রিয়ালের প্যারিস জয়: কেন ১৪তম চ্যাম্পিয়ন্স লিগ মাদ্রিদিস্তাদের জন্য 'ভেরি ভেরি স্পেশাল'?
চ্যাম্পিয়নস লিগের ওপর আরও কারও এমন অধিকার নেই। সাদা জার্সি মানেই ইউরোপের রাজা, সেটা আরও একবার দেখাল রিয়াল মাদ্রিদ। এই দশকে যারা রিয়াল সমর্থক, তাদের এই শিরোপা উৎসব দেখা মোটামুটি অভ্যাসই হয়ে গেছে। অনেক অপেক্ষার পর সেই ২০১৪ এর লা ডেসিমা দিয়ে শুরু। এরপর জিনেদিন জিদানের সময় হ্যাটট্রিক চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর আবার আনচেলত্তির হাত ধরে এলো ১৪অম শিরোপা। কিন্তু নানা কারণেই এই শিরোপার অনুভূতি আলাদা, রিয়াল ভক্তরা বলবেন হয়তো ছাড়িয়ে গেছে আগের সব অনুভূতিকে। সেই কারণগুলো একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক
জিরো থেকে হিরো
চ্যাম্পিয়নস লিগের এবারের অভিযানের শুরুতেই অখ্যাত ক্লাব শেরিফ তিরাসপোলের কাছে হেরে গেল রিয়াল। মলদোভার এই ক্লাবের নামই কেউ শোনেনি তেমন, রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল তারা। এরপর ইন্টার, শেরিফ ও শাখতারকে হারালো টানা চার ম্যাচ। সবার ওপরে থেকেই রিয়াল জায়গা করে নিল নকআউট পর্বে। সেখানে আরেক গল্প
ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
নকআউট পর্বের শুরুতেই নাটক। শেষ ১৬ এর ড্রতে রিয়ালের প্রতিপক্ষ বেনফিকা। কিন্তু ইউয়েফার হাস্যকর এক ভুলে সেই ড্র বাতিল হয়ে গেল। নতুন করে আবার ড্র, এবার রিয়ালের প্রতিপক্ষ পিএসজি। চ্যাম্পিয়নস লিগের ওপর অনেক দিন ধরেই চোখ তাদের, এবার নিয়ে এসেছিল লিওনেল মেসিকেও। শেষ ১৬তে ড্রটা এর চেয়ে কঠিন সম্ভবত হতে পারত না। প্রথম লেগে ১-০ গোলে হেরে গেল রিয়াল। দ্বিতীয় লেগে এমবাপের গোলে বার্নাব্যবুতে পিছিয়ে পড়ল আবার। সেখান থেকে শুরু করিম বেনজেমার ম্যাজিক। ১৭ মিনিটের মধ্যে তিন গোলে পিএসজি বুঝল বার্নাব্যুতে ৯০ মিনিট অনেক লম্বা সময়।
শেষ আটে আবার কঠিন প্রতিপক্ষ, আগেরবারের চ্যাম্পিয়ন চেলসি। থমাস তুখেলের দল স্টামফোর্ড ব্রিজে হেরে গেল ৩-১ গোলে। এবার বার্নাব্যুতে রিয়ালের জয়টা মনে হচ্ছিল সময়ের ব্যাপার। কিন্তু চেলসি হাল ছাড়েনি, ৭৫ মিনিটের মধ্যে তিন গোল করে এগিয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত রদ্রিগো সমতা ফিরিয়ে ম্যাচ নিয়ে গেলেন অতিরিক্ত সময়ে, সেখানে আবার বেনজেমার জাদু। এবার কানের পাশ দিয়ে গুলি গেল রিয়ালের।
আর সেমিতে যা হয়েছে, সেটা মনে থাকবে সবার। সম্ভাব্য সবচেয়ে কঠিন প্রতিপক্ষ ম্যান সিটি প্রথম লেগ জিতল এক গোলের ব্যবধানে। দ্বিতীয় লেগে এক গোলে পিছিয়ে থেকে রিয়ালের হার যখন সময়ের ব্যাপার, রদ্রিগো উড়ে এসে দুই গোল করে ম্যাচ নিয়ে গেলেন অতিরিক্ত সময়ে। আবার বেনজেমায় উদ্ধার, সম্ভবত আর কোনো দলকে ফাইনালে যেতে এত কঠিন তিন ম্যাচ খেলতে হয়নি। এই ফাইনালটা তাই রিয়ালের কাছে বিশেষই।
প্রতিজ্ঞা > প্রেসিং
ফাইনালটা যারা দেখেছেন, তারা সবাই একবাক্যে স্বীকার করবেন থিবো কোর্তোয়া মার্ভেল কমিকসের কোনো সুপারহিরো হয়ে না দাঁড়ালে রিয়ালের ম্যাচটা জেতা হতো না। গোলে একের পর এক সুযোগ তৈরি করে গেছে রিয়াল, আলাবা-মিলিতাওরা দাঁতে দাঁত কামড়ে ডিফেন্ড করে গেছেন। কিন্তু তারপরও লিভারপুল সুযোগ পেয়েছিল অনেক, কিন্তু সালাহ-মানেদের কোনো সুযোগ দেননি কোর্তোয়া। উড়ে গিয়ে আনগুলের ডগায় বা লম্বা পায়ে ঠেকিয়ে দিয়েছেন বার বার। মন্ত্র জপে দিয়েছেন, গোল খাওয়া যাবে না। ট্যাকটিক্যালি পিছিয়ে থাকার পরেও এই গোল না খাওয়ার, জয়ের এই তীব্র ইচ্ছাই সম্ভবত রিয়ালকে এগিয়ে রেখেছে। সেজন্যই হয়তো পুরো মৌসুমে কারভাহালকে সেভাবে খুঁজে না পাওয়া গেলেও ফাইনালে গিয়ে নিজের সেরা খেলাটা দিয়েছেন। এই প্রতিজ্ঞার জন্যই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে গেছে রিয়াল। লিভারপুল প্রেসিং ঝড় সামলে শেষ পর্যন্ত তারাই জিতেছে।
প্রতিশোধ, প্রতিশোধ!
বড় ম্যাচের আগে কথার লড়াই অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই ম্যাচের আগে সেটা একটু বেশিই হয়েছে। মো সালাহ বলেছিলেন লিভারপুল ২০১৮ ফাইনালের প্রতিশোধ নিতে চায়। সেবার কাঁধের চোটে ফাইনাল শেষ হয়ে গিয়েছিল সালাহর আগেই, ব্যথাটা ভোলেননি। কোর্তোয়া, কারভাহালও তো জবাব দিয়েছেন সালাহকে। শেষ পর্যন্ত জেতে এক দলই, এরপর সালাহর মুখই বন্ধ হয়ে গেছে। দুই কোচ আগুনে ঘি না ঢাললেও ম্যাচের আগে এসব কথা যোগ করেছে নতুন অনুষঙ্গ।
এবং এমবাপ্পে
রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের জন্য গত কিছু দিন ছিল কঠিন। অনেক নাটকের পর কিলিয়ান এমবাপে না আসাটা তাদের কাছে ছিল চমক। পাকা কথা দিয়েও এমবাপের মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার অভিজ্ঞতা রিয়ালের মতো ক্লাবের কাছে অভিনব, সমর্থকদেরও সেটা হজম করা কঠিন ছিল। এমনকি বেনজেমাদেরও ফাইনালের আগে এমবাপেকে নিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। মাঠের বাইরের এসব ‘ডিসট্র্যাকশন’ খেলায় কোনো প্রভাব ফেলবে কি না, এ নিয়ে সামান্য সংশয় থাকে বেনজেমারা সব উড়িয়ে দিয়েছেন। রিয়াল সমর্থকরা আরেকবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, এমবাপেকে তাদের দরকার নেই। তাকে ছাড়াই তারা লা লিগা জিততে পারে, ইউরোপের রাজা হতে পারে এমবাপে না আসলে রিয়ালের ক্ষতি নেই, তারই ক্ষতি। অন্তত এই জবাবটা দেওয়ার জন্য এই চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতা খুব করে দরকার ছিল তাদের।