রবিন হুডের নটিংহামে যেভাবে হলো রূপকথা
নটিংহামশায়ারের শেরউড জঙ্গল। গরিবের বন্ধু খ্যাত রবিন হুডকে মনে রাখতে এতটুকুই যথেষ্ট। ইংরেজ উপকথার দারুণ এই তীরন্দাজের কথা আজও মুখে মুখে ফেরে। যুগে যুগে তাকে নিয়ে ছড়িয়েছে কত গল্প, পর্দায় এসেছে কত সিনেমা। সেই রবিন হুডের শহরেই যাত্রা শুরু করেছিল ফুটবল ক্লাব; নটিংহাম ফরেস্ট। ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় প্রবীণতম এই ক্লাবের পথচলা আর ঘুরে দাঁড়ানোর গল্পটা রবিন হুডের সিনেমা কিংবা গল্পের মতোই রোমাঞ্চকর।
প্রায় দুই যুগ পর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে ফিরেছে নটিংহাম ফরেস্ট। সর্বশেষ ১৯৯৯ সালে প্রিমিয়ার লিগে দেখা গিয়েছিল দলটিকে। সেই মৌসুমে লেস্টার সিটিকে ১-০ গোলে হারিয়েও রেলিগেশনে পড়ে। নেমে যায় ইএফএল চ্যাম্পিয়নশিপে।এরপর থেকে ইংল্যান্ডের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলে আর দেখা যায়নি তাদের। তবে ফিরে আসার দারুণ এক গল্প লিখেছে নটিংহাম। ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়নশিপের প্লে অফে ফাইনালে হাডার্সফিল্ডকে হারিয়ে ২৩ বছর পর প্রিমিয়ার লিগে পুনর্জন্ম ক্লাবটির।
মাঝের এই ২৩ বছর কেমন কেটেছে নটিংহামের? শুরুটাই বা কেমন ছিল? গত ২৩ বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে, ফুটবলের নিয়ম কানুনেও এসেছে পরিবর্তন। কিন্তু বদলায়নি নটিংহাম ফরেস্ট আর ক্লাবটির ভক্তদের স্বপ্ন-প্রত্যাশা। সেই স্বপ্ন এখন সত্যি। অপেক্ষা এবার নতুন মৌসুমের। বিশ্বের প্রাচীনতম ক্লাবগুলোর একটি নটিংহাম। ১৫৭ বছর বয়সী এই ক্লাবটির শুরু জে এস স্ক্রিমশর হাত ধরে। মূলত ১৫ জন শিন্টি খেলোয়াড় নিয়ে গোড়াপত্তন হয়েছিল নটিংহামের। মূলত হকির আদলেই খেলা হয় শিন্টি। নটস কাউন্টি একাদশের বিপক্ষে নিজেদের প্রথম ম্যাচে গোল শূন্য ড্র করেছিল নটিংহাম।
শক্তি-সম্ভাবনা থাকার পরেও প্রথম ডিভিশনে খেলে সাফল্য পায়নি দলটি। টানা ব্যর্থতায় নেমে যায় দ্বিতীয় বিভাগে। সেখানে রীতিমতো বেহাল দশাতে ছিল 'দ্য রেডস' খ্যাত ক্লাবটি। রেডসদের ত্রাণকর্তা হয়ে এসেছিলেন ব্রায়ান ক্লাফ। তার হাত ধরেই বদলে যেতে শুরু করে নটিংহাম। ক্লাফ আর নটিংহাম হয়ে ওঠে অবিচ্ছেদ্য জুটি। মিডলসব্রো কাউন্টিতে বেড়ে ওঠা ক্লাফ নিজেও ছিলেন ফুটবলার। এই স্ট্রাইকার ছিলেন মিডলসব্রো, সান্ডারল্যান্ডের মতো ক্লাবে। ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়েও ২ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। ইনজুরির কারণে ফুটবলকে বিদায় বললেও ৩৫ বছর বয়সেই কোচিং শুরু করেছিলেন ক্লাফ। হার্টলপুল দিয়ে শুরু করে যেটা থেমেছে নটিংহামের ডাগ আউটে।
যখন নটিংহামের দায়িত্ব নেন তখন দ্বিতীয় বিভাগে রীতিমতো ধুঁকছে দলটি। স্কোয়াড গুছিয়ে সেখান থেকে নটিংহামকে তোলেন প্রথম বিভাগে। সঙ্গী ছিলেন পিটার টেইলর। ১৯৭৭-৭৮ সালের সেই মৌসুমেই বাজিমাত ক্লাফ বাহিনির। দারুণ ছন্দে থাকা লিভারপুলকে হারিয়ে জিতে নেয় লিগ শিরোপা। পরের মৌসুমে মালমোকে ১-০ গোলে হারিয়ে ইউরোপিয়ান কাপও জিতেছিল ক্লাফের দল।
ক্লাফের নটিংহামের এই স্বপ্নযাত্রা অব্যাহত ছিল পরের মৌসুমেও। লিগ না জিতলেও টানা ৪২ ম্যাচে অপরাজিত ছিল নটিংহাম। ট্রফি ক্যাবিনেটে উঠেছিল আরও তিনটি শিরোপা; লিগ শিরোপা, লিগ কাপ ও ইউরোপিয়ান সুপার কাপ। সম্ভাব্য সকল ট্রফি জেতার পর শুরু হয় ফরেস্টের পতন। ক্লাব ছাড়তে শুরু করেন দলের ভরসা হয়ে ওঠা ট্রেভর ফ্রান্সিস-পিটার শিল্টনদের মতো ফুটবলাররা। অভ্যন্তরীন দ্বন্দ্বে সরে দাঁড়ান সহকারী কোচ পিটার টেলরও। পরের দুই মৌসুমে লিগ কাপ জিতলেও ইউরোপিয়ান ফুটবলের দাপট ধরে রাখতে পারেনি ক্লাফের দল।
১৯৯২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ নামকরণের পর সেই দুর্দশা আরও বেড়েছিল। পরের মৌসুমে নেমে যায় দ্বিতীয় বিভাগে। এমনকি খেলতে হয়েছিল ২০০৫ মৌসুমের তৃতীয় বিভাগের ফুটবলেও। তবে ক্লাবটি সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছে দ্বিতীয় বিভাগের চ্যাম্পিয়নশিপেই।
গত মৌসুমে দলটির দায়িত্ব নেন স্টিভ কুপার। ঘোচান প্রায় দুই যুগের এক অভিশাপ। তার হাত ধরেই ফিরেছে সেই অমূল্য মুহূর্ত, যেটা দেখে যেতে পারেননি ক্লাবটির নানা উত্থান পতনের সাক্ষী হওয়া ব্রায়ান ক্লাফ। ২০০৪ সালে মারা গেছেন তিনি। তবে এই ক্লাবকে খ্যাতির তুঙ্গে নিয়ে যাওয়া ক্লাফ ওপার থেকে নিশ্চয়ই তৃপ্তির হাসি হাসছেন