তাই না, মুস্তাফিজ তাঁর ‘স্টক’ ডেলিভারির গ্রিপিংয়েও কৌশল খাটান। এমনিতে স্টক ডেলিভারির সময় তাঁর কবজি মিড-অফের দিকেই তাক করা থাকে ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য, তবে ঠিক ডেলিভারির আগে তা পিচের দিকে তাক করার মতো অবস্থায় চলে আসে! কোনটা স্টক, কোনটা কাটার, তা বুঝতে ‘স্লো-মোশন’ রিপ্লেতেই রীতিমত হিমশিম খেতে হয়। একবার গিয়ে খেলার চেষ্টাই করে দেখুন না!
আসছে মুস্তাফিজের রহস্য বল!
মুস্তাফিজ শুধু এ কৌশলেই ক্ষান্ত দেন না। মাঝে মাঝে স্টক ডেলিভারিও করেন সিম খাড়া রেখে, মাঝে মাঝে আবার করেন সিম ‘স্ক্র্যাম্বলড’ অবস্থায়!
ব্যাটসম্যান শট খেলতে গিয়ে আগেই খেলে ফেলেন, শট না খেলার পণ করে থেকে শেষ পর্যন্ত দেন ‘এজ’, বল ওঠে আকাশে! বলের জায়গায় গিয়ে খেলতে গিয়ে করেন মিস, ব্যাট আর পায়ের কম্বিনেশন ঠিক করতে না পেরে হন এলবিডাব্লিউ!
স্লোয়ার কাটারের আগে পরে থাকে ‘অ্যাংগেল’ সৃষ্টি, ডানহাতি ব্যাটসম্যানের জন্য যা বাঁহাতি পেসারের অন্যতম অস্ত্র। মুস্তাফিজের বেরিয়ে যাওয়া এসব বলের লাইন-লেংথও হয় নিখুঁত, ব্যাটসম্যান সঠিকভাবে খেলতে গিয়েও ভোগেন পেছনে ক্যাচ দেওয়ার আশঙ্কায়!
১৪০ কিলোমিটার গতিতে বল করা কোনো বোলার যদি ১২৫ কিলোমিটারের স্লোয়ার দেন, সেই বোলারের স্লোয়ার ডেলিভারিই যদি আবার নেমে আসে ১১০ কিলোমিটারে, ব্যাটসম্যানরা হিমশিম খেলে তাঁদেরই বা কী দোষ!
অথচ মুস্তাফিজ এই কাটার বা স্লোয়ারে অভ্যস্থ ছিলেন না! শের-এ-বাংলায় একবার নেটে বল করছিলেন এনামুল হক বিজয়কে। সেখানেই এনামুল বলেছিলেন, ‘স্লোয়ার করতে পারিস না?’ এনামুলের কথা শুনেই মুস্তাফিজের কাটার করা, প্রথম বলেই আউট এনামুল। সেদিন ওইরকম বলেই এনামুলকে বারকয়েক আউট করেছিলেন মুস্তাফিজ, সেদিন এমন সাফল্য না পেলে হয়তো ওই ডেলিভারিটা আর চেষ্টাই করে দেখতেন না!
৬.
‘লিলিইই, লিলিইই, লিলিইই, কিইইল, কিইইল, কিইইল!’
মাইকেল হোল্ডিংয়ের প্রথম অস্ট্রেলিয়ান সফর। বোলিংয়ে যখনই আসেন ডেনিস লিলি, মাঠে উপস্থিত অজি সমর্থকরা কোরাস ধরেন ওপরের মতো করে। একের পর এক ‘প্রাণনাশী’ বাউন্সার, সঙ্গে সমর্থক দর্শকদের ‘কটুক্তি’! সহ্য করতে না পেরে কেঁদেই দিয়েছিলেন তরুণ হোল্ডিং, পরবর্তীকালের ‘দ্য হুইস্পারিং ডেথ’! হোল্ডিং হয়ে উঠেছিলেন ভয়ঙ্কর, সেই ‘কিলার’ লিলির চেয়েও হয়তো বেশীই!
পেস বোলিংয়ের শিল্পটা এমনই। গতি, বাউন্সে নাকাল করো ব্যাটসম্যানকে। বুকে কাঁপুনি ধরাও একেকটা ডেলিভারি দিয়ে। মিডিয়াম পেসাররা সে তুলনায় একটু ‘নিরীহ’, অনেক বেশী পরিকল্পনা বা ‘সেট-আপ’ তাঁদের মূল হাতিয়ার। সুইং, লাইন-লেংথ সেই হাতিয়ারের যোগানদাতা।
তারপর আসেন মুস্তাফিজুর রহমানরা।
শেন ওয়ার্ন তাঁর বোলিং রান-আপের প্রায় পুরোটা পথই আসতেন হেঁটে, তিনি নাকি ব্যাটসম্যানকে সময় দিতেন, ‘চিন্তা করো, কী আসছে এবার!’ চিন্তা-পরিকল্পনা মাঠে মারা যেত প্রায়ই, শেন কিথ ওয়ার্ন হয়ে উঠতেন ‘আন-প্লেয়েবল’। হয়তো ‘রং-আন’টা ব্যাটসম্যান ধরতে পেরেছিলেন ঠিকই, তবে খেলেছেন সময়ের আগে পরেই! জানেন, বোঝেন, তাও করার যে কিছুই নেই!
না শেন ওয়ার্নের সঙ্গে তুলনাটা ঠিক মানাবে না এখনই। একজন লেগস্পিনের অন্য নাম, আরেকজন সদ্য ক্যারিয়ার শুরু করা একজন বাঁহাতি পেসার!
তবে মুস্তাফিজের ডেলিভারিগুলোও হয়ে ওঠে আনপ্লেয়েবল, ওয়ার্নের মতোই! ব্যাটসম্যান জানেন-বোঝেন, কিছু একটা আসছে। কিন্তু শেষ মুহুর্তে গিয়ে যে গড়বড় হয়ে সব!
উৎসবের মধ্যমণি!
৭.
বয়স একুশ পূর্ণ হয়নি এখনও। মুস্তাফিজ এরই মাঝে প্রতিদিন একটু একটু করে নিয়ে যাচ্ছেন নিজেকে একটা অন্যরকমের উচ্চতায়। সামনে চোটে পড়বেন, ব্যাটসম্যান বুঝে ফেলবে কৌশল। তাঁর বোলিং পড়ে ফেলবেন ব্যাটে আসার আগেই। মুস্তাফিজের ফর্মটা খারাপ যাবে। উইকেট পাবেন না।
তবে ফিরে আসবেন। তাঁর ভান্ডারে যুক্ত হবে নতুন রকমের ডেলিভারি, নতুন সব অস্ত্র! ইয়র্কারটা আরও ভালভাবে রপ্ত করবেন। হঠাৎ বাউন্সারে ভড়কে দেবেন ব্যাটসম্যানকে!
বয়স বাড়বে, মুস্তাফিজ পরিণত হবেন। বাড়বে অভিজ্ঞতা, আইপিএল খেলছেন, খেলবেন সাসেক্সের হয়ে টি-টোয়েন্টি। ডাক পড়বে কাউন্টি থেকে, শিখবেন আরও অনেক কিছু। কল্পনার তরী ভাসানোর ‘ঝুঁকি’টা তো মুস্তাফিজই যেন নিতে বলছেন প্রত্যেক ম্যাচে!
আরও বেশ কয়েক বছর পরে বাংলাদেশের কোনো এক স্টেডিয়ামে দর্শকরা কোরাস ধরবে। গাইবে নতুন গান। যে গানের কেন্দ্রে থাকবেন এক বোলার।
উইকেট পাওয়ার পরের উদযাপনে যিনি নিজেই ছোট করে হাততালি দেন, সঙ্গে থাকে একটা হাসি! ভুবন-ভুলানো, বিমোহিত করিয়ে দেওয়ার মতো একটা হাসি!
তথ্যসূত্রঃ
১) The Art of Fast Bowling, by Dennis Lillee
২) ESPN Cricinfo