করিম বেনজেমা: দুয়োধ্বনি থেকে নয়নের মণি
চার-পাঁচ মৌসুম আগেও করিম বেনজেমাকে নিয়ে হতো তুমুল সমালোচনা। ফুটবল পণ্ডিতরা তো বটেই, সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভক্ত-সমর্থকরাও একচুল ছাড় দিতেন না তাকে। শুধু কি তাই? সেই সময়টায় বেনজেমাকে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে দেখতে চাইতেন না দলটির অনেক সমর্থকই। এমনকি তার স্বদেশি জিনেদিন জিদান কোচ থাকাকালীন অনেকে বলতেন জিদানের ‘স্বজনপ্রীতি’র কারণেই টিকে আছেন বেনজেমা।
সমালোচনার তীর্যক বাক্য দিয়ে আঁকা এই চিত্রের নেপথ্যে ছিল বেনজেমার অফফর্ম। সেই ছন্দহীন বেনজেমা ওয়ান টু ওয়ান পরিস্থিতিতে কত ওপেন নেট গোলই না মিস করেছেন! যে কারণে বার্নাব্যুতেও রিয়াল সমর্থকরা তাকে উদ্দেশ্য করে শিষ বাজাতেন। এর ওপর রিয়াল মাদ্রিদ ক্যারিয়ারে বেনজেমার বড় একটা সময় কেটেছে অতিমানব হয়ে ওঠা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ছায়ায় ঢাকা পড়ে। সব মিলিয়ে বেশ কঠিন সময়ই পার করতে হয়েছে তাকে। অথচ সেই বেনজেমা আর এখনকার বেনজেমাতে কত তফাৎ!
যারা ইউরোপিয়ান ফুটবলের খোঁজখবর নিয়মিত রাখছেন তাদের কাছে পার্থক্যটা একদম দিনের আলোর মতো পরিস্কার। স্প্যানিশ জায়ান্টদের ত্রাণকর্তা এখন সেই বেনজেমাই। এবারের মৌসুমে ২৭ গোল করে হয়েছেন লা লিগার সর্বোচ্চ স্কোরার। রিয়ালও জিতেছে ৩৫তম লিগ শিরোপা। চ্যাম্পিয়নস লিগেও বেনজেমার পায়ের জাদুতে দূর্বার গতিতে এগুচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ। ১৫ গোল করে সবাইকে ছাপিয়ে শীর্ষে আছেন তিনিই।
পুরো দলটাও আছে দারুণ ছন্দে। ম্যান সিটিকে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে হারিয়ে চার বছর পর ফাইনালে উঠেছে রিয়াল মাদ্রিদ। সেই ম্যাচে পিছিয়ে থেকেও শেষ মুহূর্তে যেভাবে ফিরে এসেছে রিয়াল; নিঃসন্দেহে দুর্দান্ত এক কামব্যাকের গল্প লেখা হয়ে গেছে। ম্যাচের ৯০ মিনিটে পেনাল্টিতে পানেনকা কিকে গোল করেছিলেন বেনজেমা। সাহসী বটে! নইলে বাঁচা-মরার ওই লড়াইয়ে কেউ এমন ঝুঁকি নেয়? এর আগে পিএসজি আর চেলসির বিপক্ষে করেছেন টানা দুই হ্যাটট্রিকও!
অথচ ২০১৭-১৮ মৌসুমের পর রোনালদো ক্লাব ছাড়ার পর জোর শোরগোল উঠেছিল, কী হবে রিয়াল মাদ্রিদের? কারণ টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পেছনের কারিগর তো রোনালদোই ছিলেন। বেনজেমা যতখানিই খেলেছেন, রোনালদোর অতিমানবীয় পারফর্ম্যান্সে সেটা ম্লান হয়ে গেছে। এমনও হয়েছে, বেনজেমা গোল করে স্কোর লাইনে খানিকটা বদল এনেছেন ঠিকই, কিন্তু দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্সে শেষ ছবিতে ছিলেন রোনালদোই।
পরিসংখ্যানে চোখ বোলালেও একটা পরিস্কার ধারণা পাওয়া যায়। ২০১৭-১৮ মৌসুমে বেনজেমা সব মিলিয়ে ৪৭ ম্যাচে করেছিলেন ১২ গোল। আর সেবার মাদ্রিদে নিজের শেষ মৌসুমে রোনালদো কেবল চ্যাম্পিয়নস লিগেই ১৫ গোলের মালিক। এর আগের মৌসুমে কেবল চ্যাম্পিয়নস লিগেই রোনালদোর ছিল ১২ গোল, ওদিকে সব ধরণের টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ১২ গোল করেছিলেন বেনজেমা।
রোনালদোর মতো গেম চেঞ্জারকে হারানো এক দলকে ঘিরে ‘কী হবে সামনে?’, এমন প্রশ্ন ওঠাটা যে অযৌক্তিক ছিল সেটা বলা সমীচিন নয়। কারণ রোনালদো যাওয়ার পর দুইবার লা লিগার শিরোপা জিতলেও, মাদ্রিদ এবারই প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠেছে। এর নেপথ্যে কিংবা অগ্রভাগ; নায়ক করিম মোস্তফা বেনজেমা।
কীভাবে বদলে গেল বেনজেমার গল্পটা? দুয়োধ্বনি গুলোকে উল্লাসে রুপ দিয়ে কীভাবে হয়ে উঠলেন রিয়াল মাদ্রিদের নয়ন মণি? গোটা একটা ক্লাব এখন স্বপ্ন বুনছে তাকে ঘিরে। চলুন তার এই রোলার কস্টার রাইডে আমরাও শক্ত করে সিটবেল্ট বেঁধে বসে পড়ি।
ফুটবলই ‘কোকো’র ধ্যান জ্ঞান
ফ্রান্সের লিঁও শহরের ব্রন ডিস্ট্রিক্টের টেরালিয়ন এলাকায় আলজেরিয়ান দম্পতি হাফিদ বেনজেমা ও ওয়াহিদা জেবারার সংসার। ১৯৮৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর এই দম্পতির কোলজুড়ে এলো এক পুত্র সন্তান। নাম রাখা হলো করিম মোস্তফা বেনজেমা। চার বোন, তিন ভাই নিয়ে তাদের বিশাল সংসার। কিন্তু যে এলাকায় বেড়ে উঠেছেন তার আবার মারাত্মক কুখ্যাতি ছিল নিরাপত্তার বিচারে। হাউজিং সোসাইটিতে থাকতেন বলে স্বভাবে চুপচাপ, শান্ত বেনজেমার ওপর সেটা প্রভাব ফেলেনি। এর পেছনে আছে বেনজেমার শৈশব-কৈশোরের ক্লাব এসসি ব্রন টেরালিঁওনের কোচদের। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল বেনজেমার মতো তরুণদের ঠিক পথে রাখা
সেই মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই ফুটবলের সাথে পথচলা শুরু বেনজেমার। নিয়ম কানুন কতটা মেনে চলতেন তিনি? এই প্রসঙ্গে বলেছেন বেনজেমার প্রথম কোচ ফ্রেডেরিখ রিগোলেট, ‘ওকে আমরা কোকো বলে ডাকতাম। এই ডাকনাম কেবল ওর কাছের লোকেরাই জানত। যে এলাকায় ও বেড়ে উঠেছে সেখানে পা হড়কানোর সুযোগ অনেক বেশিই ছিল। কিন্তু সারাদিন ফুটবল নিয়েই মেতে থাকত ও (বেনজেমা)। প্রায় সবসময়ই একটা দেয়ালের দিকে বল কিক করতো, থামার কোনো নামই নিত না। বরং আমাকেই বলতে হতো, করিম যাও টিভি দেখো গিয়ে।’
লিঁওতে যাত্রা শুরু
টেরালিওনের হয়ে লিঁওর জুনিয়র একাদশের এক ম্যাচে দুই গোল করে নজর কেড়েছিলেন বেনজেমা। লিঁওর স্কাউট তার খেলা দেখে এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, বেনজেমাকে সরাসরি দলে টেনে নেন তখন। ফরাসি ক্লাবটির হয়ে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে জায়গা করে নেন মূল দলে। বেনজেমার চ্যাম্পিয়নস লিগ অভিষেকও হয়েছে লিঁওর জার্সিতেই।
সেই ক্লাবে বেনজেমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন তার সতীর্থ অ্যান্থনি মুনির। বেনজেমার নিজেকে ছাপিয়ে যাওয়া মানসিকতার শুরুর দিকের স্বাক্ষী তিনিই। লিঁওতে যিনি আবার ছিলেন ‘নাম্বার নাইন’। শুরুতে ৪৪ নম্বর জার্সি পরে খেলতেন বেনজেমা; যেটা একদমই পছন্দ ছিল না তার। তাই একদিন ড্রেসিংরুমে ফিরে মুনিরকে বলে বসেন, ‘এই ৪৪ নম্বর জার্সি নিয়ে আমি খেলতে পারব না। আমার ৯ নম্বর জার্সিটাই লাগবে।’
অর্থাৎ সেই তরুণ বয়স থেকেই বিশ্বসেরা স্ট্রাইকারদের মধ্যে নিজেকে নিয়ে যাওয়ার সকল চেষ্টাই ছিল তার মধ্যে। সেই চেষ্টা আর নাছোড়বান্দা মানসিকতার প্রতিফলনই আজ স্পষ্ট প্রতীয়মান।
রোনালদোর ছায়ায় জীবন, অতঃপর তারই অভাব পূরণ
বেনজেমার ক্লাব ক্যারিয়ার দুই ক্লাবেই সীমাবদ্ধ। লিঁওতে পাঁচ মৌসুম কাটিয়ে ২০০৯ সালে রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন তিনি। সেবার ৩৫ মিলিয়ন ইউরোতে মাদ্রিদে এসেছিলেন তিনি। মাদ্রিদের তৎকালীন সভাপতি রোমান ক্যালদেরন অনেকদিন ধরেই চোখে চোখে রেখেছিলেন তাকে। মূলত চ্যাম্পিয়নস লিগে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে তার পারফর্ম্যান্সই মনে ধরেছিল ক্যালদেরনের। সেই মৌসুমেই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড থেকে রিয়াল মাদ্রিদ দলে ভিড়িয়েছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোকে। একইদিনে দুজনকে হাজির করা হয়েছিল উন্মাতাল বার্নাব্যুতে। দুজনের জুটিও জমেছিল বেশ। রিয়ালের হয়ে ৪৫০ গোল করা রোনালদোকে সবচেয়ে বেশি ৪৭টি এসিস্ট করেছেন বেনজেমা।
স্পেনে প্রথম মৌসুমটা বেনজেমার কেটেছে মানিয়ে নিতেই। ৩৩ ম্যাচে করেছিলেন ৯ গোল। এরপর অবশ্য এত কম গোল ট্যালি দেখতে হয়নি বেনজেমাকে। পরের মৌসুমেই গোল সংখ্যা বেড়েছিল প্রায় তিন গুন; ২৬টি। কিন্তু রোনালদো করেছিলেন ৫৩ গোল। তখন থেকেই রোনালদোর আড়ালে পড়া শুরু বেনজেমার।
এতে অবশ্য আখেরে বড় লাভটা হয়েছে বেনজেমারই। দীর্ঘদিন রোনালদোর ছায়াবন্দি হয়ে থাকলেও ক্রমেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তিনি। রোনালদো মাদ্রিদ ছেড়ে গেছেন প্রায় চার বছর আগে। এই চার বছরে রোনালদোর বিশাল ছায়াটা সরেছে। বেনজেমাও ফুটে উঠেছেন দারুণভাবে। নিজেই হয়ে উঠেছেন দলের ‘মেইনম্যান’। মোট ১৩১ গোল করেছেন এই চার মৌসুমে।
********************
আসছে ডিসেম্বর ৩৫-এ পা দেবেন বেনজেমা। তার দিকে তাকালে মনে হয় বয়স কেবলই একটা সংখ্যা। জীবনযাত্রাতেও এনেছেন বড়সড় পরিবর্তন। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে তার খাদ্যাভাসে। পুরো পরিবারের সকলেরই যেকোনো ধরণের জাংক ফুড খেতে মানা। এমনকি বদলে ফেলেছেন খাওয়ার পানিও। ২০১৮ সাল থেকে অ্যালাকালাইন পানি পান করছেন বেনজেমা।
আরও একটা জিনিস খোলনলচে বদলে গেছে। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিটা গায়ে চড়িয়েছেন কত রথী-মহারথী। কিন্তু রোনালদোর মতো প্রভাব বিস্তারি ফুটবলার আর আসেনি। এই পর্তুগীজ হয়ে উঠেছিলেন ক্লাবটির মূর্ত প্রতীক। লোকে বলত, এটা রোনালদোর দল। সেই কথার একটা নাম এখন বদলে গেছে। রোনালদোর জায়গায় ক্লাবের প্রতিশব্দ হয়ে উঠেছেন করিম বেনজেমা। রোনালদোর অভাবটা তিনি বুঝতে দিচ্ছেন কই?
এই মৌসুমটা স্বপ্নের মতো কাটছে বেনজেমার। কার্লো আনচেলত্তির অধীনে সব মিলিয়ে করেছেন ৪৪ গোল। ট্রফি ক্যাবিনেটে উঠেছে এবারের লা লিগ আর সুপারকোপা ডি এস্পানার শিরোপা। অপেক্ষা এবার আরাধ্য চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিটার। সেই যুদ্ধে নামার ঠিক ৯০ মিনিট দূরে আছেন বেনজেমা আর সতীর্থরা।
মাঠ আর মাঠের বাইরে বন্ধুর এক পথ পাড়ি দিয়ে আজকের অবস্থানে এসেছেন বেনজেমা। তার উদ্দেশ্যে ছুটে আসা তিরস্কার-টিটকারির শিস বা হুইসেলগুলোর নতুন রুপ এখন বাঁধনহারা জয় আর অর্জনের উল্লাস। অনেকেই চাইতেন না, বেনজেমাকে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে দেখতে। এখন রিয়াল মাদ্রিদের ঐতিহ্যবাহী সাদা জার্সিতে সবার চোখে মণি হয়ে মাঠ মাতান বেনজেমা।