• অন্যান্য
  • " />

     

    শেন ওয়ার্ন: তার মতো আর কেউ আসবে না...

    শেন ওয়ার্ন: তার মতো আর কেউ আসবে না...    

    আপনি শচীন টেন্ডুলকারকে দেখে হয়তো বড় হয়েছেন। তার মতো করে ব্যাট হাতে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। কিংবা আপনার বেড়ে উঠা হয়েছে এ যুগের বিরাট কোহলিকে দেখে, অথবা হচ্ছে। কোহলির মতো ফ্লিক করার চেষ্টা করেন আপনিও। বিরাট কিংবা শচীন, দুজনেই অনুপ্রেরণা হতে পারেন কোন এক প্রজন্মেরই। তবে তা একই প্রজন্মের হতে পারে না। অথবা পারে…

    শেন ওয়ার্নের ‘জাদু’ হয়তো আপনার সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় দেখার সৌভাগ্য হয়নি। আপনার বেড়ে উঠার গল্পে জাদুকর ওয়ার্নের কোন অধ্যায় যুক্ত হয়নি তাই। তবু তিনি আপনার অনুপ্রেরণা হতে পারেন। হতে পারেন, আপনার স্বপ্ন বুনে দেওয়ার কারিগর। আপনি তার ‘বল অব দ্যা সেঞ্চুরি’ দেখতে পান, আপনি তার জাদুতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। আপনি তার মতো করে বলের সাথে খেলা করার বৃথা চেষ্টাই শুধু করতে পারেন। আপনি তখন বুঝে যান, ওয়ার্ন কী জিনিষ! 

    ওয়ার্ন মাঠের বাইরেও এক ‘জিনিষ’ই ছিলেন বটে! মনের কথা মনে জমিয়ে রাখার পক্ষে তার মত ছিল না কখনোই। ১৯৯৯ সালে শ্রীলংকার অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে তো সোজাসাপ্টা ‘শত্রু’ বলতেও দ্বিধাবোধ করেননি তিনি। অর্জুনা রানাতুঙ্গা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘আমার আর অর্জুনার মধ্যে শত্রুতা আছে। আমি ওকে পছন্দ করি না।’ যা বলার পরে জরিমানার পাশাপাশি পেয়েছিলেন দুই ম্যাচের নিষেধাজ্ঞাও। অকপটে কথা বলে যাওয়ার অভ্যাসটা ওয়ার্নের ছিল খেলাশেষেও। এইতো গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও স্টিভ স্মিথের দলে থাকা নিয়ে করেছিলেন খোলামেলা সমালোচনা। সতীর্থ জাস্টিন ল্যাঙ্গারের অস্ট্রেলিয়া দলের কোচের পদ থেকে অব্যাহতি নেওয়ার বিষয়েও তিনি ছিলেন সরব। 

    মাঠের বাইরের রঙ চড়ানো জীবনের মতো মাঠেও তিনি ছিলেন রঙিন। এবং অস্ট্রেলিয়ান রুলস ফুটবলার হতে চাওয়া ওয়ার্ন শেষমেশ ক্রিকেটে এসেছিলেন বলে ক্রিকেটও তো হয়েছে রঙিন। বর্ণিল এই ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল ১৯৯২ সালের ২ জানুয়ারীতে। তার শেষ টেস্টটারও শুরু হয়েছিল আরেক ২ জানুয়ারীতেই, ২০০৭ সালে। সিডনিতে শুরু করা ক্যারিয়ার যখন আবার শেষ করছেন সিডনিতেই, তখন তিনি টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী। তবে অভিষেকটা সুখকর হয়নি তার মোটেও, সে ম্যাচটাতে মাত্র এক উইকেট নিতেই যে খরচ করতে হয়েছিল ১৫০টি রান। ওয়ার্ন নামের ‘জাদুকর’কে অভিষেকের পরের বছরই অবশ্য চিনতে পেরেছিল বিশ্ব। সেই ‘বল অব দ্যা সেঞ্চুরি’র বদৌলতে! ওয়ার্নের মতে, যা জীবন বদলে দিয়েছিল তার। 

    ১৯৯৩ সালের অ্যাশেজের অভিষেকে যে বল করেছিলেন ওয়ার্ন, লেগ স্টাম্পের বাইরে পিচ করে তার ওই বলটা গিয়ে ছুঁয়েছিল মাইক গ্যাটিংয়ের অফ স্টাম্প। ওয়ার্নের জাদু চলেছে এরপর, গড়েন তিনি সময়ের হিসাবে দ্রুততম দুইশ টেস্ট উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। যে রেকর্ড এখনও অক্ষত। মাঠের কার্যকলাপে খবরের শিরোনাম হতেন যেমন, বাইরের কর্মকান্ডেও হতেন তেমনই! ১৯৯৮ সালে ওয়ার্নকে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলো এক খবর, যা ছিল তোলপাড় শুরু করে দেওয়ার মতো। 

    ১৯৯৪ সালে যে শ্রীলংকা সফরে গিয়েছিলেন ওয়ার্ন, সেখানে গিয়ে পিচ সম্পর্কে তথ্য দিয়েছিলেন ভারতীয় এক জুয়াড়িকে। যার পরে মার্ক ওয়াহর সঙ্গে তাকেও গুনতে হয়েছিল জরিমানা। সেই ওয়ার্ন ১৯৯৯ সালে অস্ট্রেলিয়াকে ফাইনাল জিতিয়েছিলেন ৩৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে। পরের বছরই ইংলিশ নার্সকে আপত্তিকর বার্তা পাঠিয়ে অস্ট্রেলিয়ার সহ-অধিনায়কত্বের পদ হারান। ২০০১ সালেই আবার প্রথম অস্ট্রেলিয়ান বোলার হিসেবে চারশ টেস্ট উইকেট নেওয়ার কীর্তিও গড়ে ফেলেন। 

    এরপর ১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপজয়ী ওয়ার্ন বলে দিয়েছিলেন, ২০০৩ বিশ্বকাপটা হতে যাচ্ছে তার শেষ বিশ্বকাপ। কিন্ত শেষ পর্যন্ত তা আর তার খেলাই হয়নি। ওই বিশ্বকাপের আগেই নিষিদ্ধ ঔষধ সেবনে পেয়ে যান এক বছরের নিষেধাজ্ঞা। পরে বলেছিলেন, ওজন কমানোর জন্যে তার মার কাছ থেকেই তিনি পেয়েছিলেন সেই ঔষধ। নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে এরপর তিনি ফিরেছেন আবার, তবে অস্ট্রেলিয়ার রঙিন পোষাকে আর খেলা হয়নি কখনোই।

    শহীদ আফ্রিদির কাছে ওয়ার্ন 'ইউনিভার্সিটি অফ লেগ স্পিন'। সে ওয়ার্নের ব্যাক্তিগত জীবনেও ঝামেলা কম ছিল না। ২০০৫ সালে স্ত্রীর সঙ্গে তার ডিভোর্সের কারণটা ছিল, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক! তবে ওয়ার্ন ঠিকই বল হাতে জাদু করতে পারতেন, সেই জাদুতে মুগ্ধ হবেন আপনি। তার কব্জির খেলে বিমোহিত আপনার হৃদয়ে তিনি জায়গা করে নেবেন। তার খামখেয়ালী জীবনের বাকি সবকিছু ছাপিয়ে তাই তিনি হয়ে যাবেন এক বিস্ময়! আর ওয়ার্নের মতো চরিত্রই তো ক্রিকেটকে আরও রঙিন করে তুলে। তা ওয়ার্নের মতো, ওয়ার্নের মতো হওয়ার সাধ্য যে কারোই নেই। শেন কিথ ওয়ার্ন ছিলেন এক উপভোগ্য ক্যারেক্টার, যে প্যাকেজে ছিল ইতিহাসের অন্যতম সেরা এক বোলারও!

    যে বোলারের দখলে টেস্টে এক বছরে সবচেয়ে বেশি ৯৬টি উইকেট নেওয়ার রেকর্ড। টেস্ট ক্রিকেটে কোন এক বোলার ছয়শ উইকেট শিকার করতে পারেন, সেটি প্রথম বিশ্ব দেখেছে যে ওয়ার্নের সৌজন্যেই। সাতশ উইকেট শিকারেও তিনিই প্রথম। পৃথিবীতে হাজারের বেশি উইকেট নেওয়া বোলার আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে ১০০১ উইকেট নেওয়া ওয়ার্নও একজন। ওয়ানডেতে তার উইকেট ২৯৩টি, টেস্টে তার উইকেট সংখ্যা ৭০৮!

    ওয়ার্নের কাছে হয়তো সংখ্যা গুরুত্ব পায়না তেমন। বল হাতে তার কারিশমা দেখেছেন যারা, তাদের অনুপ্রেরণা হয়ে তো থাকবেনই তিনি। সেই সঙ্গে তার ওই সংখ্যাগুলোও অনুপ্রেরণা দিয়ে যাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে! 

    শচীন, ওয়ার্নরা যে তাদের দেখা প্রজন্মের অনুপ্রেরণাই শুধু হন না, তা হন সব প্রজন্মেরই!