• " />

     

    'বাজবল' ইংল্যান্ড : টেস্ট ক্রিকেট বদলে দেওয়া 'ইতিহাস' লেখার পথে?

    'বাজবল' ইংল্যান্ড : টেস্ট ক্রিকেট বদলে দেওয়া 'ইতিহাস' লেখার পথে?    

    গেলবছরের আগষ্ট, এবছরের জুলাই। পতৌদি ট্রফির শুরুর সময়, আর শেষের সময়। পাঁচ ম্যাচের সিরিজটা সময় নিলো প্রায় মাস এগারো। সময়ের হিসাবে কি এত লম্বা সিরিজ আর দেখেছে কখনো ক্রিকেট?

    দীর্ঘদিন ধরে সিরিজটা শেষের অপেক্ষায় ছিল ভারত। ইংরেজদের মাটিতে তাদের একটি সিরিজের অপেক্ষাটাও যে দীর্ঘদিনের। সর্বশেষ জেতা হয়েছিল ২০০৭ সালে। বিরাট কোহলির ভারত এই সিরিজটা জেতার সব বন্দোবস্ত করেই রেখেছিল, তিন ম্যাচের দুইটি জিতে। করোনার অদৃশ্য ছোঁয়ায় সিরিজটা স্থগিত হয়ে গেলো। যার মানে যেন বিরাট কোহলিদের অপেক্ষাটাই শুধু বাড়িয়ে দেয়া। শেষ ম্যাচ জিতে ইংল্যান্ড সিরিজটা ড্র করবে, এই ফলের পক্ষে বাজি ধরা লোকের অভাবই যে হতো তখন। 

    আর এখন? 

    ***

    সিরিজের চতুর্থ ম্যাচ, আর পঞ্চম ম্যাচ, মাঝখানে বিরতি মাস দশেক। মাঝের এই সময়ে বদলেছে কত কিছুই। ভারতের হয়ে টস করতে নামেন না কোহলি, ইংল্যান্ডের টসটাও রুটের বদলে করেন অন্য কেউ। নিজের ফর্মের চিন্তায় অধিনায়কত্বের ভার কাঁধ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন কোহলি। জীবনের সেরা ফর্মেই ছিলেন, কিন্ত দলের অবস্থা তেমনই বাজে ছিল বলে সরে গেলেন রুট। 

    স্টোকসের গায়ে চাপলো কাপ্তানের ব্লেজার। বিরাট কোহলির অধিনায়ক হয়ে দেখা স্বপ্নটা এবার পূরণ হবার পালা খেলোয়াড় হিসেবে, অধিনায়ক রোহিতের ভারতের হাত ধরে। ম্যাচের দিন কয়েক আগে ছিটকে গেলেন রোহিত, ওই করোনাই কারণ। প্রথমবারের মতো কোন পেসার ভারতের অধিনায়কের দায়িত্ব পেলেন তাই। জাসপ্রিত বুমরাহ। 

    ইংল্যান্ডের শেষ ম্যাচ, আর এই সিরিজের আগের ম্যাচ, দুটির একাদশে বড়সড় পরিবর্তন। চতুর্থ ম্যাচের চারজনই মাত্র পঞ্চম ম্যাচের একাদশেও নিজেদের নাম দেখতে পেলেন। তবে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন তো আদতে এলো এই ইংল্যান্ডের খেলার ধরনেই। যে ইংল্যান্ড লক্ষ্য তাড়া করার চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসে। যে ইংল্যান্ড বলতে পারে, যতই লক্ষ্য দাও, আমরা ঝাঁপিয়ে পড়তে প্রস্তুত!

    ***

    পঞ্চম টেস্টের টস করতে যাবার আগেই স্টোকস বলে দিয়েছিলেন, আমরা লক্ষ্য তাড়ায় নামতে চাই। আগের তিন ম্যাচেই লক্ষ্য তাড়া করে জেতা, টানা তিন ম্যাচে আড়াই শর বেশি রান তাড়া করা প্রথম কোন দল। এই দলের অধিনায়কের লক্ষ্য তাড়ায় সাহসী হবার সাধ জাগবে না তো কার জাগবে!

    লর্ডস টেস্টে নিউজিল্যান্ডের দেয়া ২৭৭ রান ইংল্যান্ড তাড়া করলো পাঁচ উইকেট রেখে হেসেখেলেই। ট্রেন্ট ব্রিজে তো ২৯৯ রান পেরিয়ে গেলো ৫০ ওভারেই, কিউই বোলারদের সঙ্গে যা করলো, তাকে ছেলেখেলাই বলা যায়। হেডিংলিতে আবার ২৯৬ রান, ও আর এমন কী! তিনশ রানের টার্গেটও কম মনে হয় এই ইংল্যান্ডের দিকে তাকালে! 

    নিউজিল্যান্ডের সাথে তো করলো, ভারতের শক্তিশালী বোলিং লাইনআপের সামনে কি এভাবে পারবে? 

    সাউথি-বোল্টের নিউজিল্যান্ডের বোলিংও কি কম শক্তিশালী! কিন্ত ইনজুরি আর দল নির্বাচন- ইংল্যান্ড সিরিজে নিউজিল্যান্ডকে অন্তত তেমন শক্তিশালী মনে করাতে দেয়নি। দ্বিতীয় ম্যাচের প্রথম ইনিংসেই ইনজুরিতে ছিটকে গিয়েছিলেন জেমিসন। প্রথম ম্যাচেই গ্র‍্যান্ডহোমও ইনজুরিতে পুরো সিরিজ থেকে শেষ। আজাজ প্যাটেলকে সেভাবে ব্যবহার করার সুযোগ আসেনি প্রথম টেস্টে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচটাতে স্পিনারের ভূমিকা পালন করেছেন ব্রেসওয়েল। ব্রেসওয়েলের ‘কাজ চালিয়ে যাওয়া’ স্পিন কাজে আসেনি। শেষ ম্যাচে তো সেই অলরাউন্ডার ব্রেসওয়েলের সঙ্গে কিউইরা নেমে গিয়েছিলো নিয়মিত মাত্র তিন বোলার নিয়েই। 

    প্রশ্নটা তাই আসবেই। তবে সেটির উদ্দেশ্য যতটা না এই ইংল্যান্ডের সামর্থ্য নিয়ে, তার চেয়ে বেশি বোধহয় দেখার আগ্রহ থেকেই। ভালো আক্রমণের সামনে কেমন করতে পারে, তা দেখার আগ্রহ! 

    ***

    সাউথি-বোল্টদের পেস খুব বেশি নেই, সুইং-সিমে তাদের যে নির্ভরতা সেটি তো নির্ভর করে আবার কন্ডিশনের উপর। সে তুলনায় গতিশীল ও কোয়ালিটি অ্যাটাক ভারতের। প্রথম ইনিংসেই ইংল্যান্ড টের পেয়েও গেল সেটি৷ ৮৩ রানে পাঁচ উইকেট হারিয়ে ফেললো ইংল্যান্ড, বেইরস্টো সেঞ্চুরিতে টেনে নিলেন ২৮৪ রান পর্যন্ত। 

    তার আগে ভারতকেও চেপে দিয়েছিল ইংল্যান্ড। ৯৮ রানেই ভারতের যখন পাঁচ উইকেট নেই, পান্টের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন জাদেজা। দুজনে মিলে থামলেন ২২২ রানের জুটি গড়েই। ভারত ৪১৬ রানের সংগ্রহ নিয়ে নামলো ১৩২ রানের লিড নিয়ে। দ্বিতীয় ইনিংসে তিন উইকেটে খুইয়ে পেরিয়ে গেলো একশ। 

    তৃতীয় দিন পর্যন্ত ভারতেরই দাপট, তৃতীয় দিন শেষে এগিয়ে ভারতই। চতুর্থ দিনে লিডের সঙ্গে যত যোগ করবে, ততই যেন ইংল্যান্ডকে সীমার বাইরের কাজ করতে বাধ্য করবে।  

    কিন্ত শেষ সাত উইকেট মাত্র ৯২ রানে হারিয়ে ভারত যা লক্ষ্য দিল, তা ৩৭৮ রানের বেশি হলো না। এত বড় লক্ষ্য তাড়া করে যদিও জেতার রেকর্ড নেই ইংল্যান্ডের, এত বড় লক্ষ্য দিয়ে হারেরও রেকর্ড নেই ভারতের। ইংল্যান্ডের চতুর্থ ইনিংস শেষে সেই 'রেকর্ড নেই' থেকে 'নেই' উঠে গিয়ে হয়ে গেলো ‘রেকর্ড’! 

    কি স্টোকসি, যা ভেবেছি, তা-ই তো হচ্ছে নাকি!

    ৩৭৮ রানের লক্ষ্য পেরিয়ে যেতে ইংল্যান্ডের দরকার পড়লো মাত্র পাঁচ ব্যাটসম্যানের। স্টোকসের নাকি একবার মনে হলো, ভারত ৪৫০ করেই ফেলুক, দেখতে চান তারা কতদূর যেতে পারেন! আপনারও কি জানার ইচ্ছে হয় না, এই ইংল্যান্ড দলের সীমা কতদূর তা জানতে!

    ***

    ৩৭৮৷ ম্যাচ শুরুর আগে যদি বলতেন এই পুঁজি নিয়ে নেমে ডিফেন্ড করতে হবে, ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় তা নিতেন। 

    ৩৬৮ রানের পুঁজি নিয়ে এই সিরিজের আগের টেস্টেই নেমেছিলো ভারত। ওই ম্যাচেও ইংল্যান্ডের ওপেনিং পার্টনারশিপ একশ রান ছুঁয়েছিলো। তবু ইংল্যান্ড ২১০ রানেই অলআউট হয়ে ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল ১৫৭ রানে।

    এজবাস্টন টেস্টে ক্রলি আর লিস মিলে একশ পেরিয়ে গেলেন বিশ ওভার না পেরুনোর আগেই। ১০৭ রানের তাদের এই পার্টনারশিপে রান রেট ৪.৯৩, যা ইংল্যান্ডের হয়ে শতরানের পার্টনারশিপগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ১০৭ রানে এই জুটি ভেঙ্গে দেয়ার পর দুই রানের মধ্যেই আরও দুই উইকেট তুলে নিয়ে ম্যাচ ফিরে এসেছিল ভারত।

    এরপর বেইরস্টো আর রুট, সেঞ্চুরি হাঁকালেন, অপরাজিত থেকেই মাঠ ছাড়লেন। সফল রান তাড়ায় যে দুই ব্যাটসম্যান ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়ছেন, তাদের দুজনই সেঞ্চুরিয়ান। ইয়র্কশায়ারের সেই দুই ছোট্ট বেইরস্টো আর রুট ইংল্যান্ডের হয়ে তা করলেন ক্রিকেট বিশ্বেই প্রথমবারের মতো। কখনোই ৩৩৯ রানের বেশি পুঁজি নিয়ে নেমে যে ভারত হারেনি, সেই ভারত হারলো সাত উইকেটে। 

    ভারতের আফসোস হয়ে থাকবে বেইরস্টোর ওই ক্যাচ মিস, ভিহারি যখন স্লিপে সেই ক্যাচ মিস দিয়েছেন তখন বেইরস্টো ১৪ রানে। সিরিজ জেতার সুযোগ হাতছাড়া- কোহলি-বুমরাহদের সবচেয়ে বড় আফসোস বোধহয় এটিই হয়ে থাকবে। আর তখনই কত 'যদি, কিন্ত' মনে পড়ে যাবে। যদি প্রথম টেস্টের শেষদিন বৃষ্টিতে হারিয়ে না যেত, সিরিজটাও হারিয়ে যায় না! 

    ট্রেন্ট ব্রিজে প্রথম টেস্টে ২০৯ রানের টার্গেটে ভারত চতুর্থ দিন শেষ করেছিল ১ উইকেটে ৫২ রানে থেকে। পঞ্চম দিনে ভারতের দরকার ছিল মাত্র ১৫৭ রানের, হাতে ছিল নয় উইকেট। 

    ***

    এই মূহুর্তে ক্রিকেট বিশ্বে সবচেয়ে আনন্দময় সময় কাটাচ্ছেন কোন দেশের ভক্তরা? যে ইংলিশ সমর্থকদের কথা বলবেন, সেই তাদের এই চার টেস্টের আগের বছর দেড়েক সময়ের অবস্থা ভাবুন তো! সতেরো টেস্টে তাদের জয়ের আনন্দে মেতে উঠার সুযোগ হয়েছে মাত্র একবার! আর এখন?

    টানা চার টেস্টে জয়, সেটিও আবার গেল টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের দুই ফাইনালিস্টের বিপক্ষে। জয়গুলোও একেবারে বিনোদনের রঙে যেন ছিল ভরপুর। এই চার টেস্টের প্রত্যেকটিই শেষদিন পর্যন্ত গিয়েছে। এবং চারটিতেই মিলেছে বিনা পয়সায় 'পয়সা উসুল' বিনোদন! 

    নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্ট, লর্ডসে শেষদিনে রুটের বদৌলতে পনেরো ওভারের খেলা হতে দেয়নি ইংল্যান্ড। আর পনেরো ওভারের কম খেলা হওয়ায় টিকিটের টাকা ফেরত মিলেছে দর্শকদের! 

    দ্বিতীয় টেস্টে বেইরস্টোর ৯২ বলে ১৩৬ আর স্টোকসের ৭০ বলে ৭৫, এমন বিনোদনদায়ী ইনিংসের দেখা যদি মিলে মুফতে, কি দারুণ হয় না ব্যাপারটা! ট্রেন্ট ব্রিজের মতো পরের টেস্টে হেডিংলিও পঞ্চম দিনে বেইরস্টো-রুট জুটি দেখার সুযোগ করে দিয়েছিল ফ্রিতে। ভারতের বিপক্ষে এজবাস্টন টেস্টের শেষের দিনেও এন্ট্রি করে দেওয়া হয়েছিলো ফ্রি। 

    ***

    মাঠের ইংল্যান্ডও ভাবে দর্শকদের কথা। নিজেদের 'বিনোদনদায়ী' মানা স্টোকস টেস্ট ক্রিকেটে 'নতুন জীবন' দিতে চান আগ্রাসী ক্রিকেট খেলে। খেলোয়াড়ী জীবনে আগ্রাসী ক্রিকেট খেলা ম্যাককালামের এই ইংল্যান্ডের গায়েও বইছে আগ্রাসনের রক্ত। স্টোকস-বেইরস্টোদের এ আক্রমণাত্মক ক্রিকেটটা ম্যাককালামেরই ডাকনাম 'বাজ' সহযোগে পেয়ে গেছে 'বাজবল' নাম। অধিনায়ক হওয়ার পর স্টোকসের প্রথম বার্তাই ছিল, খেলাটা উপভোগ করো। সেই উপভোগ করা ইংল্যান্ডকে দর্শকেরাও তো উপভোগ করছে তিলেতিলে। 

    নিউজিল্যান্ড সিরিজে ইংল্যান্ডের হুট করে ওলট-পালট হওয়া দেখে, সকলে যেন ব্রেন্ডন ম্যাককালামের খুঁজে নেমে পড়ে গিয়েছিলেন। একেবারে সিরিজ শেষেই এসে ম্যাককালাম মিডিয়ায় মুখ না দেখানো নিয়ে বলেছিলেন, যখন দল হারবে তখন মিডিয়ার প্রশ্নবান সামলাতে তিনিই সামনে থাকবেন! ম্যাককালাম জানেন, দলের যখন দুরবস্থা, তখনই তাঁর প্রয়োজন বেশি। ভাবনাটাই,আসল, ভাবনাটাই সব। 

    আর ম্যাককালাম-স্টোকস মিলে এই দলের মানসিকতায়ই তো এনে দিয়েছেন আমূল পরিবর্তন। যে ইংল্যান্ড তাদের বোলারদের সাহস দেয়, রানের চিন্তা না করে মাথায় শুধু উইকেটই ভাবতে। যে ইংল্যান্ডকে নিয়ে জ্যাক লিচ বলেছিলেন, কখনো কখনো কোন দল তাদের থেকে ভালো খেলবে, তবে ইংল্যান্ডের থেকে সাহসী হতে পারবে না। 

    সেই সাহসী ইংল্যান্ডে সাফল্যও তো ধরা দিচ্ছে। তবে সামনে আরও কঠিন বোলিং কন্ডিশনের মুখোমুখি হবে ইংল্যান্ডের এই 'বাজবল'! তখন কি হবে? এই সিরিজেরই আগের চার টেস্টে ভারতের ড্রেসিংরুমের 'বস' রবি শাস্ত্রী এজবাস্টন টেস্টে ছিলেন স্কাই স্পোর্টসে কমেন্টেটর হিসেবে, সেখানেই বলেছেন, ইংল্যান্ডের এই ঘরানার ক্রিকেট তাদের যতটা না হার এনে দিবে তার চেয়ে বেশি জয়ই পাইয়ে দিবে। 

    তাই 'বাজবল' এর ভবিষ্যত সময়ের কাছেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। তবে এটুকু নিশ্চিত, ইংল্যান্ড দর্শকদের উপভোগে কমতি রাখবে না। আর এ পর্যন্ত এই চার টেস্টেই যা করেছে এই 'বাজবল' ইংল্যান্ড, টানা চার টেস্টে প্রথমবারের মতো আড়াই শর বেশি রান তাড়া। এজবাস্টন টেস্টের ইতিহাসের সঙ্গে স্টোকস-ম্যাককালামের ইংল্যান্ডের এ ইতিহাসও তো দীর্ঘদিন মনে থাকবে! 

    ইতিহাসের পাতায় তো অবশ্যই। কে জানে, এ নতুন রেকর্ডের মতো টেস্ট ক্রিকেটেরই ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় যুক্ত করে দেয় কি না এই 'বাজবল', এই ইংল্যান্ড!