কীভাবে টেস্টে বাংলাদেশের রোল মডেল হতে পারে নিউজিল্যান্ড?
২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে খোলনলচে বদলে গেছে ইংল্যান্ডের ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ধাঁচ। সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ইংল্যান্ডের বিরাট এই পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে? উত্তরটা হচ্ছে নিউজিল্যান্ড। এবার টেস্ট ক্রিকেটে বিপ্লব আনার জন্য সেই নিউজিল্যান্ডেরই ক্রিকেট কাঠামোর দ্বারস্থ হচ্ছে ইংল্যান্ড।
সবচেয়ে বড় উদাহরণ হিসেবে দেখানো যায় ব্রেন্ডন ম্যাককালামকে টেস্টের প্রধান কোচ হিসেবে ইংল্যান্ডের নিয়োগ দেয়া। নিউজিল্যান্ডকে ২০১২-২০১৬ পর্যন্ত চার বছর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ম্যাককালাম। তার এই ৪ বছরের অধিনায়কত্বে র্যাংকিংয়ে অষ্টম অবস্থান থেকে শীর্ষ তিনে উঠেছিল কিউইরা। উন্নতির সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন ম্যাককালামের স্থলাভিষিক্ত অধিনায়ক কেইন উইলিয়ামসনও।
সবচেয়ে বড় অর্জন, প্রথমবারের মতো টেস্ট র্যাংকিংয়ের শীর্ষে ওঠা, ভারতকে হারিয়ে আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা। রঙিন পোশাকের ক্রিকেটেও এসেছে উন্নতির জোয়ার । শেষ দুই ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের পর সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালও খেলেছে নিউজিল্যান্ড। যদিও শিরোপা জেতা হয়নি।
মাত্র ৫০ লক্ষ লোকের বসবাস নিউজিল্যান্ডে; টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম জনসংখ্যা। তাদের ক্রিকেট বোর্ডের বার্ষিক রাজস্ব ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ধনী কাউন্টিগুলোর একটি; সারের চেয়েও কম। তবুও ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটেই সফল দেশটি। তাদের এই উন্নতির ফর্মুলা কী? কীভাবে ইংল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেরও টেস্ট ক্রিকেটের রোল মডেল হতে পারে নিউজিল্যান্ড?
ক্রিকেটকে প্রাধান্য দেয়া প্রশাসন
১৯৯৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে নিউজিল্যান্ডের তিন তারকা ক্রিকেটার নিষিদ্ধ মারিজুয়ানা সেবন করার কথা স্বীকার করেছিলেন। তাদেরই একজন স্টিফেন ফ্লেমিং। সাবেক এই কিউই অধিনায়কের কাছ থেকে জানা যায়, সেই ঘটনায় স্কোয়াডের অর্ধেকের বেশি ক্রিকেটার যুক্ত ছিলেন।
জাতীয় ক্রিকেটারদের এই কেলেংকারিতে তোলপাড় শুরু হয় নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেটে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাবটা পড়ে ক্রিকেট প্রশাসনে। নিউজিল্যান্ডের তৎকালীন ক্রিকেট বোর্ড ছিল ১৩ সদস্য বিশিষ্ট। সদস্যদের প্রত্যেকেই ছিলেন আঞ্চলিক ক্রিকেটের হর্তাকর্তা। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাদের কেউই বেতন পেতেন না। প্রস্তাব উঠে সেই প্রশাসনিক কমিটি ভেঙে দেয়ার। পুরনো কর্মকর্তারাও সরে দাঁড়ান তখন।
যাত্রা শুরু করে নিউজিল্যান্ডের স্বায়ত্বশাসিত ক্রিকেট বোর্ড। তাদের সর্বপ্রথম চ্যালেঞ্জ ছিল ক্রিকেটকে দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে দেয়া। কারণ নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেটের চেয়ে বেশি জনপ্রিয় রাগবি, নেটবল এমনকি ফুটবলও। তবে সময়ের সাথে ক্রিকেট বোর্ডের দূরদর্শিতায় ক্রিকেটের গ্রহণযোগ্যতাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। সর্বপ্রথম তৃণমূল ক্রিকেটকে পাখির চোখ করে নিউজিল্যান্ড বোর্ড। তারই অংশ হিসেবে উঠতি বয়সী ক্রিকেটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১৯৯৬ সালে ‘ক্রিকেট ম্যাক্স’ নামে বিশেষ এক টুর্নামেন্ট শুরু হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে ঘরোয়া ক্রিকেটে প্রথম টি-টোয়েন্টি চালু করেছিল নিউজিল্যান্ড।
ক্রিকেট বোর্ডের এই পদক্ষেপ অনুসরণ করেছিল দেশটির রাগবি বোর্ডও। কিন্তু ক্রিকেটবিশ্বে সেভাবে পালে হাওয়া পায়নি স্বাধীন ক্রিকেট বোর্ডের এই ধারণা। এই পথে হাঁটতে চাইলে কয়েক ধরনের বাধা পেরোতে হবে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডকে (ইসিবি)। প্রথমেই পেতে হবে বোর্ডের ৪১ জন সদস্যের অনুমতি। ১৮টি প্রথম শ্রেণির কাউন্টি দল, ২১টি জাতীয় কাউন্টির পাশাপাশি মেরিলিবোর্ন ক্রিকেট বোর্ড(এমসিসি) ও জাতীয় কাউন্টি অ্যাসোসিয়েশনের অনুমোদনও পেতে হবে ইসিবিকে।
পেশাদার ও প্রতিযোগিতামূলক ঘরোয়া ক্রিকেট
২০০০ সাল পর্যন্ত নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটাররা ছিলেন আধ-পেশাদার। পেশাদার হিসেবে বেতন পেতেন কেবল জাতীয় দলের ক্রিকেটাররাই। নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো না থাকায়, অনেকেই ছেড়ে দেন ঘরোয়া ক্রিকেট। আর নামমাত্র ম্যাচ ফি, বেতন যা পেতেন সেটা অপ্রতুলই ছিল। ২০০১ সালে গঠিত হয় ঘরোয়া ক্রিকেটারদের সংগঠন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট প্লেয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (এনজেডসিপিএ)। সেই সংগঠনই ক্রিকেট বোর্ডের সাথে আলোচনা করে ঘরোয়া ক্রিকেটারদের জন্য নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো তৈরি করে। তখন থেকেই পেশাদারিত্বের মোড়কে ঢাকা পড়ে দেশটির ঘরোয়া ক্রিকেট। সেই ভিত্তির ওপরই দাঁড়িয়ে আছে নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া তথা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট।
বর্তমানে ঘরোয়া সার্কিটে চুক্তিবদ্ধ ১১৬ জন ক্রিকেটার আছেন। এর ফলে প্রতিযোগিতা বেড়েছে ঘরোয়া ক্রিকেটে। নেপথ্যে আছে আর্থিক নিরাপত্তা আর দারুণ সব সুযোগ-সুবিধা। এর ফলটা সরাসরি ভোগ করছে জাতীয় দল। ফরম্যাট ভেদে কোচ-অধিনায়কদের হাতে বেড়েছে বিকল্পও।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ম্যাট হেনরির কথা। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ২৩ রানে ৭ উইকেট নিয়েছিলেন তিনি। নিজের খেলা শেষ তিন টেস্টের দুটিতেই হয়েছিলেন ম্যাচ সেরা। তবুও ইংল্যান্ড সফরে লর্ডসের প্রথম টেস্টে। যদিও ট্রেন্টব্রিজে চলমান দ্বিতীয় টেস্টে জায়গা পেয়েছেন সেরা একাদশে। এ থেকে বোঝা যায়, তুমুল প্রতিযোগিতার কারণে ভালো পারফর্ম্যান্সই শেষ কথা নয় নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটে।
কেবল ক্রিকেটার নয়, ঘরোয়া কোচদের জন্যও বিশেষ ব্যবস্থা নিয়েছিল নিউজিল্যান্ড বোর্ড। ২০০১ সালের আগ পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটের কোচরা কেবল গ্রীষ্মকালীন মৌসুমেই কাজ করতেন। আর বছরের বাকি সময় তাদের কাটতো ক্রিকেটের বাইরে। সেই চিত্রটা এখন বদলে গেছে। কাজের পরিধিও বেড়েছে তাদের। খণ্ডকালীন ঘরোয়া কোচরা এখন বেতনভূক্ত হওয়ায় কাজ করেন বছরজুড়েই। এই কারণে কোচিংকেও পেশা হিসেবে নিতে ভরসা আর সাহস পাচ্ছেন অনেকেই।
ঘরোয়া ক্রিকেট কাঠামো ও উইকেটের উন্নতি
ক্রিকেটার, কোচদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সাথে ক্রিকেট কাঠামোরও উন্নতি করেছে নিউজিল্যান্ড। ২০০২-০৩ মৌসুমের ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচগুলো হয়েছিল মোট ২৪টি মাঠ মিলিয়ে। নিউজিল্যান্ডের ৬টি আঞ্চলিক ক্রিকেটের দল অদল বদল করে খেলেছিল সেই মৌসুমে। এতে করে ক্রিকেটের প্রচার-প্রসার হলেও ক্রিকেটাররা ভুগতেন মাঠের আকার-আয়তন নিয়ে। কারণ বেশিরভাগ মাঠের অবস্থানই ছিল ছোট একেকটা শহরের প্রাণকেন্দ্রে। মাঠগুলোও ছিল ছোট। অনুশীলনের সুযোগও ছিল অপ্রতুল।
সেই সীমাবদ্ধতা ২০০৫ সালে কাটিয়ে ওঠে নিউজিল্যান্ড। ক্রিকেট বোর্ড ও ক্রিকেটারদের সংগঠনের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে আঞ্চলিক ক্রিকেট প্রশাসন ও গ্রাউন্ডস কমিটির জন্য পাশ হয় ‘ওয়ারেন্ট অফ ফিটনেস’ প্রস্তাব। প্রস্তাবের মূল বক্তব্য, কোনো ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করতে চাইলে যথাযথ অনুশীলনের সুবিধা থাকতে হবে সেই মাঠে।
এর ফলে মাঠের যাবতীয় সুবিধাদি বাড়ার পাশাপাশি উইকেটেও এসেছিল উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। কারণ ভালো মাঠের অন্যতম এক অংশ ভালো উইকেটও। সাধারণত পেস সহায়ক উইকেটই দেখা যায় নিউজিল্যান্ডে। প্রায় প্রতি ম্যাচের উইকেটেই ঘাসের ছোঁয়া থাকে। এই ঐতিহ্যর মূল ধারক ও বাহক নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে। এতে করে শুরু থেকেই পেসাররা নিজেদের মেলে ধরতে পারেন। সাথে ব্যাটাররাও শিখে যান কীভাবে পেসারদের দাপট সামলে টিকে থাকতে হয়। সরাসরি এর ফলভোগী হচ্ছে নিউজিল্যান্ড জাতীয় দল। অবশ্য আধুনিক টেস্ট ক্রিকেটের সাথে মানিয়ে নিতে ব্যাটিং সহায়ক উইকেটও বানাচ্ছেন প্রতিটি ভেন্যুর কিউরেটর। ২০১০ সাল থেকে নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটেই রান উঠেছে সবচেয়ে বেশি।
টি-টোয়েন্টির প্রতি বোর্ডের স্বচ্ছ মনোভাব
২০০৮ সালে আইপিএল শুরু হওয়ার পর থেকে ক্রিকেটের গতিপথ বদলে গেছে অনেকখানি। আইপিএলের দেখাদেখি চালু হয়েছে আরও অনেক ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক টি-টোয়েন্টি লিগ। সেই লিগগুলোতে থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের চেয়ে বেশিই আয় করেন ক্রিকেটাররা।
এই বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে পারেনি অনেক ক্রিকেট খেলুড়ে দেশই। বিশেষ করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি লিগগুলোকে ইংল্যান্ড অবজ্ঞার দৃষ্টিতেই দেখতো। ক্রিকেটারদেরও খুব একটা ছাড় দিত না ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোতে খেলতে। মানিয়ে নিতে পারেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজও। যার মাশুলটা দিতে হয়েছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড ক্রিকেটারদের শর্ত বেধে দিয়েছিল, আন্তর্জাতিক ওয়ানডের জন্য বিবেচিত হতে চাইলে ঘরোয়া সার্কিটের ওয়ানডে টুর্নামেন্টে খেলতেই হবে। এতে করে সমস্যা কমার চেয়ে বাড়তেই থাকে। কারণ ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক বড় টি-টোয়েন্টি লিগগুলোর সাথে সেই সূচি মিলে যাচ্ছিল। ক্রিস গেইল, ডোয়াইন ব্রাভো, কাইরন পোলার্ডের মতো ক্রিকেটাররা আর্থিক দিকটাকে প্রাধান্য দিয়ে তাই জাতীয় দলকে উপেক্ষা করেছেন। এই কারণে প্রায়শই ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বিতীয় সারির দলকে খেলতে দেখা যায়।
২০২১ সালে সব ধরনের ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন এবি ডি ভিলিয়ার্স। ২০১৮ সালে তিনি বলেছিলেন জাতীয় দলের হয়ে কেবল গুরুত্বপূর্ণ সিরিজগুলোই তিনি খেলতে চান। অর্থাৎ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট ও জাতীয় দলের মধ্যে ‘পিক এন্ড চুজ’ পদ্ধতিতে ক্যারিয়ার এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ক্রিকেট বোর্ডের সম্মতি না থাকায় সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি ভিলিয়ার্সের।
ক্রমবর্ধমান ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট উদ্ভূত এই ‘সমস্যা’ চতুরতার সাথে সামলেছে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড। ক্রিকেটারদের প্রতি বোর্ডের নমনীয় নিয়ম-নীতিগুলোই এর অন্যতম কারণ। যে সিরিজগুলো অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ সেসব সিরিজ চলাকালীন আইপিএল কিংবা অন্য কোনো টুর্নামেন্ট থাকলে ক্রিকেটারদের সেখানে খেলার স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছে বোর্ড। এজন্যই কেইন উইলিয়ামসন, মিচেল স্যান্টনার, জিমি নিশামদের নিয়মিত দেখা যায় আইপিএলের মতো ঝকঝকে টুর্নামেন্টগুলোতে।
আইপিএলের আদলে দেখা গেছে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ, ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ। তবে সেই অর্থে ফলপ্রসূ নয় এর কোনোটিই। ব্যতিক্রম কেবল বিগ ব্যাশ। তবে এই পথে হাঁটতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে অনেক উদ্যোগই। ২০১৭ সালে গ্লোবাল টি-টোয়েন্টি লিগ চালু করতে না পেরে ১১ মিলিয়ন পাউন্ড লোকসান হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার। তবে এই ক্ষেত্রে পুরো ভিন্ন পথে হাঁটছে নিউজিল্যান্ড। সবাই যেখানে ফ্র্যাঞ্চাইজিভিত্তিক ক্রিকেটের পেছনে ছুটছে সেখানে নিউজিল্যান্ড টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চালু করেছে প্রথম শ্রেণির দল দিয়েই। অর্থাৎ ঘরোয়া ক্রিকেট থেকেই টি-টোয়েন্টির জন্য ক্রিকেটার তুলে আনা।
জাতীয় দলকে প্রাধান্য দেয়ার সংস্কৃতি
লর্ডস টেস্টে ওলি পোপ ব্যাট করেছেন তিন নম্বরে। অথচ সারে কাউন্টির হয়ে গোটা প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারে তিনি কখনো শীর্ষ তিনে ব্যাটিংই করেননি। ইংল্যান্ডের টিম ম্যানেজমেন্ট-কোচিং প্যানেল হয়তো সারে কর্তৃপক্ষের সাথে এ নিয়ে কথাও বলেনি। কারণ ওই একটাই, ঘরোয়া আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সবসময় একই তালে চলে না।
তবে ঘরোয়া আর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মধ্যে দারুণ ভারসাম্য বজায় রেখে চলেছে নিউজিল্যান্ড। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন দলটির সাবেক প্রধান কোচ মাইক হেসন। জাতীয় দলের কথা মাথায় রেখে প্রায়ই ঘরোয়া দলের ক্রিকেটার নির্বাচনে নিজের মতামত দিতেন তিনি।
কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই নর্দান ডিস্ট্রিক্ট দলের প্রধান কোচকে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, বিজে ওয়াটলিকে স্পেশালিস্ট ওপেনার হিসেবে না খেলিয়ে মিডল অর্ডারে উইকেটকিপার-ব্যাটার হিসেবে খেলানো যায় কিনা। হেসনের সেই পরামর্শ মেনে ওয়াটলিংকে নর্দান ডিস্ট্রিক্টের মিডল অর্ডারে নামান কোচ। সেই টোটকা যে বেশ ভালোভাবেই কাজে লেগেছে সেটা ওয়াটলিংয়ের ব্যাটিং রেকর্ডে তাকালেই স্পষ্ঠ প্রতীয়মান। তর্কাতীতভাবে টেস্টে কিউইদের সেরা উইকেটকিপার-ব্যাটারও বলা হচ্ছে ওয়াটলিংকে।
একইভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটের আরেক দল ক্যান্টারবুরি ওপেনার টম ল্যাথামকে ওয়ানডে ক্রিকেটে মিডল অর্ডারে ব্যাট করানোর কথা বলেছিলেন হেসন। সাথে উইকেটকিপিংটাও করিয়েছেন। পুরোদস্তুর ওপেনার থেকে মিডল অর্ডার ব্যাটার হিসেবেই ২০১৯ বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলেছিলেন ল্যাথাম।
জাতীয় দলকে প্রাধান্য দিতে প্রধান কোচ নিজের কাজের পরিধির বাইরে গিয়েও কাজ করেন। ক্রিকেটাররাও একই কারণে নিজের পছন্দের ব্যাটিং পজিশন ছেড়ে দেন অনায়াসে। এর নেপথ্যে আছে ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিকভাবে নিউজিল্যান্ডের নাগরিকদের সহনশীলতা ও ছাড় দেয়ার মানসিকতা। আলাদা ছয়টি জেলায় ভাগ করা দেশটিতে তেমন কোনো আঞ্চলিক বিভেদও নেই। তাই দেশটির ক্রিকেটপাড়ায়ও একটিই মন্ত্র ‘জাতীয় দল আগে’।
জাতিগতভাবে নিউজিল্যান্ডে এমন অনেক ক্রিকেটার আছেন যার জন্ম কিংবা বাসস্থান ক্যান্টারবুরিতে কিন্তু প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলছেন ওয়েলিংটনের হয়ে। ক্রিকেটের ফাঁকা মৌসুমে তারাও নিজ এলাকার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা নিতে পারেন।
জাতীয় দলের প্রতি নমনীয়রতার আরেকটা উদাহরণ টানা যায় নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেট দিয়ে। ২০১৮ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক মৌসুমে খেলা হতো মোট দশ রাউন্ড। কিন্তু বোর্ডের সিদ্ধান্তে সেবার থেকে আট রাউন্ডে নেমে আসে প্রথম শ্রেণির লিগ। উদ্দেশ্যে পাইপলাইনের ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া ‘এ’ দলকে আরও বেশি সময় ধরে পরিচর্যা করা। সেক্ষেত্রে বাকি দুই রাউন্ডের ম্যাচ ফি-ও ঘরোয়া ক্রিকেটারদের ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে জাতীয় দলকে উপকৃত করতে বেশ সাদরেই সেটা গ্রহণ করেছিলেন তারা।
ক্রিকেট সংস্কৃতি নিউজিল্যান্ডের রোল মডেল হয়ে ওঠার নেপথ্যে সবচেয়ে বড় রসদ। তাদের ক্রিকেট অবকাঠামো হয়তো চাইলেই অনুসরণ করে বাস্তবায়ন করতে পারবে বাংলাদেশ কিংবা ইংল্যান্ড। কিন্তু যে সংস্কৃতি এতদিনে কিউইরা দাঁড় করিয়েছে সেটা ফুটিয়ে তোলা দুঃসাধ্যই হবে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি ক্রিকেট