এমবাপে-নাটক ফুটবলবিশ্বকে কী শিক্ষা দিল?
কিলিয়ান এমবাপেকে নিয়ে কিছু লেখা এখন বিপজ্জনক। মাদ্রিদ সমর্থকেরা খুব রেগে আছেন, তারা সবখানেই অ্যাংগ্রি রিএক্ট দিয়ে বেড়াচ্ছেন। আবার পপকর্ন খেতে থাকা কিছু ‘অন্য সমর্থকেরা’ সবখানেই হাহা দিচ্ছেন। এই হাহা আর অ্যাংগ্রির বাইরে এমবাপে-নাটক আসলে ফুটবল দুনিয়ায় কীরকম প্রভাব ফেলবে? বা উপপাদ্যের মতো যদি বলতে চাই এ থেকে আমরা কী সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি?
১), ফুটবলে জেন্টেলমেন এগ্রিমেন্ট একটা ব্যাপার সবসময়েই চালু আছে। মৌখিকভাবে দেওয়া কথা অনুযায়ী দলবদল আগে অনেক হয়েছে, এই মৌসুমেও যেমন রুদিগার রিয়ালে এসেছেন এই মুখে দেওয়ার ওপর ভিত্তি করে। জানা মতে, এমবাপেও রিয়ালকে এরকম একটা কথা দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই কথার বরখেলাপের পর এখন এই ব্যাপারটা একটু সমস্যায় পড়ে গেল। এখন আপনি বলতে পারেন, মুখে দেওয়ার কথার ওপর ভিত্তি করে কোনো ডিল করা বোকামি। তবে এমন ডিল কিন্তু হয়েছে বা হবে। কিন্তু এই ঘটনার পর সামনে হওয়ার পরিমাণ কমে যাবে নিশ্চিতভাবেই।
২) এমবাপে কাণ্ড বুঝিয়ে দিল ফুটবলারদের প্রভাব আগের যে কোনো সময়ের চাইতে অনেক বেশি। এমবাপের জন্য এমনকি যেখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকেও নাক গলাতে হয়েছে, তার সঙ্গে কাতারের শেখদের কথা না হয় বাদই গেল, বোঝাই যাচ্ছে তার প্রভাব কোথায় চলে গেছে। ফুটবলে রাজনীতি সবসময়েই ছিল, থাকবেও, তবে স্রেফ দলবদল নিয়ে এত কিছু হওয়ার উদাহরণ বিরল।
৩) খেলোয়াড় ক্লাবের চেয়ে বড় নয় সেটা সবসময়েই বলা হয়, কিন্তু পিএসজি বুঝিয়ে দিল তারা অন্তত সেরকম মনে করে না। এমবাপেকে নতুন চুক্তিতে রাখার জন্য অবিশ্বাস্য অংকের টাকার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ তাকে দলের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখার কথা। মেসি-রোনালদোর মতো কেউ সেটা পেয়ে থাকলেও এমবাপের মতো এমন নিরংকুশভাবে পাওয়ার উদাহরণ বোধ হয় আর নেই। পিএসজির স্পোর্টিং ডিরেক্টর এখন চলে যাচ্ছেন, শোনা যাচ্ছে চলে যাবেন কোচও। নতুন কোচ-ডিরেক্টর নিয়োগে এমবাপের সরাসরি সংযোগ থাকলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
৪) ফ্রেঞ্চ লিগের জন্য এমবাপের থেকে যাওয়াটা বড় একটা বিজ্ঞাপন। মেসি-নেইমারের মতো খেলোয়াড় লিগ ওয়ানে আছেন, কিন্তু এমবাপে এখন তাদের চেয়ে বড় তারকা। লিগ ওয়ানের পোস্টার বয় অনেক আগে থেকে ছিলেন, তাদের টিভি স্বত্ব বা অন্যান্য কিছু এই ডিলের পর আরও বাড়ার কথা। কিন্তু ফ্রেঞ্চ লিগ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাপকাঠিতে লা লিগা, প্রিমিয়ার লিগ এমনকি বুন্দেসলিগা বা সিরি আর চেয়েও হয়তো পিছিয়ে। সেদিক দিয়ে এমবাপের ডিল কতটা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
৫) এমবাপে ডিলের পর লা লিগা যখন পিএসজির বিরুদ্ধে ফিন্যান্সিয়াল পাওয়ার প্লে নিয়ে আইনি লড়াইয়ের ঘোষণা দিল, তখনই বোঝা গেল রিয়ালের সঙ্গে লা লিগার জন্যও এটা একটা ধাক্কা। এমনিতেই লা লিগায় এই মুহূর্তে একজন পোস্টার বয় দরকার, সেটা হতে পারতেন হালান্ড বা এমবাপে। রিয়াল আশায় ছিল এমবাপের, বার্সা অবশ্য আর্থিকভাবে এই মুহূর্তে সেরকম কাউকে আনার অবস্থায় নেই। সেদিক দিয়ে এমবাপের ডিল লা লিগার জন্য আর্থিকভাবে কতটা ধাক্কা হবে, সেটা সম্ভবত সামনে বোঝা যাবে।
৬) রিয়ালের জন্য এ ডিল সবচেয়ে বড় শিক্ষা, এখনকার যুগে শুধু নামের জন্য আর কিছু হয় না। টাকা এখন আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রিয়াল এমবাপের জন্য খরচ করতে প্রস্তুত থাকলেও পিএসজির তেলের টাকার সঙ্গে তারা পেরে ওঠেনি। এবং ফুটবলবিশ্বের এখনকার বাস্তবতায় সামনে হয়তো এলন মাস্ক বা অন্য ধনকুবেরদের সঙ্গে পেরে ওঠা কঠিন হবে। এমবাপে রিয়ালের ভক্ত, সেটা অনেকেরই জানা। কিন্তু একটা সময় সেই স্বপ্ন সত্যি করার ইচ্ছে থাকলেও এখন সেটা নেই।
৭) আর পিএসজির জন্য এটা ছিল নিজেদের সত্যিকার আর্থিক শক্তিটা জানান দেওয়ার উপলক্ষ। মেসি-নেইমার, এমবাপেকে অন্তত আরেকটা মৌসুম ধরে রাখর সাথে সামনে ফুটবল বিশ্বকাপ মিলে পিএসজি আলোচনায় থাকবে সামনে। এই ব্যাপারটা দরকার ছিল তাদের।
৮) কিন্তু এমবাপের ডিল বুঝিয়ে দিল, ফুটবলে এফএফপি বা ফিন্যান্সিয়াল পাওয়ার প্লে এখন একটা হাস্যকর ব্যাপার। যে ক্লাবের শুধু কোভিডের সময় ৩৫০ মিলিয়ন আর্থিক ক্ষতি হয়, তারা ২০০ মিলিয়ন ইউরো দিয়ে কী করে একটা চুক্তি করতে পারে? আর নেইমার, মেসি ও অন্যদের বেতনের অংক না হয় বাদই গেল। তার মানে আর্থিক ভারসাম্য নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। ইউয়েফাও যদি এই ব্যাপারে কিছু না করে, তাহলে ফুটবলে সামনে এমবাপের মতো আরও অনেক নাটক অপেক্ষা করছে।