মহারাজা, তোমায় সেলাম
১৬ জানুয়ারি, ১৯৯৯। মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। থার্ডম্যানের গ্যালারিতে দর্শকরা হঠাৎ খেপে গিয়েছে সেদিন। রীতিমত কাঁচের বোতল, গলফ বল ছুঁড়ে মারছে ফিল্ডারের দিকে। বাউন্ডারি লাইনে ফিল্ডিং করাই দায়। হট্টগোলের কারণটা ঠিক জানা না গেলেও ম্যাচ আছে থেমে। আম্পায়ার, অধিনায়ক, খেলোয়াড়, নিরাপত্তাকর্মী কারো কথাই সেদিন শুনছেন না দর্শকরা। আর উপায় না দেখে হয়ে বিপক্ষ দলের অধিনায়ক বারকয়েক হাতের কবজি ঘুরিয়ে ইঙ্গিতটা দিলেন প্লেয়ার স্ট্যান্ডে। অগত্যা তাঁকেই আসতে হলো, মেলবোর্নের মহারাজাকে। স্লিপার আর ট্র্যাকস্যুট পরে দুলকি চালে নেমে এলেন ড্রেসিং রুম থেকে। সবাই জানে, আর কেউ না পারুক, এই একজনই কেবল পারবেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। একটা হেলমেট মাথায় দিয়ে দর্শকদের সামনে তিনি আসলেন, হাসলেন, হাত নাড়ালেন, দুয়েকটা কথা বললেন। শান্ত হল সবাই, খেলা আবার শুরু হল। মাঠের তিরাশি হাজার লোক আরও একবার জানল, ম্যাজিক জানে লোকটা।
ম্যাজিকের ব্যাপারটা মেলবোর্নের লোকজন অবশ্য জানতে পেরেছিল আরও বছর পাঁচেক আগেও। নব্বই বছরেও যে অ্যাশেজে হ্যাটট্রিকের দেখা নেই, তা কি না ধরা দিল এই লোকের হাতে, তাও আবার বার্থডে বয় বুনের নেওয়া ক্যাচে। জেনেছিল বছর আটেক পরেও, বক্সিং ডে-তে যেদিন প্রথম সাতশ টেস্ট উইকেট কেউ কব্জায় নিল এই মাঠেই।
ম্যাজিক দেখেছিল মরুর শহর রাজস্থানও। টুর্নামেন্টের অন্য সব দল যেখানে অর্থের ঝনঝনানিতে গড়েছে স্টার-প্যাকড একেকটা দল, সেখানে কিনা আনগ্ল্যামারাস এগারোজন নিয়ে প্রথম আসরেই করে ফেললেন বাজিমাত। তার দেশের লোক আরও একবার আফসোস করল তা দেখে, আহা, এই লোকটাকে আমরা পেলাম না কাপ্তান হিসেবে।
বছরের পর বছর এই ম্যাজিকেই নাকাল হতে হতে বিপক্ষ দল একবার ঠিক করল, আর না! যেকোনো ভাবেই হোক, থামাতেই হবে একে! নিয়ে আসা হল বিশাল এক বোলিং মেশিন! উদ্দেশ্য? তার মত যেন ঘূর্ণিবল করে মেশিন ‘মার্লিন’, আর ব্যাটসম্যানরা যেন ভালমতন প্রস্তুতি নিতে পারে খেলে। ফলাফল? ওই সিরিজে চল্লিশবার ব্যাটসম্যান তার হাতেই কুপোকাত! এর আগের পঞ্চাশ বছরে পাঁচ ম্যাচের সিরিজে এত উইকেট পায়নি আর কেউ! এক বছরে আর কেউ পায়নি ৯৬ উইকেটও।
আর ওই বলটা? চাইলে সেটার সাথে মিল খুঁজে নিতে পারেন প্রত্যেক ম্যাজিকে থাকা তিনটা ধাপের, যার প্রথমে আনকোরা এক ছোকড়ার অজানা সম্ভাবনার ‘আশ্বাস’। প্র্যাক্টিস ম্যাচে খাওয়া বেধড়ক পিটুনিতে অতি-সাধারণ বোলার মনে হওয়া। এরপরে অ্যাশেজে করা নিজের প্রথম বল, যা নিতে যাচ্ছে ‘টার্ন’। আর শেষে গ্যাটিংকে এবং তাবৎ দর্শকদের বোকা বানিয়ে ফিরে পাওয়া নিজের ‘অহম’।
ওই একটা বলই যেন মৃতপ্রায় লেগস্পিনকে দিয়েছিল পুনর্জন্ম। হালের প্রতিটা দলে যে লেগস্পিনার থাকা একরকম বাধ্যতামূলক, ওই বলটাই তো পথ দেখিয়েছিল সেটার। ওই বল বদলে দিয়েছিল সোনালিচুলো লোকটার জীবনও, নিজেই বলেছেন সেটা। আর এর পরেই তিনি বুঝে গিয়েছেন, হবে তাকে দিয়ে। তা এমনভাবেই সেটা পারলেন, হয়ে গেলেন লেগস্পিন নামেরই সমার্থক। যে একশন নকল করে বল করতে চাইত দুনিয়ার আনাচে-কানাচে উঠতি যেকোনো কিশোরও।
বড় টুর্নামেন্ট, বড় উপলক্ষ্য এলে যেন আরও জ্বলে উঠতেন তিনি। ছিয়ানব্বইয়ের সেমিফাইনাল বলেন আর নিরানব্বইয়ের সেমিফাইনাল, একাই তো ম্যাচ ঘুরিয়ে দিয়েছেন ডান হাতের কবজি দিয়ে। ফ্লিপার, গুগলি, স্লাইডার, জুটার, সাইডস্পিন, ব্যাকস্পিন, ওভারস্পিন, টপস্পিন কী ছিল না তূণে! স্ট্রাউস, চন্দরপল, বাসিত আলী, বেল, গিবস সবাই বশ মেনেছিলেন তার হাতে, কেবল ভারতবর্ষের ওই বেয়াড়া ছেলেটা ছাড়া।
আর হ্যাঁ, বশ মানেনি ব্যাটিংয়ে নেমে তিন অঙ্কের সংখ্যাটা। সেঞ্চুরি ছাড়া ইতিহাসে এত বেশি রানই নেই আর কারও। পার্থের শেষ বিকেলে না পাওয়া ওই এক রানের আফসোস নিয়েই ক্যারিয়ারটা শেষ হল তার।
অবশ্য জীবন নিয়ে কোনো আফসোস রাখতে চাননি তিনি। সতীর্থরা তাকে ডাকত ‘হলিউড’ নামে। সিনেমা কিংবা সোপ অপেরার চেয়ে তো কোনো অংশে কম ছিল না তার জীবন! সবসময় যেন থাকতে চাইতেন খবরের শিরোনামে। কখনো নিন্দিত, কখনো নন্দিত। এক বিশ্বকাপের ফাইনাল-সেমিফাইনালের ম্যাচসেরা তো, পরের বিশ্বকাপে কিনা খেলতেই পারলেন না ডোপিং অপরাধে।
ওই নিষিদ্ধ বছরেরই আরেকটা ঘটনা। ডোপ-পাপের জন্য সবরকম ক্রিকেট থেকে নির্বাসিত তিনি। এমনকি অনুমতি মিলল না চ্যারিটি ম্যাচ খেলারও। আয়োজকদের অনুরোধ টলাতে পারেনি বোর্ডকর্তাদের। পরে তিনি নিজেই দিলেন বুদ্ধি। নেটে বল করবেন, লোকে অনুদান দিবে তার বল খেলার জন্য। কখনও কখনও তাই জীবনের চেয়েও বড় হয়ে উঠেন তিনি।
বিতর্ককে পিছু ছাড়তে পারেন নি কখনো, নামের শেষে ৭০৮ টেস্ট উইকেট থাকলেও মদিরা আর মহিলা- এই দুইয়ে দুর্বলতা ছিল লোকটার। তবে এসবকে তেমন পাত্তা দেননি কখনো, ব্যক্তিজীবনের সবকিছুকেই ঢেকে দিয়েছেন পারফরম্যান্স দিয়ে। নিজমুখেই বলেছেন, নিজে যা না সেই ভনিতা করতে চাননি কখনও, আর এইজন্যই কিনা লোকে তাকে পছন্দ করে। তাই এই ম্যাজিশিয়ান লোকটা ছিলেন একই সাথে বিদ্রোহী, খানিকটা খ্যাপাটে। চাইলে তাই মিল খুঁজে নিতে পারেন দুনিয়ার আরেক প্রান্তের পাঁচ ফিট পাঁচ ইঞ্চির আর্জেন্টাইন এক লোকের সাথেও।
ওই কানের দুল, সোনালী চুলের হরেক স্টাইল, নাকের জিংক-ক্রিম, বল করার আগের রান-আপ, বাঁহাতের কাপড়ের রিস্টব্যান্ড, ডানহাতের সিলিকন রিস্টব্যান্ড, ডিভাইডিং ট্রাউজারস, আয়েশি ভঙ্গিতে ছুঁড়ে দেওয়া বল, আম্পায়ার আবেদনে সাড়া না দিলে অবিশ্বাসের বাঁকা হাসি, উইকেট পাওয়ার পর দেওয়া লাফ, গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ব্রেকথ্রু… তাঁর মত লেগস্পিন আর কেউই করেনি এই পৃথিবীতে, কখনো করবেও না। আগত এবং অনাগত সব লেগস্পিনারকে তাই মাপা হবে তাঁর মানদণ্ডে। মাঠ এবং মাঠের বাইরে সব জায়গায় যিনি ছিলেন সমান আলোচনায়।
শুভ জন্মদিন, শেন কিথ ওয়ার্ন…