স্মৃতির বিশ্বকাপ ও দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ
একেকটা বিশ্বকাপ আসে, আর চোখের সামনে হুট করে প্রকট হয়ে উঠে চার বছরে অনেকটা বদলে যাওয়া জীবনের ছবি! হয়তো আগের বিশ্বকাপটা ছিল বন্ধু বান্ধব সবাই একসাথে মিলে রাত কাটানোর একটা উপলক্ষ, অথবা পরিবারের সবার একসাথে বসে সময় কাটানোর মতো একটা উৎসব। এবার হয়তো বিশ্বকাপ তো পরে, পুরো বছরেই সেই বন্ধুদের সাথে কথা হবে না। জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত ভাইবোনদের একসাথে বসে খেলা দেখা হবে বাংলাদেশের বিশ্বকাপে খেলার মতোই দুরূহ। রাত জেগে খেলা দেখার জন্যে বকুনি দেয়া কারো কারো মা-ই হয়তো আর কাছে নেই, বিশ্বকাপ দেখা শুরু যে বাবার সাথে তার সাথে হয়তো অনেকেরই আর কখনো দেখা হবে না এই নশ্বর জীবনে। কালের কষ্টিপাথর ঐকান্তিকভাবে নির্মম; প্রতি চার বছরে আসা এই বিশ্বকাপ সেটা চোখে আঙুল দিয়ে গ্রাহ্য করিয়ে দেয়।
সদ্য কৈশোরে পদার্পিত কারো কাছে বিশ্বকাপ আসছে নিছক প্রকোপনের সম্ভার নিয়ে। তবে জীবননদীর উজানে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়া কারো কাছে তা আর কেবল উত্তেজক মদিরা নয়; ফুটবল উত্তেজনায় বিন্দুর মতো মিশে থাকে বিষাদের গাঢ় উত্তাপ। বিশ্বকাপের আগমন টাইম মেশিনের মতো ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতের বছরগুলোতে, চারের গুণিতকে। আলাদিনের প্রদীপে আটকে থাকা দৈত্যের মতো অজস্র স্মৃতিভান্ডার মনের কোণে এসে ভর করে বিশ্বকাপের অদৃশ্য হাতের ঘষায়, আগত টুর্নামেন্ট তখন গৌণ- খেরোখাতায় বিগত চার/আট/বার বছরে কি হিসাব কেতা হলো তাই তখন মুখ্য থাকে। এই টানাপোড়েনের মধ্যেই বিশ্বকাপের সাথে শুভদৃষ্টির ক্ষণগণনা এগোয়, পর্দায় ভেসে উঠা বিশ্বকাপের ভেন্যু চর্মচক্ষে দেখার জন্যে চলে উদগ্রীব অপেক্ষা।
অংশ না নিয়েই এই বংগদেশে বিশ্বকাপ নিয়ে উত্থিত আবেগ যেখানে সীমা ছাড়িয়ে যায়, অংশগ্রহণকারী দেশগুলোতে আতিশায্যের মচ্ছব হওয়া তাই একবারেই স্বাভাবিক। প্রত্যাশার চাপ তৈরি হয় আকাশমুখি, রথীমহারথী খেলোয়াড়দের অনেকেই সেই চাপে পিষ্ট হয়ে খেই হারিয়ে ফেলে বিশ্বকাপে। বিশ্বকাপ তাই নির্মম, কালের কষ্টিপাথরের মতোই- আপাত অপরিচিত কেউ সোনার কাপে হাত ছুঁইয়ে পেয়ে যেতে পারে অমরত্ব। আবার সেরাদের সেরা কেউ এই বিশ্বকাপ জয়ে হয়ে যায় কালোত্তীর্ণ নায়ক, আবার কেউবা আচ্ছাদিত হয় ব্যর্থতার কালো কুয়াশায়। বছরের পর বছর ক্লাব ফুটবলে পারফর্ম করলেও বিশ্বকাপ না জিততে পারার সেই আক্ষেপ বুকের উপর চেপে থাকে, যুগোত্তীর্ণ হওয়া আর তাই হয়ে উঠে না।
ভাগ্যের খেলাও কি এতে খাটে না? ঘরোয়া লীগে তো ক্লাব পছন্দ করা যায়, সতীর্থ খেলোয়াড়দের নির্বাচন করে অজেয় দল তৈরি করা যায়। কিন্তু জন্মস্থানের গন্ডির উপর তো আর হাত চলে না, ভুল জায়গায় ভুল সময়ে জন্মানো কেউ লীগে রেকর্ড গোল আর হ্যাট্রিক করেও বিশ্বকাপের মৌসুমে তাই অলস বসে থাকে। মৌসুম সেরা হয়েও কেউ কেউ বিশ্বকাপ জয়ের কথা তো পরে, বিশ্বকাপ খেলার কথাও কল্পনা করে না
এত অনিশ্চয়তা আছে বলেই এটা দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। এই শো তে অংশ নেয়া যেমন গৌরবের, আয়োজন করাও তাই। দুনিয়ার তাবত পরাশক্তির লক্ষ্য থাকে তাই বিশ্বকাপ আয়োজনের, এই নিয়ে মাঠের বাইরে কত কাণ্ডই না চলে।
শুরুর আগে থেকেই কাতার বিশ্বকাপ কতভাবেই না ব্যতিক্রম হয়ে গিয়েছে- মধ্যপ্রাচ্যে এবারই প্রথম বিশ্বকাপ, উত্তর গোলার্ধের শীতে প্রথম বিশ্বকাপ, যার জন্যে শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে ইউরোপীয় লীগগুলোকে বন্ধ রাখতে হয়েছে পিক সিজনে। আয়োজন স্বত্ব ঘোষণার পর থেকেই বিতর্ক এই বিশ্বকাপের আরেকটা অনন্য উপাদান। বিডিং নিয়ে কত সমালোচনা চলেছে; ঘুষ কেলেংকারি, ভোটচুরির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। স্বত্ত্বাধিকার এসেছে পশ্চিমাদের ভোটে হারিয়ে, দুর্নীতির অভিযোগের দামামা স্বাভাবিকের চাইতে মিডিয়ায় হয়তো একটু বেশিই বেজেছে।
ভোটে যেভাবেই জিতুক, কাতার তো শক্তভাবে সবকিছুরই জবাব দিতে পারতো একটা সফল বিশ্বকাপ আয়োজন করেই। নির্মাণযজ্ঞে বিতর্কের অবকাশ না রাখা যেতো, মানবাধিকারের ইস্যুগুলো যাতে না আসে তা নিশ্চিত করা যেতো। বিশ্বের সামনে মুসলিম বিশ্বের ইতিবাচক দিকগুলো দেখানোর আদর্শ মঞ্চ ছিল এই বিশ্বকাপ; কিন্তু দাম্ভিকতা, আর পেট্রো-ডলারের ক্ষমতায় মোহাচ্ছন্ন কাতার সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে নেতিবাচকতা দিয়ে মুড়িয়ে বিশ্বকাপের এন্তেজাম করেছে। বিশ্বকাপের স্পর্শমণিতে বিশ্বকর্মা হতে গিয়ে অচ্ছুৎ প্রতিপন্ন হয়েছে- যার হেতুতে অতিথি খেলোয়াড়দের মাঠের আলোচনার বাইরেও শুনতে হচ্ছে রাজনৈতিক প্রশ্নবাণ।
তবে রাত পোহাতে এ সব বিতর্কই মুছে যাবে কিক অফের সাথে সাথে। ঝড় উঠবে ফুটবল নিয়ে ইউরোপ, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার আনাচে কানাচে। আর তার সাথে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা বিতর্ক তুঙ্গে উঠবে এই দেশের ৫৬০০০ বর্গমাইল জুড়ে। সেই উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপুক তরুণের দল, মাঠের উত্তেজনা অজস্র ঘরে নিয়ে আসুক উৎসবের বন্যা। আর জরার ক্লেশে ক্রমশ বন্দী হতে থাকা মানুষগুলোর কানে কিকঅফের বাঁশির শব্দটা এসে বিঁধুক প্রিয়জনের হাতের আঙুলের ডগাটুকুর শেষ স্পর্শের মতো; যাতে অতীতের স্মৃতিগুলো আবার ফেরত যায় মস্তিষ্কের অন্ধকোষ্ঠে, বিশ্বকাপকে উপলক্ষ করে জেগে উঠা হারানোর কষ্ট আবার অবলুপ্ত হয় চাপিয়ে রাখা শোকে।
আর সবুজ মাঠে জোয়ার উঠুক শিল্পের বন্যার! হয়তো কারো হৃদয় পুড়বে এবারো, হয়তো কেউ এবারই পেয়ে যাবে সেই ২৪ ক্যারেট সোনায় মোড়া অমরত্বের ফিলোসফার'স স্টোন। মেঘ-ধোঁয়া-কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে বের হওয়া সূর্যের রশ্মির মতো খেলে যাবে খুশির লহর। ফাইনাল শেষে যেই দলই সেই খুশির বানে ভেসে যাক, অমন বিজয় উদ্দাম নয়নঙ্গম করতে পারাই তো একটা সার্থকতা। কোভিড উত্তর যুগে বর্তমানটাই যখন সত্যযুগ- ফুটবল সেখানে অতিরিক্ত যোগ করুক উত্তেজনার তৃপ্তি। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামে এই বা কম কীসে?