• Other
  • " />

     

    সাবিনাদের সঙ্গে যেদিন জিতে গেছে বাংলাদেশও

    সাবিনাদের সঙ্গে যেদিন জিতে গেছে বাংলাদেশও    

    অলৌকিক ব্যাপারটা আসলে ঠিক কেমন? এটা কি ধরা যায়? ছোঁয়া যায়? তার গন্ধ বা শব্দ কি পাওয়া যায়?

    ঢাকা শহরে যাদের বাস, তাদের জন্য এরকম কিছু খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। কেউ কেউ বলতে পারেন, অসম্ভব। গরম আর ঘামের নোনা স্বাদ যে শহরে প্রতিদিন তুলে দেয় নাভিশ্বাস, ট্রাফিক জ্যাম যে শহরকে স্থবির করে দেয় স্লোমোশনের মতো, সেখানে শরতের অবিশ্বাস্য সুন্দর আকাশও বার্তা দেয় না অলৌকিক কিছুর।

    তবে বুধবার ঢাকা শহরে যারা বের হয়েছেন, তারা হয়তো টের পেয়েছেন এই শহরে গোপনে গোপনে বিরাট কিছু ঘটে গেছে। এমন কিছু, যেটা অলৌকিকের চেয়ে কম নয়। এমন কিছু, যা এই ভূখন্ড আগে দেখেনি। দেখেছে মাদ্রিদের মানুষ, সিবেলাসের পাথুরে চত্বরে তাদের কাছ থেকে খোলা বাসে অভিবাদন পেয়েছেন রোনালদো, বেনজেমারা। দেখেছে বার্সেলোনা, দেখেছে লন্ডন বা ম্যানচেস্টারের রাজপথ। খোলা বাসে চড়ে শিরোপাজয়ী দল যাচ্ছে আর রাস্তার দুইধারে মানুষজন দাঁড়িয়ে হাততালি দিচ্ছে, স্লোগানে স্লোগানে থেমে যাচ্ছে বিজয় সরণি, তেজগাঁর  রাস্তা, এমন কিছু তো স্বপ্নেও ভাবেনি কেউ। তাও আবার মেয়েদের জন্য, যাদের অনেকের দেশের জার্সি গায়ে চড়ানোটাই একটা অলৌকিক ঘটনা।

    ঢাকা শহর স্থবির হয়ে পড়াটা নতুন কিছু নয়। বিমানবন্দর হয়ে উত্তরা, গাজীপুরগামী বাসগুলোতে প্রায়ই অনেকের কেটে যায় ঘন্টার পর ঘন্টা। এক বিজয় সরণিতেই কত দীর্ঘ সময় শুধু অপেক্ষায় কেটে গেছে, সেটার হিসেব করতে বসাটাও বিরাট দুঃসাহসের কাজ। সেই ঢাকা আজ স্থবির হলো এমন একটা কারণে, যাতে বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে যায়নি হয়তো কারোরই। জনগণের ভিআইপিদের জন্য সবকিছু যখন থমকে যায়, তখন সেটা তো আর অপেক্ষা থাকে না, হয়ে যায় প্রতীক্ষা। সেই প্রতীক্ষা বিজয়ীদের একটু কাছ থেকে দেখার জন্য, তাদের অভিবাদন জানানোর জন্য, তাদেরকে আরেকটু কাছ থেকে ভালোবাসা দিতে পারার জন্য। এই প্রতীক্ষার জন্য তাই কাওলার ফ্লাইওভারে নিজের শিশুকন্যাকে নিয়ে মেয়েদের এক নজর দেখার জন্য বসে থাকেন অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন, এই অপেক্ষার জন্য বিজয় সরণিতে মেসির জার্সি পরে বাবার হাত ধরে দেখতে আসে আট বছরের এক স্কুলবালিকা। যার চোখে সবুজ মাঠে বিশ্বজয়ের মায়াঞ্জন এঁকে দিয়ে গেছেন স্বপ্নশকটে থাকা সাবিনারা। সাফ শিরোপা তো একটা অ্যালুমিনিয়ামের ট্রফি মাত্র, বাংলাদেশ তো আসলে জিতে গেছে এখানেই।

    জয় নামের ব্যাপারটাই বাংলাদেশে মোটামুটি একটা বড় ঘটনা, বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে। বড় কোনো শিরোপা তো গুণে ফেলা যাবে করে আঙুলে, সেটা যে খেলার হোক। ফুটবলে সেই ২০০৩ সালের সাফের পর আসেনি আর কোনো উদযাপনের উপলক্ষ। ক্রিকেটেও জাতীয় দলের যে একটি বলার মতো মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের স্মারক, সেটা এসেছে মেয়েদের হাত ধরেই। তবে সাবিনা, কৃষ্ণা, সানজিদাদের এই অর্জনের আসল মাহাত্ম্য তো অন্যজায়গায়। সাফ ফাইনালের আগে বারুদে আগুন ধরিয়ে সানজিদার সেই পোস্টেই আসলে বলা হয়ে গেছে সবটুকু। যেটা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়ার লোভ সামলানো কঠিন, ‘যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থণের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনী কে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।

    পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে।

    আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিন এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাবো। জয় - পরাজয় আল্লাহর হাতে। তবে বিশ্বাস রাখুন, আমরা আমাদের চেষ্ঠায় কোনো ত্রুটি রাখবো না ইনশাআল্লাহ।’

     

    এই লেখাগুলো পড়ে চোখ ভিজে ওঠার জন্য আসলে আপনার ফুটবলভক্ত হওয়ারও দরকার নেই। এমনকি জানারও দরকার নেই, হিমালয়ের কোলে শিরোপা জয় করতে কোন হিমালয় টপকে আসতে হয়েছে তাদের। জানার দরকার নেই, কলসিন্দুরের কোলে ফুটবল খেলার জন্য তাদের কী পরিমাণে বাধার মুখোমুখি হতে হয়েছে। জানার দরকার নেই, তাদের দ্রোণাচার্য গোলাম রাব্বানী ছোটনকে ‘মহিলা কোচ’ বলে কী পরিমাণ উপহাসের শিকার হতে হয়েছে। জানার দরকার নেই, বাড়িতে ফেরার সময় বাসে তাদের কতটা লাঞ্ছনা-গঞ্জনার অভিজ্ঞতা হয়েছে। জানার দরকার নেই, যেমন ছাদহীন বাসে তারা এসেছেন বিজয়ীর বেশে, মাথার ওপর তেমনি একটা ছাদ জোটাতেই তাদের পরিবারকে করতে হয়েছে প্রাণান্ত। এতসব বাধা তুচ্ছ করে যারা আসেন, তাদের বিজয়টা স্রেফ একটা শিরোপাজয় নয়, আসলে ফুটবলের বিজয়, বাংলাদেশের বিজয়।