• ফিফা বিশ্বকাপ ২০২২
  • " />

     

    ডিয়েগো, এই মেসিকে দেখে যেতে পারলেন না...

    ডিয়েগো, এই মেসিকে দেখে যেতে পারলেন না...    

    প্রিয় ডিয়েগো,

    অন্যলোক থেকে ফাইনালটা কি দেখেছিলেন কাল? ক্রুইফ, ডি স্টেফানোদের সাথে বসে বারবার হয়তো নখ কামড়েছেন (বিদেহী আত্নায় আবার নখ!),  ‘পুতা পুতা’ বলে গাল পেড়েছেন রেফারিকে।  চাইলেও নশ্বর পৃথিবীতে নেমে আসার সাধ্য নেই আপনার, চাইলেও মেসিকে আলিঙ্গন করতে পারবেন না আর। লিওনেল মেসির হাতে বিশ্বকাপটা দেখার জন্য আরও কয়েকটা বছর বেঁচে থাকলে কী এমন ক্ষতি হতো? লুসাইলে আপনি থাকবেন না, ম্যাচ শেষে মেসিকে জড়িয়ে ধরবেন না, আপনার চোখ থেকে বেয়ে আসা অশ্রু স্কালোনি মুছে দেবেন না, এও কী ভাবা যায়?

    কিন্তু একটা ট্রফি তো উপলক্ষ মাত্র, আপনি তো জানতেন মেসির পুরাণের নায়ক হওয়ার জন্য ট্রফির দরকার নেই। আপনিই তো বলেছিলেন, মেসি যখন অবসর নেবেন তখন সেই হবে সেরা খেলোয়াড়। কী পেল না পেল তাতে কিছু যায় আসে না। আপনি দেখে যেতে পারলেন না, কীভাবে মারাকানার স্বপ্নোদ্যানে মেসির কান্নায় ভেসে গেল একটা ট্রফির আক্ষেপ। আপনি দেখে যেতে পারলেন না, লুসাইলের কলোসিয়ামে কীভাবে ফ্রেঞ্চদের গ্রাস থেকে জয়টা ছিনিয়ে নিয়ে এলেন মেসি।

    ডিয়েগো,আজ থেকে দুই বছর আগে আপনি যখন চলে গেলেন মেসিকে তখনো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে একটা ভূত, সেটা আপনার অদৃশ্য ছায়ার। মেসি যতই বড় খেলোয়াড় হন, দেশের হয়ে তো কোনো শিরোপা নেই তার- মেসিকে তাড়া করে বেড়িয়েছে এই অপবাদ। শুনতে হয়েছে, ‘মেসি বড় খেলোয়াড় হতে পারে, কিন্তু নেতা নন। দলকে অনুপ্রাণিত করতে পারেন না তিনি, নিতে পারেন না চাপও।’ এমনকি জন্মস্থান রোজারিও একটা সময় পর্যন্ত আপন করে নেয়নি তাকে। মেসি হলেন বড়লোকের সেই ছেলে, যে মাঝেসাঝে ছুটি কাটাতে আসত এলাকায়- রোজারিওতে এমন ধারণা ছিল। মেসির বেড়ে ওঠা, মেসির মেসির হয়ে ওঠা- কিছুই রোজারিওতে, বুয়েনস এইরেসে, আর্জেন্টিনায় নয়। সেজন্যই কি কোথাও একটা অভিমানের অদৃশ্য দেয়াল গড়ে উঠেছিল? মেসি কখনো এ নিয়ে মুখফুটে কিছু বলেননি, কিন্তু আপনি তো জানতেন সব।

    ডিয়েগো, আপনি তো একজনই ছিলেন। আপনাকে কখনও কারও মতো হতে হয়নি। কিন্তু ৮৬ এর পর আর্জেন্টিনার সব ফুটবলাররা হতে চেয়েছে আপনার মতো।  কতজন এলেন, কতজন গেলেন- কিন্তু নতুন ম্যারাডোনার ভার কেউ বইতে পারলেন না। এক মেসি সেটা পারবেন, সেটা আপনি বলেছিলেন সবার আগে। আপনি ডাগআউটে ছিলেন, সেবার মেসি পারেননি। আপনি ছিলেন ম্যারাকানায়, দেখেছেন মেসির ওই আরাধ্য ট্রফির কাছে গিয়েও ফিরে আসা।  দেখেছেন, জুলজুল করে ট্রফিটার দিকে মেসির চেয়ে থাকা।  মেসির ওই স্বপ্নের ট্রফিতে আর চুমু খাওয়া হবে না, সেটা কি আপনিও ভেবেছিলেন? কে জানে!

    মেসি আপনি কতটা ভালোবাসতেন, অনেকবারই তা বলেছেন। কিন্তু ২০১৮ সালেই বলেছেন, মেসি তো কোনো নেতা নন। বলেছিলেন, যাকে ম্যাচের আগে ২০ বার টয়লেটে যেতে হয়, সে নেতা হবে কীভাবে?  অন্তত ২০১৮ সাল পর্যন্তও কথাটার বিপক্ষে জোরালো যুক্তি দাঁড় করানো ছিল কঠিন। এমনকি যেবার মেসি এবারের আগে বিশ্বকাপজয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি গিয়েছিলেন, সেবারও তো অধিনায়কের আর্মব্যান্ড মেসি পরলেও অঘোষিত নেতা ছিলেন মাসচেরানোই।  সেটার সাথে বোধ হয় মেসিও খুব বেশি দ্বিমত করবেন না।

    মেসি সবকিছুই দেখছিলেন, ঝিনুকের মতো নীরবে সয়ে যাচ্ছিলেন। কে জানত, অভিমান জমে জমে ভেতরে ফলাচ্ছেন মুক্তো। ২০২০ হওয়ার কথা ছিল কোপায়। সেটা নিয়তির ইচ্ছায় হলো ব্রাজিলে, পরের বছর। আরেকটি মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট, যেখানে দায়িত্ব নিলেন একদমই আনাড়ি আরেক লিওনেল, স্কালোনি। যাকে আপনিই বলেছিলেন, ও তো ট্রাফিক সিগনালও ঠিকমতো চালাতে পারবে না। আরেকবার মেসিরা উঠলেন ফাইনালে। সেই টুর্নামেন্টে যেন দেখা গেল অন্য এক মেসিকে। সতীর্থদের সাথে কথা বলছেন, চিৎকার করে সাহস যোগাচ্ছেন। ফাইনালের আগে সবাই যখন গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে, মেসি যে কথাগুলো বলেছিলেন তা শুনলে নিশ্চিতভাবে গর্ববোধ করতেন আপনি, ‘শোনো সবাই, এই মারাকানায় আমরা ফাইনাল খেলছি ঈশ্বরের ইচ্ছায়। এখানে আমরা ৪৫ দিন ধরে একসাথে আছি, পরিবার থেকে দূরে। আমাদের দিবু মার্টিনেজের ছেলে হয়েছে, এখনো তার মুখ দেখতে পায়নি সে। কারণ এটাই ঈশ্বরের ইচ্ছা। তিনি চেয়েছেন আমরা যেন মারাকানায় ওই ট্রফি জয়ের জন্য এক আত্মা হয়ে যায়। চলো সবাই, মাঠে আমরা দেখিয়ে দিই আমরা কী পারি।’

    ডিয়েগো, এই মেসিকে কি আপনি চেনেন? এই কি সেই মুখচোরা মেসি যে টিম-টকে একপাশে সরে থাকত? কোথায় সেই মেসি যে পর পর দুই ফাইনালে হারার পর চোখের জলে অবসরের ঘোষণাই দিয়ে বসেছিল?  এটাই কি সেই মেসি যাকে কেউ নেতা হয়ে উঠতে দেখেনি?

    মেসি নিজেকে বদলে ফেলেছেন আমূল, ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন দলের বটবৃক্ষ। পাশে পেয়েছেন একদল অকুতোভয়কে, যারা তার জন্য পাজর দিয়ে দুর্গঘাটি গড়তে জানে।  এই দলের সবাই ছিল তার ভক্ত, তার সাথে ছবি তুলতে পারলেই বর্তে যেত। এই দলের আলভারেজ ছিল ছোট্ট, বলেছিল বড় হয়ে মেসির সাথে সে বিশ্বকাপে খেলতে চায়। সেই আলভারেজ বড় হলেন, দাঁড়ালেন মেসির পাশে। ব্যাটম্যান মেসির দরকার ছিল একজন রবিনের, বা মুন্নাভাই মেসির একজন সার্কিটের। এই দলের ডি পল হলেন সেই রবিন বা সার্কিট। এই দলের পারেদেস, রোমেরো, ফার্নান্দেজরা ছিলেন তার গুণমুগ্ধ, তারা হলেন তার অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী। এই দলের গোলপোস্টের নিচে অতন্দ্র প্রহরী এমি মার্টিনেজের দরকার ছিল একজন বড় ভাইয়ের, যার বুকে মাথা রেখে সে কেঁদে আকুল হতে পারে। মেসি হলেন সেই বড় ভাই, যার জন্য আট গজের গোলপোস্ট হয়ে গেল চীনের প্রাচীর, যেটা ভেদ করার সাধ্য নেই কারও।  বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ হারের পর এই দলের দরকার ছিল অধিনায়কের সামনে থেকে পথ দেখানোর, যেটা করে দেখিয়েছেন মেসি। জ্বালাময়ী ভাষণ তো একটা উপলক্ষ, এদের নেতা মেসি হয়ে গেছেন অনেক আগেই। যারা তার জন্য বিশ্বসংসার তন্নতন্ন করে নিয়ে আসতে পারে ১০৮টি গোলাপ। নাদের আলী কথা না রাখলেও ডি পলরা রেখেছেন ঠিকই। ৩৩ বছর পার হয়ে ৩৬ হয়েছে, কিন্তু কথা তারা ঠিকই রেখেছেন।

    ডিয়েগো, আপনার মতো নেতাসুলভ গরিমা, আপনার মতো ক্যারিশমা সম্ভবত ফুটবল ইতিহাসেরই কারোরই ছিল না। ৮৬ বিশ্বকাপের যখন দল জার্সি খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন আপনার বুদ্ধিতেই সেলাই করা ‘মেকশিফট’ জার্সি পরে মাঠে নেমেছিল  দল। সেবার বিশ্বকাপ শুরুর আগে দলে বেশ ঝামেলা চলছিল। পাসারেলা আর আপনার অধীনে দুই ভাগ হয়ে গিয়েছিল। পরে সবকিছু ঠিক করে ফেলেছিলেন আপনি। ভালদানো, বুরুশাগা, বাতিস্তারা তাই আপনার জন্য নিজেদের উজাড় করে দিল মাঠে। যেমন মেসির জন্য দিয়েছেন এনজো ফার্নান্দেজ-ম্যাকঅ্যালিস্টাররা।  কিন্তু আপনি দেখে যেতে পারলেন না, কীভাবে মেসি তাদের সত্যিকারের নেতা হয়ে উঠেছেন। যে মেসিকে সারাজীবন ভদ্র ছেলে হিসেবে জেনেছে সবাই, নেদারল্যান্ডসের সাথে ম্যাচের পর প্রতিপক্ষের ডাগআউটে গিয়ে সে কথা শুনিয়ে আসে। সবাই জানে, মেসি মাথা গরম করে না। আবার সেই শান্ত, নম্র স্বভাবটাই ছিল তার জন্য শাখের খরাত। বলা হতো, মেসির তো ওই কারিশমা নেই, গলা উঁচিয়ে কথা বলতে না পারলে নেতা কীসের? এই বিশ্বকাপে অচেনা এই দুর্বিনীত, উদ্ধত মেসিকেও দেখা গেল। যে কথা বলেছে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে।  ‘রোবট’ মেসির এই ‘রক্তমাংসের’ হওয়া, এসবও তো আপনি দেখে যেতে পারলেন না ডিয়েগো!

    ডিয়েগো, মেসিকে নিয়ে অনেক ধারণাই ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আপনি বেঁচে থাকলে, এই ভুল থেকে ফোটা ফুলের সৌরভে সবচেয়ে বেশি আপনিই আচ্ছন্ন হতেন। আফসোস, এসবের কিছুই দেখে যেতে পারলেন না আপনি। নাকি কে জানে, হয়তো দেখেছেন। হয়তো একদিন এসব নিয়েই মেসির সাথে আপনার হবে ক্লান্তিহীন আড্ডা।

    আপনার গুণমুগ্ধ ভক্ত