অধিনায়ক মুমিনুল:সংকটে শুরু, ফর্মহীনতায় শেষ
এমন এক সময়ে মুমিনুল হককে বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক করা হয়েছিল যখন তিনি নিজেও হয়ত ছিলেন না সেটার জন্য প্রস্তুত। সাকিব আল হাসান বিতর্কের পিঠে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটকে পরিবর্তন করার গুরুদায়িত্ব যখন তার কাধে সঁপে দেওয়া হয়েছিল তখন অনেক সমসাময়িক ও সাবেক ক্রিকেটাররাই তার প্রতি আস্থা জ্ঞ্যাপন করেছিলেন। সেই আস্থার প্রতিদান মুমিনুল দিতে পেরেছেন কি না তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, প্রশ্ন থাকতে পারে আদৌতে তিনি কখনও অধিনায়কত্বের জন্য যোগ্য ছিলেন কি না। সেখান থেকেই প্রশ্ন আসে বিসিবির সিদ্ধান্তহীনতা বা সিদ্ধান্ত নিয়েও। তবে প্রশ্ন যতই থাকুক, মাঠের বাইরে মুমিনুলের কথাবার্তা নিয়ে যতই হাস্যরস কিংবা বিরক্তির উদ্রেক হোক মুমিনুলের অধীনে পাওয়া তিন জয়ের একটি যে বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসেরই সবচেয়ে বড় সাফল্য সেটা নিয়েও সন্দেহের অবকাশ নেই। চড়াই উতরাই, তর্ক-বিতর্ক, সমালোচনায় টালমাটাল ১৭ টেস্টব্যাপী মুমিনুলের অধিনায়কত্বের সময়কালটা আরও একবার ঘুরে আসা যাক।
২৯ অক্টোবর, ২০১৯: মুমিনুলের অধিনায়কত্বের অভিষেক
মুমিনুলের অধিনায়কত্বের শুরুই হয়েছিল কঠিন এক পরীক্ষা দিয়ে - ভারতের মাটিতে দুই মাচের সিরিজ দিয়ে। এর মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল আবার দুই দলের জন্যই প্রথম দিবারাত্রির টেস্ট। পরাক্রমশালী ভারতের বিপক্ষে জয়ের আশা কেউই করেনি। তবে দ্বিতীয় টেস্টে পিঙ্ক বলে যে এভাবে নাকানিচুবানি খাবে বাংলাদেশ সেটাও বোধহয় খুব বেশি মানুষ কল্পনা করেনি। প্রথম সিরিজেই ভরাডুবির পরেও সমর্থকরা মুমিনুলের অধিনায়কত্বকে শূলে চড়ায়নি মূলত ব্যাটিং ব্যর্থতায় দুই টেস্টে শোচনীয় পরাজয়ের জন্য। তার ওপর সাকিবের এক বছরের নিষেধাজ্ঞার পিঠে চড়ে পাওয়া আকস্মিক অধিনায়কত্বের দায়িত্ব যে বড়ই কঠিন হয়ে উঠবে, সেই দিকটাও ছিল বিবেচনায়।
অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুলের প্রথম জয়
২০২০ সালে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজ দিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পান মুমিনুল। অনুমিতভাবেই সেই সিরিজের একমাত্র ম্যাচ দিয়েই শুরু হয় অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুলের জয়যাত্রা। একইসাথে ওই ম্যাচেই অধিনায়ক হিসেবে প্রথম সেঞ্চুরি পান মুমিনুল, যা দিয়ে বাংলাদেশের তৎকালীন সর্বোচ্চ সেঞ্চুরিয়ান তামিম ইকবালের ৯ সেঞ্চুরির রেকর্ডে ভাগ বসান তিনি।
কোভিড পরবর্তী প্রথম সিরিজ ও এক অনাকাঙ্খিত ওয়াটওয়াশ
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারীতে ঘরের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে মুমিনুলের সামনে আসে আরও কিছু জয় লুফে নেওয়ার সুযোগ; সেই সাথে সুযোগ আসে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পয়েন্টের খাতা খোলার। বেশ কিছু নতুন খেলোয়াড় নিয়ে ঢেলে সাজানো এক টেস্ট দল নিয়ে হাজির হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশের পক্ষেই ছিল বেশিরভাগের বাজি। তবে পাশার দান উলটে এই সিরিজ দিয়েই প্রথম প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসে মুমিনুলের অধিনায়কত্বের পাশে। প্রথম টেস্টে এশিয়ার মাটিতে সর্বোচ্চ রান তাড়ার রেকর্ড গড়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ; একইসাথে কাইল মেয়ার্স ২১০* রানের অবিস্মরণীয় এক ইনিংস খেলে গড়েন অভিষেকেই চতুর্থ ইনিংসে সর্বোচ্চ রানের ইনিংসের রেকর্ড। মেয়ার্স ও এনক্রুমাহ বনারকে থিতু হতে দেওয়ার সুযোগ মুমিনুল করে দিয়েছিলেন রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্ব দিয়ে, অনেকের অভিযোগ ছিল এমনটাই।
দ্বিতীয় টেস্টেও বাংলাদেশের সামনে যে ক্যারিবিয়ানরা ২৪৮ রানের লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছিল, সেখানেও উঠেছিল তাদের আরও আগে গুটিয়ে ফেলায় অপারদর্শিতা নিয়ে প্রশ্ন। মুমিনুলের অধীনে বাংলাদেশের ভয়াবহ কিছু দ্বিতীয় ইনিংস ধসের শুরুটাও যেন সেই ম্যাচ দিয়েই। ২৪৮ রানের লক্ষ্যে আকস্মিক এক ধসে আরও একবার ওয়াইটওয়াশের শিকার হন মুমিনুল, তবে এবার ঘরের মাটিতে।
শ্রীলঙ্কায় ভরাডুবি
শ্রীলঙ্কা গিয়ে ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রথম টেস্টে শুরুটা হয়েছিল মনমতো। নাজমুল হোসেন শান্ত’র দারুন সেঞ্চুরির পাশাপাশি বিদেশের মাটিতে অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুল পেয়েছিলেন প্রথম সেঞ্চুরি। পাল্লেকেলের মরা পিচ থেকে অবশ্য ফিরতে হয়েছিল ড্র নিয়েই। তবে একই মাঠে দ্বিতীয় টেস্টে স্পিন বান্ধব পিচ বানানো হলে আরও একবার ব্যাটিং ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের। স্পিন বান্ধব পিচ পড়তে ভুল করে একজন কম স্পিনার কম নিয়ে খেলেছিলেন। তবে একজন স্পিনার কম পড়ে গিয়েছে এরকম কথা উড়িয়ে দিয়ে সেবার কড়া সমালোচনা সইতে হয় মুমিনুলকে।
আবারও স্বস্তি জিম্বাবুয়েতেই
জুলাই মাসে জিম্বাবুয়েতে এরপর এক টেস্ট খেলেছিল বাংলাদেশ, যেটাতে অনুমিতভাবেই জয় পায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের হয়ে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ সেই ম্যাচ দিয়ে টেস্ট ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর ম্যাচে ব্যাট হাতেও ত্রাণকর্তার ভুমিকায় পালন করেছিলেন। অধিনায়ক মুমিনুলও পেয়েছিলেন কিছুটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচার সুযোগ।
ঘরের মাঠে পাকিস্তানের কাছে কাবু
দীর্ঘ বিরতির পর ২০২১ সালের নভেম্বরে ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজ খেলতে নামে বাংলাদেশ। পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ যে কঠিন হবে এটা নিয়ে ছিল না কোনও সন্দেহ। তবে এই সিরিজেও বাংলাদেশ স্থাপন করে ভয়াবহ ব্যাটিং ধসের নিদর্শন। সেই সাথে মুমিনুলের রক্ষণাত্মক অধিনায়কত্বকে শূলে চড়ানো হয়। প্রথম টেস্টে লিড নিয়েও দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫৭ রানে গুটিয়ে যাওয়াতে বরণ করতে হয়েছিল ৮ উইকেটের পরাজয়। তবে দ্বিতীয় টেস্টটা ছিল চূড়ান্ত লজ্জাজনক। বৃষ্টিতে টেস্টের প্রায় আড়াই দিন ভেসে গেলেও দেশের মাটিতে নিজেদের সর্বনিম্ন দলীয় সংগ্রহ ৮৭ রানের লজ্জাস্কর রেকর্ড গড়ে ওয়াইটওয়াশ হয় বাংলাদেশ।
নিউজিল্যান্ডে ঐতিহাসিক জয়
মুমিনুলের টেস্ট অধিনায়কত্বের সবচেয়ে উজ্জ্বল ও তর্কসাপেক্ষে বাংলাদেশ ক্রিকেটেরই সবচেয়ে বড় জয় আসে ২০২২ সালের জানুয়ারিতে। টেস্ট চ্যাম্পিয়নদের তাদের ঘরের মাটিতে তাক করে দিয়ে বাংলাদেশ বাগিয়ে নেয় জয়। অবিস্মরণীয় সেই জয়ের পর বাংলাদেশের সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটাররা ছিলেন মুমিনুলের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। প্রথম ইনিংসে আশি-পেরুনো গুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস খেলে জয়ে ব্যাট হাতেও মুমিনুলের ছিল বড় অবদান। তবে দ্বিতীয় টেস্টে বাংলাদেশ ফিরল সেই পুরনো জরাজীর্ণ দশাতেই। তা সত্ত্বেও ঐতিহাসিক এক সিরিজ ড্র দিয়ে অধিনায়ক মুমিনুলের অধিনায়কত্বের পালে লাগে নতুন হাওয়া।
দুর্বিষহ দক্ষিণ আফ্রিকা সফর
ব্যাট হাতে পড়তি ফর্ম ও মাঠের বাইরে বিদঘুটে সব সংবাদ সম্মেলনের কারণে এই সিরিজ দিয়েই মূলত সমর্থকদের রোষানলে পড়েন মুমিনুল। মার্চ থেকে এপ্রিলের মাঝে দুই টেস্টেই দ্বিতীয় ইনিংসে ভরাডুবি হয় বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের। স্পিন বিষে বাংলাদেশকে কাবু করে ওয়াইটওয়াশ করে দক্ষিণ আফ্রিকা। তবে প্রথম টেস্টে পিচ পড়তে ভুল করা ও মাহমুদুল হাসান জয়ের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে সেই আক্ষেপ আরও বেড়ে যাওয়ার পরেও সিরিজ জুড়ে অধিনায়কের কিছু কথাবার্তা অনেকের কাছেই অপেশাদার লেগেছিল।
ঘরের মাঠে শ্রীলঙ্কার কাছে পরাজয় এবং মুমিনুল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি
সব সমালোচনার জবাব দেওয়ার আরও একটি সুযোগ মুমিনুল পেয়ে যান ঘরের মাঠে। মাথার ওপর অধিনায়কত্ব থেকে অপসারণের খড়গ নিয়ে অবশ্য ব্যাট হাতে মুমিনুল কাটান ভয়াবহ এক ম্যাচ; পেয়ে যান পেয়ারের দেখা। মুশফিকুর রহিম ও লিটন দাসের দারুণ ব্যাটিংয়ে সেই টেস্ট থেকে শেষমেশ ড্র নিয়েই ঢাকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ান মুমিনুল। তবে দ্বিতীয় টেস্টে দৃশ্যপটে আসে পরিবর্তন। লিটন ও মুশফিকে ভর করে আরও একবার ধস এড়ানোর পর শ্রীলঙ্কাকে একেবারেই চেপে ধরতে পারেনি বাংলাদেশ। অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউজ ও দীনেশ চান্ডিমালের জন্য আরও কঠিন ফিল্ডিং সাজানো যেত কি না, এমন প্রশ্নের ঘুরপাকের মাঝেই বাংলাদেশ পড়ে আরও একটি ব্যাটিং ধসের কবলে। সাকিব-লিটন এরপর টেস্টের সময়সীমাই শুধু বাড়িয়েছেন। শ্রীলঙ্কার ১০ উইকেটের জয়ের পর তুমুল প্রশ্ন উঠে মুমিনুলের অধিনায়কত্ব নিয়ে। সেসব প্রশ্নের বাণে জর্জরিত মুমিনুল নিজের ব্যাটিং নিয়েও হয়ে পড়েন শঙ্কিত। সেই শঙ্কা থেকেই বোর্ড সভাপতির সাথে বৈঠক সাপেক্ষে অধিনায়কত্ব থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন মুমিনুল; বাংলাদেশের টেস্ট আঙিনায় শেষ হয় মুমিনুল অধ্যায়।