ফিরে দেখা কাতার বিশ্বকাপ: জাপান-মরক্কো রুপকথা, মেসির হাতে বিশ্বকাপ ও অন্যান্য
পর্দা উঠে গেল ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’-এর। তবে যেরকম একটা বিশ্বকাপ সবার দেখার সুযোগ হল সেটার স্মৃতি কী সহজেই ভোলা যাবে! সেটার রেশ কাটিয়ে উঠতেই তো সময় লাগবে এখনও। সেই ঘোরেই বিশ্বকাপের সেরা মুহূর্তগুলো আরেকবার ঘুরে আসা যাক।
বিশ্বকাপের গোলের খাতা খোলা: সৌজন্যে ভ্যালেন্সিয়া
বিশ্বকাপের প্রথম গোলটা কিন্তু এনার ভ্যালেন্সিয়ার নাও হতে পারত। ইকুয়েডর অধিনায়কের প্রথম গোলটাই যে অফসাইডের কারণে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে নিজের গল্প সেদিন নিজেই লেখার প্রত্যয় নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন তিনি। ঠিকই পরে পেনাল্টি থেকে বিশ্বকাপের প্রথম গোলটা করেছিলেন। সেই গোলের পর ইকুয়েডরের দলগত উদযাপনটাও হয়তো অনেকের অনেকদিন মনে থাকবে।
সৌদিতে হতভম্ব আর্জেন্টিনা
বিশ্বকাপ ইতিহাসের অন্যতম বড় অঘটন হয়তো আর্জেন্টিনার সেই হার। ১-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর সৌদি আরব যেভাবে ফিরে এসে আর্জেন্টিনাকে হারিয়েছিল তাতে তো অনেকেই ২০০২ সালের ভুত দেখতে শুরু করেছিলেন আর্জেন্টিনার মাঝে। লুসাইলের সেই হতাশার রাত মাটি দিয়ে এই লুসাইলেই মেসি উঁচিয়ে ধরলেন নিজের স্বপ্ন স্মারক। তবে ২০২২ বিশ্বকাপের কথা বললেই এই ম্যাচের কথা উঠবেই, অনেকের কাছে যেটা আর্জেন্টিনার রূপকথার শুরু, অনেকের কাছেই যেটা সৌদিদের বীরত্ব গাঁথা।
এল বিশ্বকাপ, এলেন ওচোয়া
প্রতি চার বছর পরপর যেন বিশ্বকাপ দেখা পায় গিয়ের্মো ওচোয়া নামক গোলবারের এক দৈত্যের। বিশ্বকাপ মানেই ওচোয়ার দানবীয় পারফর্ম্যান্স, ব্যতিক্রম হল না এবার। আধুনিক ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা ফরওয়ার্ড রবার্ট লেভান্ডফস্কি নিজের প্রথম বিশ্বকাপ গোল পাবেন, এই আশা নিয়েই এসে দাঁড়ালেন পেনাল্টি স্পটে। নিলেন দারুণ এক পেনাল্টি, কিন্তু শুধুই যে সেটা পড়লেন তা নয়, ক্ষিপ্র এক ঝাঁপে অসামান্য দক্ষতায় প্রতিহত করলেন জোরালো সেই শট। বিশ্বকাপের পাতায় ওচোয়া সেই সাথে আরও একবার লেখিয়ে ফেললেন তার নাম।
রকেট রিচা৯
ব্রাজিলের প্রথম ম্যাচ, প্রতিপক্ষ সার্বিয়া। প্রথমার্ধে ব্রাজিলকে আটকিয়ে রাখা সার্বিয়ার জালে অবশেষে এক গোল দিয়েছে ব্রাজিল। এরপর বাঁ প্রান্ত দিয়ে ভিনিসিয়ুস জুনিয়র বুটের বহিরাংশ দিয়ে বল তুলে দিলেন মাঝে থাকা প্রথম গোলদাতা রিচার্লিসনের উদ্দেশ্যে। বলটা তিনি বুঝে নিলেন, বল যে খানিকটা উঠে গিয়েছে সেটা বুঝতেও সময় নিলেন না। শিল্পী যেমন ক্যানভাসে তুলির আঁচড় দিতে থাকলে আপাতদৃষ্টিতে এলোমেলো লাগে আর শেষ হলে চোখ ধাধিয়ে যায়, রিচার্লিসনের গোলটাও হল সেরকম। শিল্পীর সেই শিল্পের প্রতিটা তুলির আঁচড় যেমন মাথায় আগে থেকেই আঁকা হয়ে যায় রিচার্লিসনের এই সিজার কিকটাও যেন ছিল সেরকমই।
ব্লু সামুরাইয়ে নীল জার্মানি
রক্ষণভাগ থেকে বাড়ানো বলে হতভম্ব জার্মান ডিফেন্ডার শ্লটারব্যাক, তার পাশ দিয়ে অদম্য দোন তুলোর মত নরম ছোঁয়ায় বল পায়ে নামিয়ে আনলেন, ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলকিপার নয়্যারের হাতের পাশ দিয়ে আগুনে শটে বল জালে জড়ালেন - জাপানের এই প্রত্যাবর্তন কী সহজে ভোলা যাবে! শুধু তাই নয়, শেষ দিনে স্পেনকেও একই ভঙ্গিমায় হারিয়ে যে গ্রুপ ‘ই’ থেকে শীর্ষ দল হিসেবেই পরের রাউন্ডে গিয়েছিল ব্লু সামুরাইরা।
রোনালদোর রেকর্ড
ঘানার বিপক্ষে পেনাল্টি থেকে গোল দিয়েই দেখা মিলল পুরনো সেই ‘সিউউউউ’ উদযাপনের। সেই সাথে বিশ্বকাপ ইতিহাসে টানা ৫ বিশ্বকাপে গোল করা প্রথম খেলোয়াড় হয়েছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বিতর্ক, সমালোচনা, হৃদয়ভঙ্গের এক বিশ্বকাপ হয়ে থাকা রোনালদোর জন্য সেটাই হয়তো ছিল সেরা মুহূর্ত।
আবুবকরের বিদায়ী উদযাপন
তখন পর্যন্ত আসরে জয়ের ধারা বজায় রাখা একমাত্র দল ব্রাজিল। তিতে সেই ম্যাচে নয় পরিবর্তন আনলেন। সুযোগ বুঝে ক্যামেরুন লড়ল শেয়ানে শেয়ানে। আর ম্যাচের অন্তিম মুহূর্তে ব্রাজিলের কফিনে দারুণ এক হেডে শেষ পেরেক ঠুকে দিলেন ক্যামেরুন অধিনায়ক ভিনসেন্ট আবু বকর। হলুদ কার্ড খেয়ে থাকা আবু বকর এরপর জার্সি খুলে উদযাপন করে যে লাল লারদ দেখলেন, রেফারির সাথে করমর্দন করে মাঠ ছাড়লেন, সেই মুহূর্তটা যেন ‘ভিনি,ভিডি, ভিসি’-এর কথাই মনে করিয়ে দিল।
ত্রাণকর্তা মেসি
মেক্সিকোর বিপক্ষে বাঁচা মরার ম্যাচ, হারলেই বাদ, ড্র করলেও আটকা পড়তে হতে পারে সমীকরণের মারপ্যাঁচে। আর্জেন্টিনার ত্রাণকর্তা রুপে আবির্ভূত কে হয়েছিলেন সেটা আঁচ করা বোধহয় এখন ভাত খাওয়ার মতই সহজ এক কাজ। দূরপাল্লার এক শটে মেসি যেই ভঙ্গিমায় দলকে এগিয়ে দিয়েছিলেন সেদিনটাতেই মেসি যেন বার্তা দিয়ে রেখেছিলেন বিশ্বজয় না করে এবার কাতার ছাড়ছেন না।
ভেগহর্স্টে ডাচদের অসম্ভবকে প্রায় সম্ভব করা
বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা ২-০ গোলে এগিয়ে থেকে ম্যাচ হারেনি। তবে সেটাই যেন করে বসেছিলেন প্রায় ভাউট ভেগহর্স্ট। মাঠে নামার আগে হলুদ কার্ড দেখার পর মাঠে নেমেই দারুণ এক হেডে প্রত্যাবর্তনের আশা জাগিয়েছিলেন। ম্যাচের যোগ করা দশ মিনিটের শেষ মিনিটে আর্জেন্টিনাকে হতভম্ব করে দারুণ এক ফ্রি-কিক থেকে পাস বুঝেই জাল খুঁজে নেন সেই ভেগহর্স্ট। এমির শুট আউট বীরত্বে সেবার ডাচদের বাড়ি ফিরতে হলেও ভেগহর্স্টের শেষ গোলটা হয়তো অনেকদিন মনে রাখবেন দর্শকরা।
লিভাকোভিচ প্রাচীরের ধাক্কায় নেইমারদের কান্না
ব্রাজিল যে কোয়ার্টার ফাইনালে বিদায় নিবে, বিশ্বকাপের আগে এই কথা বললে আপনি হয়তো হেসে উড়িয়ে দিতেন। সেটাকেই সত্যি করে নেইমারদের ভেঙে দিয়ে সেমিতে জায়গা করে নিয়েছিল ক্রোয়েশিয়া। ম্যাচজুড়ে ব্রাজিলের একের পর এক আক্রমণ প্রতিহত করার পরে টাইব্রেকারেও ডমিনিক লিভাকোভিচ যা দেখিয়েছিলেন তা হয়তো এই বিশ্বকাপের সেরা গোলকিপিং পারফর্ম্যান্সগুলোর একটাই হয়ে থাকবে।
মরক্কো রুপকথা
ক্রোয়েশিয়া, বেলজিয়াম, কানাডার গ্রুপ থেকে অপরাজিত থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে পরের রাউন্ডে, স্পেনকে শেষ ষোলতে, পর্তুগালকে কোয়ার্টার ফাইনালে নাকাল করে প্রথম আফ্রিকান দল হিসেবে সেমি ফাইনালে জায়গা করে মরক্কো শেষমেশ থেমেছে ফ্রান্সের বিপক্ষে সেমিতে, সেটাও দুটো মুহূর্তেই বলা চলে। বিশ্বকাপে চতুর্থ হওয়া মরক্কো তো না জিতেও বিশ্বকাপের জয়ীদের কাতারেই থাকল। মরক্কো খেলোয়াড়দের মায়েদের সাথে উদযাপন, দলীয় সংহতি - সবই যেন বিশ্বকাপের নজর কাড়া মুহূর্ত।
এমবাপে-মেসি, মেসির হাতে স্বর্ণে মোড়ানো ট্রফি
ফাইনালটাকে ইতিহাসের সেরা ফাইনাল বললেও ভুল বলা হবে না। মেসি করলেন দুই গোল, জবাবে এমবাপে করলেন হ্যাটট্রিক। খেলা শেষমেশ গড়াল টাইব্রেকারে। সেটাও হত না যদি না থাকতেন একজন এমি। বিশ্বকাপ ফাইনাল ইতিহাসের তর্কসাপেক্ষে সেরা সেভ করে ম্যাচের শেষ মিনিটে কোলো মুয়ানিকে প্রতিহত করে টাইব্রেকারেও আরও একবার নায়ক তিনিই, অসাধারণ এক বিশ্বকাপের শেষে ফুটবলটা যার হাতে শিরোপা না উঠলে অপূর্ণ থেকে যেত, সেই মেসির হাতে ট্রফি দেখতে পেরে তো হাসলেন, কাঁদলেন, বিভেদ ভুলে অভিনন্দন জানালেন সবাই।