ফিরে দেখা: মুশফিকের সেরা পাঁচ টি-টোয়েন্টি ইনিংস
দুদিন আগেই ব্যর্থ এক এশিয়া কাপ শেষে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। গত দুই আসরের রানার-আপরা বাদ পড়েছে এবার গ্রুপ পর্ব থেকেই। সেই রেশ এখনো ভালোমতো কাটেনি। এর মধ্যেই আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন মুশফিকুর রহিম। আজ দুপুরে এক ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে মুশফিক ইতি টেনেছেন দীর্ঘ ১৬ বছরের টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের।
২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি অভিষেকের পর মুশফিক খেলেছেন আরও ১০১ টি ম্যাচ। মোট ১০২ ম্যাচ শেষে ডানহাতি এই ব্যাটারের সংগ্রহ ১৫০০। গড় ১৯.৪৮, স্ট্রাইকরেট ১১৫.০৩। নেই কোনো সেঞ্চুরি, ফিফটি ৬টি। যার সর্বশেষটি এসেছিল ২০২১ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।
টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারে অধিকাংশ সময়ে চার নম্বর পজিশনে ব্যাট করা মুশফিকের রেকর্ড সেই অর্থে ফ্রেমে বাঁধাই করে রাখার মতো নয়। তবে দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে বেশ কিছু ইনিংস খেলেছেন যেসবকে তার খেলা সেরা ইনিংসের তালিকায় রাখা যায়। প্যাভিলিয়ন সেখান থেকে বেছে নিয়েছে মুশফিকের ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচটি ইনিংস।
৪১* (২৬), প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ২০১১
টি-টোয়েন্টি অধিনায়ক হিসেবে মুশফিকের প্রথম ম্যাচ ছিল সেটি। টস হেরে ব্যাট করতে নেমে সাকিব আল হাসান, আব্দুর রাজ্জাক, শফিউল ইসলামদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে ১৩২ রানে আটকে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৫২ রানে চার উইকেট হারায় বাংলাদেশ।
মুশফিক যখন উইকেট যান, তখন দশ ওভারে আরও ৮০ রান দরকার ছিল বাংলাদেশের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা আরও চেপে ধরে মুশফিকদের। আশরাফুল-নাঈমরা একে একে ফিরলেও এক প্রান্ত আগলে দাঁড়ান মুশফিক। নিয়মিত স্ট্রাইক রোটেট করে নাসির হোসেনকে সাথে নিয়ে ম্যাচের ভাগ্য গড়ান শেষ ওভারে।
রবি রামপালের করা শেষ ওভারে জয়ের জন্য বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল ৬ রান। প্রথম বল ডট দিয়ে দ্বিতীয় বলে প্রান্তবদল করেন মুশফিক। তৃতীয় বলে নাসির উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলে ক্যারিবিয়ানদের দিকে ঝুঁকে যায় ম্যাচের ভাগ্য। চতুর্থ বলে টেলএন্ডার রাজ্জাক সিংগেল নিয়ে মুশফিকের কাছে স্ট্রাইক ফিরিয়ে দেন। সেখানেই বাজিমাৎ মুশফিকের। রামপালের লেন্থ বলটা ডিপ মিড উইকেট সীমানার ওপর দিয়ে দারুণ এক শটে আছড়ে ফেলেন মুশফিক। এক বল আর ৩ উইকেট হাতে রেখে জয় নিশ্চিত করেন মুশফিক। পুরো মিরপুর গর্জে ওঠে মুশফিকের সেই ছক্কার পর।
২৬ বলে ৪১* রানের সেই ইনিংসটা মুশফিক সাজিয়েছিলেন এক চার ও দুই ছক্কায়। অধিনায়ক হিসেবে প্রথম ম্যাচেই জয়, ম্যাচ সেরার পুরস্কার। শুরুটা দারুণ হয়েছিল মুশফিকের।
৭২* (৩৫), প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা, ২০১৮
নিদাহাস ট্রফির তৃতীয় ম্যাচ। বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিল শ্রীলংকা। টস হেরে বোলিং করতে নেমে কুশল মেন্ডিস আর কুশল পেরেরার তান্ডবে লন্ডভন্ড বাংলাদেশ। তাসকিন-মোস্তাফিজ-লিটনরা পাত্তাই পাননি তাদের কাছে। ইনিংস শেষে লংকানদের স্কোরকার্ড ২১৫/৮।
তামিম ইকবাল আর লিটন দাসের সৌজন্যে শুরুটা দারুণ হলো বাংলাদেশের। দুই ওপেনার মিলে ৫.৫ ওভারে তুলেছিলেন ৭৪ রান। দলীয় ১০০ রানের মধ্যে দুই ওপেনার ফিরলেও জয়ের মঞ্চটা তৈরি করে দিয়ে যান তারা। সেই দুজন যেখানে শেষ করেছিলেন, চার নম্বরে নামা মুশফিক সেখান থেকেই শুরু করলেন এসে।
রানের খাতা খুলেছিলেন জিভান মেন্ডিসকে চার মেরে। সেখান থেকেই কলম্বোর প্রেমাদাসায় শুরু হয় মুশফিকের তান্ডব। শানাকাকে এক চার ও এক ছক্কা, এর পরের ওভারে গুনাথিলাকাকেও উপহার দেন একই জিনিস। বলের যোগ্যতা বুঝে বাউন্ডারি আর নিয়মিত স্ট্রাইক রোটেশনে বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান করছিলেন মুশফিক। নুয়ান প্রদীপের বাউন্সারে সৌম্য ফেরেন, মুশফিকের সঙ্গী হন মাহমুদউল্লাহ। সেই ওভারটাও মুশফিক শেষ করেছিলেন চার মেরে।
শেষ তিন ওভারে বাংলাদেশ জয় থেকে ২৭ রান দূরে ছিল। ১৮তম ওভারে চামিরাকে চার মেরে ২৪ বলে ফিফটি করেন মুশফিক। পরের বলে সিংগেল নিয়ে গিয়ে টান পড়ে তার পায়ের পেশিতে। বিপদ খানিকটা বাড়ে সেই ওভারে মাহমুদউল্লাহর বিদায়ে। সাব্বির এসেও রানের খাতা খুলতে পারেননি। তবে মুশফিক বিপদ আর বাড়তে দেননি।
শেষ ওভারে ৯ রান লাগত বাংলাদেশের। মিরাজকে নন স্ট্রাইকে রেখে মুশফিক একাই খেলেন শেষ ওভারের প্রথম চারটি বল। দ্বিতীয় বলে পেরেরাকে চার মেরে তৃতীয় বলে নেন দুই। শেষটা করেছিলেন আলতো হাতের ফ্লিকে। পাঁচ চার ও চারটি ছক্কায় সাজানো মুশফিকের ক্যারিয়ারসেরা সেই ইনিংসের সুবাদেই নিজেদের ইতিহাসের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জিতেছিল বাংলাদেশ।
৭২* (৫৫), প্রতিপক্ষ ভারত, ২০১৮
শ্রীলংকার বিপক্ষে আগের ম্যাচেই মুশফিকের ব্যাট থেকে এসেছিল ৭২* রানের অনবদ্য এক ম্যাচজয়ী ইনিংস। সেই ম্যাচের চারদিন পর ভারতের বিপক্ষেও হেসেছিল মুশফিকের ব্যাট। ভারতের ১৭৬ রানের জবাবে শুরুটা ভালো হয়নি বাংলাদেশের। ৪০ রানের ভেতর ফেরেন দুই ওপেনার ও সৌম্য সরকার। ম্যাচের কেন্দ্রে আবারও হাজির হন মুশফিক। তাকে সঙ্গ দিতে পারেননি মাহমুদউল্লাহ, ২৩ বলে ২৭ রান করে সাব্বির চেষ্টা করেছিলেন। মুশফিক-সাব্বিরের জুটিতে এসেছিল ৬৫ রান।
৪২ বলে ফিফটি ছুঁয়েছিলেন মুশফিক। তবে ডেথ ওভারের হিসেবটা একা মেলাতে পারেননি তিনি। শেষ দুঈ ওভারে ৩২ রান লাগত মুশফিকদের। কিন্তু ১৯তম ওভারে শার্দুল ঠাকুরের করা দারুণ বোলিংয়ে আর পেরে উঠেনি বাংলাদেশ। জয় থেকে ১৭ রান দূরে থামতে হয়। মুশফিক মাঠ ছেড়েছিলেন ৭২ রানে অপরাজিত থেকে। ৫৫ বলে খেলা দলীয় সর্বোচ্চ সেই ইনিংসে ছিল আটটি চার ও একটি ছক্কা।
৬০* (৪৩), প্রতিপক্ষ ভারত, ২০১৯
ভারতের বিপক্ষে প্রথম টি-টোয়েন্টি জয়ে মিশে আছে মুশফিকের নাম। ২০১৯ সালে ভারত সফরের তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ জিতেছিল সাত উইকেটে। ঐতিহাসিক সেই জয়ে ব্যাট হাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুশফিক। শুরুতে ছিলেন শান্ত, শেষটায় বিধ্বংসী।
বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল ১৪৯ রানের। মুশফিক উইকেট গিয়েছিলেন ইনিংসের অষ্টম ওভারে ৫৬ রানে দুই উইকেট পড়ার পর। সেখান থেকেই ধীরস্থির শুরু তার। সৌম্যের সাথে জমেছিল ৬০ রানের জুটি। সৌম্য ফিরলেও মুশফিক হাল ছাড়েননি। তান্ডব দেখিয়েছিলেন ম্যাচের ১৯তম ওভারে। খলিল আহমেদকে মেরেছিলেন টানা চারটি চার। সেই ওভারেই ম্যাচ ফিরেছিল বাংলাদেশের দিকে। অবশ্য এর আগের ওভারে ক্রুনাল পান্ডিয়া মুশফিকের ক্যাচ মিস না করলে গল্প অন্যরকমও হতে পারত। বাংলাদেশের সেই ঐতিহাসিক জয় ছক্কা মেরে নিশ্চিত করেছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তবে আট চার ও এক ছক্কায় ৪৩ বলে ৬০* রানের ইনিংস খেলে ম্যাচসেরা হয়েছিলেন মুশফিকই।
৫৭* (৩৭), প্রতিপক্ষ শ্রীলংকা, ২০২১
গত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলংকার বিপক্ষে ৩৭ বলে ৫৭* রানের ইনিংস খেলেছিলেন মুশফিক। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে সেটাই হয়ে আছে তার সর্বশেষ ফিফটি। লংকানদের বিপক্ষে গ্রুপ রাউন্ডের সেই ম্যাচে প্রথমে ব্যাট করে ১৭১ রান করেছিল বাংলাদেশ। ওপেনার নাইম শেখের ধীরগতির ফিফটির সাথে দারুণ ব্যাটিংয়ে মুশফিক এনে দিয়েছলেন লড়াইয়ের রসদ।
শারজাহতে মুশফিক সেদিন ছিলেন শেষ বল পর্যন্ত। পাঁচ চার ও দুই ছক্কায় ইনিংস সাজিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন ৮৭ রানে অপরাজিত থেকে। কিন্ত মারকুটে ব্যাটিংয়ে সাত বল হাতে রেখেই জয় পায় শ্রীলংকা।