লিভারপুল-রিয়াল মাদ্রিদের ফাইনালের ভাগ্য ঠিক হতে পারে যে সাত জায়গায়
আবারও চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে মুখোমুখি হতে যাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ ও লিভারপুল। এই টুর্নামেন্টের ইতিহাসে সফলতম দলগুলোর প্রসঙ্গে আনলে প্রথমেই আসবে এই দুই দলের নাম। দুটি ক্লাবের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মহাদেশীয় আভিজাত্য।
ইউরোপীয় ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরের ফাইনালে এ নিয়ে তৃতীয় বারের মতো মুখোমুখি হচ্ছে মাদ্রিদ ও লিভারপুল। আগের দুই ফাইনাল ভিন্ন ভিন্ন কারণে নাম লিখিয়েছে ইতিহাসে। ২০১৮ সালে লিভারপুলকে হারিয়েই থ্রিপিট সম্পন্ন করেছিল মাদ্রিদ। তবে সার্জিও রামোসের জন্য চোট নিয়ে মাঠ ছাড়া মোহামেদ সালাহর জন্য সে ম্যাচ অন্য কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। অপর ফাইনালটি হয়েছিল ১৯৮১ সালে, প্যারিসে। কোনো ইউরোপীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে রিয়াল সর্বশেষ হেরেছিল সেবারই।
আজ কি মাদ্রিদ ১৯৮১ সালের প্রতিশোধ নিবে, না সালাহ প্রতিশোধ নিবেন ২০১৮ সালের হতাশার? উত্তরটা কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আপনিই জানতে পারবেন। তবে শেষ হাসি যারাই হাসুক, সময়ের শ্রেষ্ঠ দুই দলই আজ মুখোমুখি হবে ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে। মৌসুমের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ম্যাচটি শুরুর আগে চলুন দেখে নেওয়া যাক যেই সাত জায়গায় নির্ধারিত হতে পারে এই সম্ভাব্য ক্লাসিকের ভাগ্য-
বেনজেমা বনাম ভ্যান ডাইক: মুখোমুখি দুই বিশ্বসেরা
এক কথায় বিশ্বের সেরা স্ট্রাইকার ও সেরা ডিফেন্ডারের মধ্যকার লড়াই দেখতে যাচ্ছি আমরা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের জন্য এরচেয়ে বড় শিরোনাম আর হতে পারে না।
এই মৌসুমে দুর্দান্ত ছন্দে থাকা করিম বেনজেমা লিগের পাশাপাশি চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও সর্বোচ্চ গোল করেছেন। শুধু চ্যাম্পিয়ন্স লিগেই করেছে ১৫টি গোল (রোনালদোর পর এক আসরে সর্বোচ্চ)। কিন্তু তার এক্সপেক্টেড গোল (এক্সজি) মাত্র ৮ দশমিক ৬। অর্থাৎ, ক্ষুদ্রতম সুযোগ থেকে সবচেয়ে বেশি গোল করেছেন এই স্ট্রাইকার। আজ তাকে সামলানোর দায়িত্ব পড়বে ভার্জিল ভ্যান ডাইকের উপর।
দীর্ঘ ইনজুরি থেকে ফিরলেও এ মৌসুমে মাঠের ফুটবলে নিজের সেরাটাই দিয়েছেন ভ্যান ডাইক। রক্ষণে তার দানবীয় অবস্থানের জন্যই এবার কোয়াড্রপলের স্বপ্ন দেখতে পেরেছে লিভারপুল। শেষ ম্যাচেও তার চৌকসতার উপর নির্ভর করতে হবে অলরেডদের।
উইংয়ে গতির লড়াই: ভিনি বনাম ট্রেন্ট, ডিয়াজ বনাম কারবাহাল
সুযোগ পেলে লিভারপুলের দুই ফুলব্যাক অনায়াসে পুরো ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। এজন্য, অনেক চৌকস ম্যানেজারই এই দুই ফুলব্যাককে চাপে রাখার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ডকে।
নাপোলির ম্যানেজার থাকাকালীন এই লিভারপুলের সঙ্গেই টানা দুবছর চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মুখোমুখি হয়েছিলেন কার্লো আনচেলত্তি। প্রতিবারই ট্রেন্টের পাশ দিয়ে আক্রমণ করাটাকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন। তার এই গেমপ্ল্যান অনেকাংশে সফলও হয়েছে। এমনকি জিনেদিন জিদানও গতবছর লিভারপুলের বিপক্ষে গেমপ্ল্যান সাজিয়েছিলেন ট্রেন্টকে কেন্দ্র করে। সেবার ট্রেন্টকে ছাড়িয়ে দুটি গোল দিয়েছিলেন ভিনিসিয়াস জুনিয়র। আজকের ম্যাচেও রিয়ালের এই গেমপ্ল্যান নিয়ে নামার সম্ভাবনাই বেশি। এছাড়া, লিভারপুলের হাইলাইনকে কাবু করার জন্যও সবচেয়ে সহজ তরিকা এটি।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে ইয়ুর্গেন ক্লপকে উইঙ্গারদের মতো ফুলব্যাকদের পজিশনেও ফ্লুয়িডিটি আনার চেষ্টা চালাতে দেখা গেছে। আক্রমণের সময় ট্রেন্ট যখন সেন্টার মিডফিল্ড বা আরও সামনে চলে আসেন, তখন রাইটব্যাক পজিশনে চলে যান জর্ডান হেন্ডারসন। আজকেও ভিনিকে আটকাতে এভাবে পরিকল্পনা সাজাতে পারে লিভারপুল।
মাঠের অপর উইংয়ে দেখার মতো একটি লড়াই হবে লুইস ডিয়াজ ও দানি কারবাহালের মধ্যে। জানুয়ারি মাসে যোগ দিয়ে দলের আক্রমণভাগের রূপ বদলে দেওয়া ডিয়াজ বল ধরে রাখা এবং ড্রিবল করায় বেশ পারদর্শী। সাথে চিতার মতো গতি তো আছেই। তাই সালাহ-মানের পাশাপাশি ডিয়াজকে নিয়েও বাড়তি সতর্ক থাকতে হবে কারবাহাল ও রিয়াল মাদ্রিদ রক্ষককে।
মিডফিল্ডের দাদাগিরি
গত ছয়-সাত বছরে মাদ্রিদকে অসংখ্য ম্যাচ জেতানো ক্রুস-মদ্রিচ-ক্যাসেমিরোর মিডফিল্ডকে এ ম্যাচেও স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় দেখা যাবে। ২০১৮’র ফাইনাল ও গতবছরের সেমিতে মূলত মধ্যমাঠের লড়াইয়েই রিয়ালের কাছে হেরেছিল লিভারপুল। তবে এই মুহূর্তে রিয়ালের অভিজ্ঞ মিডফিল্ড ত্রয়ীর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার মতো কোনো মিডফিল্ড বিশ্ব ফুটবলে থেকে থাকলে সেটি লিভারপুলেরই। ফ্যাবিনহো-হেন্ডারসন-থিয়াগো/কেইটার মিডফিল্ড এ মৌসুমে প্রায় সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। প্যারিসেও তারা এই ছন্দ ধরে রাখতে পারে কি না, সেটিই এখন দেখার বিষয়।
বদলি খেলোয়াড়
পাঁচ সাবস্টিটিউটের সুবিধা সবচেয়ে বেশি লুফে থাকে ট্যাকটিকাল ম্যানেজার ও বেঞ্চ-ভারী দলগুলো। ফাইনালের দুই দল এই কাতারে পড়ে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, একজন বদলি খেলোয়াড়ই সেমিফাইনালে রিয়ালের ভাগ্য বদলে দিয়েছিল। অন্তিম সময়ে দুই মিনিটে দুই গোল দিয়ে দলকে প্রায় অসম্ভব এক কামব্যাক উপহার দেওয়া রদ্রিগো আজও নামতে পারেন বদলি হিসেবে। এছাড়া কোয়ার্টার ও সেমিতে বদলি নেমে দলের মিডফিল্ড নিয়ন্ত্রণ করা কামাভিঙ্গাকেও একই ভূমিকা পালন করতে দেখা যেতে পারে আজ।
এদিকে লিভারপুল মূল একাদশের সহায়তাতেই মৌসুমের সিংহভাগ ম্যাচ জিতেছে। তবে যখন প্রয়োজন পড়েছে, বেঞ্চ থেকে নেমে ক্লপের বদলি খেলোয়াড়েরাও গড়ে দিয়েছেন ম্যাচের ভাগ্য। ইন্টারের বিপক্ষে ফিরমিনো, বা উলভসের বিপক্ষে অরিগি তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ। অলরেডদের রিজার্ভ বেঞ্চও বেশ শক্তিশালী। আজ এই বেঞ্চে দেখা যেতে পারে ফিরমিনো, জোটা, কেইটা, মিলনার, সিমিকাস, মিনামিনো ও অরিগিদের।
সেট পিস
এবারের আসরে সেট পিস থেকে সবচেয়ে বেশি গোল দেওয়া দলটির নাম লিভারপুল। ডেড বল থেকে তাদের দেওয়া ৮টি গোলের ৭টিই এসেছে কর্নার থেকে। ট্রেন্টের ফ্রিকিক বা কর্নারের সময় মানে, ভ্যান ডাইক, কোনাতে বা মাতিপ আজ মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে রিয়ালের জন্য।
তবে এবারের আসরে সেট পিস থেকে সবচেয়ে কম গোল খাওয়া দলটির নাম আবার রিয়াল মাদ্রিদ। পুরো আসরে সেটপিস থেকে মাত্র একটি গোল খাওয়া থিবো কর্তোয়া সংখ্যাটা আজ আর বাড়াতে চাইবেন না অবশ্যই।
টাইব্রেকার
নির্ধারিত সময়, অতিরিক্ত সময় পেড়িয়ে ম্যাচ টাইব্রেকারে যাওয়ার একটি ক্ষুদ্র সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে একটু বাড়তি সুবিধা পেতে পারে লিভারপুল। মৌসুমে ইতোমধ্যে দুটি ফাইনাল খেলা লিভারপুল দুবারই জিতেছে টাইব্রেকারে। একটি নিওরোসায়েন্স দলের সাহায্য নিয়ে টাইব্রেকারের পরিকল্পনা সাজানো লিভারপুল তাই এই খাতে মানসিকভাবে এগিয়ে থাকতে পারে।
তবে এই টুর্নামেন্টে ঐতিহাসিকভাবে ভালো করে আসা রিয়ালেরও আছে একাধিক টাইব্রেকার জেতার দৃষ্টান্ত। বেনজেমারা মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকবেন, সেটাও বলা যাচ্ছে না।
আগে গোল দেওয়া (বা না দেওয়া)
যেকোনো ম্যাচেই আগে গোল দেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। সেটা কোনো ফাইনাল হলে তো কথাই নেই। কিন্তু এই দুই দলের হিসেব একটু ভিন্ন। লিভারপুল তাদের সর্বশেষ ছয় ম্যাচের পাঁচটিতেই প্রথমে গোল খেয়ে পিছিয়ে পড়েছিল। এবং সবকটিতেই কামব্যাক করে ফলাফল এনেছে তারা। এদিকে, রিয়াল মাদ্রিদ নকআউট পর্বের সব ম্যাচই জিতেছে দুর্দান্ত সব কামব্যাকের মাধ্যমে। সুতরাং আগে গোল দেওয়াটাকে যেমন প্রাধান্য দেবে দুই দল, তেমনি প্রাধান্য দেবে একবার এগিয়ে যাওয়ার পর লিড ধরে রাখাটাকে।