অ্যান্টনি ম্যাথেয়াস দোস সান্তোস: নরক থেকে উঠে আসা ছেলেটি...
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে নাম লিখিয়েছেন এই মৌসুমে, স্বপ্নের এক বছরে প্রথমবারের মতো সুযোগ পেয়েছেন বিশ্বকাপে। ব্রাজিল ও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফরোয়ার্ড অ্যান্টনি ম্যাথেয়াস দোস সান্তো্সের এই উঠে আসার গল্পটা রূপকথা বললেও কম বলা হবে। যে গল্প আরও অনেক ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারের। যে গল্প আপনাকে ভাবেব, আপ্লুত করবে, কাঁদাবে। প্লেয়ার্স ট্রিবিউনে অ্যান্টনি বলেছেন সেই গল্পটাই
আমার জন্মই হয়েছে জাহান্নামে। আমি মোটেও বাড়িয়ে বলছি না কিন্তু। সাও পাউলোর যে বস্তিতে আমার জন্ম তার নাম ইনফেরিনহো(ছোট জাহান্নাম)।
এলাকাটা ভীষণ কুখ্যাত ছিল মাদক ব্যবসার কারণে। আমার বাসার চৌকাঠ থেকে দশ কদম দূরেই খুচরা মাদক বিক্রেতারা হাতে হাতে মাদক বিক্রি করত ভোর থেকে রাত অবধি। আর তাদের ক্রেতারাও ওখানে দাঁড়িয়েই খেত সেগুলো। ছুটির দিনে কিছুক্ষণ পরপরই বাবা টিভির সামনে থেকে উঠে জানালা দিয়ে মাথা বের করে চেঁচাতেন, যেন ওরা একটু দূরে গিয়ে খায়। বদ গন্ধের কারনে আমরা টিভির সামনে বসে যে খেলা দেখব তার জো ছিল না।
বন্দুক পিস্তলকে ভয় পেতাম না আমরা। কারণ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। ভয় পেতাম পুলিশকে। একবার পুলিশ লাথি মেরে বাসার দরজা ভেঙে বাসায় ঢুকে গিয়েছিল, কোন এক অপরাধীকে খুঁজছিল তারা। ইনফেরিনহোর প্রায় প্রত্যেক বাসাতেই এমন দরজা ভাঙা পড়েছে।
লাশ দেখলে ভয় পেতাম না আমরা। কারণ দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার বয়স যখন ৮ তখন স্কুল যাওয়ার পথে দেখলাম একজন আমাদের গলিতে মরে পড়ে আছে। স্কুল তো যেতে হবে নাকি? আমি চোখ বন্ধ করে লাশটা ডিঙিয়ে স্কুলে গেলাম। ছোট জাহান্নামের জীবন এমনই ছিল।
জীবনে একমাত্র আনন্দ ছিল ফুটবল। বড় ভাইয়ের সাথে বস্তির স্কয়ারে ফুটবল খেলতে যেতাম। একসময় সেটা মাটির ছিল, পরে হল কংক্রিটের। খালি পায়ে কংক্রিটেই ফুটবল খেলতাম, রক্তাক্ত পা নিয়ে প্রতিদিন বাসায় ফিরতাম। ভাল জুতো কেনার পয়সা ছিল না আমাদের, আর ছিল না স্কুল জুতো ছেঁড়ার সাহস।
ঐ স্কয়ারে সবাই খেলত - মাদক ব্যবসায়ী, ট্রাক ড্রাইভার, নির্মাণ শ্রমিকেরা, পুলিশের দারোগারা। ফুটবল মাঠে সবাই ছিল সমান। ড্রিবলিং ব্যাপারটা আমার মাঝে সহজাত ছিল। ফুটবল পায়ে থাকলে মনে কোন ভয় কাজ করত না, কাউকে পরোয়া করতাম না আমি, কেবল কাটাতাম সবাইকে। ড্রাগডিলারদের ইলাস্টিকো মারতাম, দারোগাদের নাটমেগ করতাম, ছিনতাইকারীদের রেইনবো ফ্লিক করতাম। বল পায়ে থাকলে কিছুর তোয়াক্কা করতাম না।
বাসায় বাবা মার সাথে এক খাটে ঘুমাতাম, কারণ আমার জন্য আলাদা খাট কেনার সামর্থ্য ছিল না তাদের। ঘুমের মাঝে পাশ ফিরলেই বাবার সাথে ঠেকতো, ওপাশ ফিরলে মার সাথে। আমার বয়স যখন ১১, তখন বাবা মা আলাদা হয়ে গেলেন। খুব কঠিন সময় তখন। বাবা ভোর ৫টায় কাজে বের হতেন, রাত ৮টায় ফিরতেন। তখনো বাবার সাথে এক খাটেই ঘুমাতাম।
১৪ বছর বয়সে সাও পাউলো দলে ডাক পেলাম। কোচ বলতেন, দেখ সবাই - খেলার দিন সবাইকে জয়ের জন্য ক্ষুধার্ত থাকতে হবে। আমি মনে মনে বলতাম, কোচ আমি আসলেই ক্ষুধার্ত, দুপুরে খাওয়া জোটে নি আমার।
১৮ বছর বয়সে যখন পলিস্তা কাপের ফাইনালে করিন্থিয়ানসকে হারিয়ে আমরা চ্যাম্পিয়ন হলাম তখনো আমি ঐ বস্তির বাসাতেই থাকি, বাবার সাথে এক খাটে ঘুমাই। বাসায় ফেরার সময় রাস্তায় অপরিচিত লোকজন আমাকে ডাক দিত, হেই ম্যান তোমাকে তো একটু আগে টিভিতে দেখেছি। এখানে কি?
আমি এখানে থাকি।
তারা বিশ্বাস করত না, হেসেই উড়িয়ে দিত।
গ্রেমিওর একজন প্লেয়ার একবার একটা লাল রেঞ্জ রোভার নিয়ে মাঠে এল। আমি মাকে বললাম, এই গাড়িটা আমি কিনব এক সময়।
মা বিশ্বাস করলেন না, হেসেই উড়িয়ে দিলেন।
এর এক বছরের মাথাতেই আমি আয়াক্সের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগ খেললাম। নিজের বাসা হল, নিজের খাট। সেই লাল রেঞ্জ রোভার গাড়িটাও কিনে ফেললাম। মাকে দেখালাম, কি বলেছিলাম না?
মা এবার হাসলেন না, কাঁদলেন। খুশির কান্না।
আমাদের ইন্টারনেটের পয়সা ছিল না। পাশের বাসার তোমিওলো কাকুর ওয়াইফাই ব্যবহার করে ইউটিউবে রোনালদিনহো, ক্রিশ্চিয়ানো, নেইমারদের ভিডিও দেখতাম বারবার। এরা আমার কাছে ছিল ঈশ্বরের মত, ধরাছোঁয়ার বাইরে। বস্তির জীবন থেকে তিন বছরের মাথাতেই আমি এখন ম্যানচেস্টারে, থিয়েটার অফ ড্রিমসে ক্রিশ্চিয়ানোর সাথে খেলছি। ব্রাজিলে ড্রেসিং রুম শেয়ার করছি নেইমারের সাথে। অসম্ভব ব্যাপার তাই না? কিন্তু আমি তো বাস্তব করতে পেরেছি।
অনেকে আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার খেলার স্টাইলের ব্যাপারে, কেন আমি এত ড্রিবল করি এ নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করে, হাসি ঠাট্টা করে। আসলে যাদের টেবিলে প্রতি বেলায় খাবার রেডি থাকে তাদেরকে আমাদের, ব্রাজিলের ফাভেলার ছেলেদের এই ব্যাপারটা বুঝানোটা একটু মুশকিল। মানুষ ভুলে যায় ফুটবল কেবলই একটা খেলা, ফুটবল হল অনেক কষ্টের একটা জীবনের মাঝে একটু আনন্দের পরশ। জীবন কঠিন হতে পারে, ফুটবল আমার কাছে কঠিন না। ফুটবল আমি আনন্দের জন্য খেলি। আমার আনন্দ ড্রিবলিং এ, সেটা আপনারা কেড়ে নিতে চান কেন?
মিডিয়ার লোকেরা আমাকে জিজ্ঞেস করে আমার স্বপ্নের ব্যাপারে, আমি কি চাই? চ্যাম্পিয়নস লিগ? ব্যালন দ'অর? বিশ্বকাপ?
না ভাই। এগুলো লক্ষ্য, স্বপ্ন নয়। আমার স্বপ্ন ছিল আমার মা বাবাকে বস্তি থেকে বের করে আনা। সে জন্য জান দিতেও প্রস্তুত ছিলাম আমি। সে স্বপ্ন আমি পূরণ করে ফেলেছি।
প্রতিবার যখন আমি মাঠে নামার আগে জুতোর ফিতে বাঁধি, আমি নিজেকে মনে করিয়ে দেই আমি কোথা থেকে উঠে এসেছি। বস্তি থেকে। আমার এ খেলার স্টাইল ব্রাজিলের ওই বস্তির ছেলেদের জন্য, যাদের জীবনের একমাত্র আনন্দের উৎস ফুটবল। যারা জানে ফুটবল জীবনের থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। ফুটবল সুন্দরতম খেলা, কিন্তু দিন শেষে এটা একটা খেলাই।
আমার হাতে যে সিংহের উল্কিটা দেখেন, সেটা আমার ভাইয়ের আথে একসাথেই করা। এই সেলিব্রেশানটাও আমাদের দুজনের। সেই উল্কিতে লেখা -
যারা বস্তি থেকে এসেছে কেবল তারাই বুঝবে
সবার আমাকে বুঝবার দরকার নেই। "