• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    'ওভারথিংক' না পরীক্ষা-নিরীক্ষা? গার্দিওলা কি বড় ম্যাচে বেশিই চিন্তা করেন?

    'ওভারথিংক' না পরীক্ষা-নিরীক্ষা? গার্দিওলা কি বড় ম্যাচে বেশিই চিন্তা করেন?    

    এই সময়ের সেরা কোচ বললে অনেকে তার নাম বলবেন। গত এক দশকে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে তার চেয়ে বেশি সফল আর কেউ নেই। লা লিগা, বুন্দেসলিগা, প্রিমিয়ার লিগে একাধিক শিরোপা জিতেছেন, চ্যাম্পিয়নস লিগসহ জিতেছেন সম্ভাব্য সবকিছুই। তারপরও পেপ গার্দিওলাকে নিয়ে একটা অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। তিনি নাকি 'ওভারথিংক' করেন। বাংলায় যেটাকে বলা যায় বেশি চিন্তা করা বা আরেকটু গ্রাম্য বাংলায় 'পাকনামি'। কিন্তু অভিযোগটা কি ঠিক?

    এই সপ্তাহেই নটিংহাম ফরেস্টের বিপক্ষে ম্যাচের পর প্রশ্নটা আবার উঠেছে। গার্দিওলা এই ম্যাচে বের্নাদো সিলভাকে খেলিয়েছেন লেফটব্যাক হিসেবে। আসলে তার পজিশনটা ঠিক লেফটব্যাক নয়, হাফব্যাক বলা যায়। ম্যাচটা সিটি শেষ পর্যন্ত ড্র করেছে। তবে গার্দিওলা এই কাজটা এক ম্যাচ আগেও করিয়েছিলেন। আর্সেনালের বিপক্ষে আগের সপ্তাহের ম্যাচটা ছিল তার জন্য বড় পরীক্ষা। সেই ম্যাচেও তিনি সিলভাকেই খেলিয়েছিলেন লেফটব্যাক হিসেবে। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত খুব একটা কাজে দেয়নি। সিলভা ন্যাচারাল লেফট ব্যাক নন, তাই প্রতিপক্ষ রাইট উইঙ্গার বুকায়ো সাকাকে ট্র্যাক করতে গিয়ে বারবার ওপরে উঠে যাচ্ছিলেন। এমনিতে রক্ষণের সময় গার্দিওলার সময় শেপ হয় ৪-৪-২, আর আক্রমণে সেটা হয় ৩-৪-৩। যার মানে সিলভা রক্ষণের সময় লেফটব্যাক থাকেন ঠিকই, কিন্তু আক্রমণের সময় হয়ে যান লেফট সাইডেড সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার। এই রোলকেই বলা হয় হাফব্যাক। সিলভার পজিশন নড়ে যাওয়ার কারণে অনেক সময় লেফটব্যাকের কাজ করতে হয়েছে নাথান আকেকে। সেজন্য লোন সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার হিসেবে রুবেন দিয়াসকে খেলতে হয়েছে কখনো। আর্সেনাল স্ট্রাইকার এনকেটিয়াহ দিয়াসের বিপক্ষে সুযোগটা সেভাবে নিতে পারেননি। তবে গ্যাব্রিয়েল জেসুস খেললে গার্দিওলা কাজটা করতেন কি না সেটাই প্রশ্ন।

    কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আর্সেনালের বিপক্ষে তার এই পরীক্ষা কাজে আসেনি। সিলভা বার বার বিপজ্জনক ফাউল করছিলেন সাকা ও তোমিয়াসোকে। ভাগ্য ভালো থাকায় বড় শাস্তি থেকে বেঁচে গেছেন। দ্বিতীয়ার্ধে সিলভাকে রাইট উইঙ্গার হিসেবে উঠিয়ে মাহরেজকে নামান গার্দিওলা। আকে চলে আসেন তার জন্য কিছুটা ন্যাচারল লেফটব্যাক পজিশনে। সিটি আগের চেয়েও গুছিয়ে খেলতে থাকে। এবং এই অর্ধে তিন গোল দিয়ে ম্যাচটা নাগালের বাইরে নিয়ে যায়। অথচ আকেকে তার ন্যাচারাল পজিশনে প্রথম থেকে খেলালে হয়তো পরিস্থিতিটা এমনই হতো না। 

    আর্সেনালের ম্যাচটা একটা উদাহরণ মাত্র। গার্দিওলার বিপক্ষে অভিযোগ, বড় ম্যাচে এরকম বেশি চিন্তা তিনি প্রায়ই করেন। গার্দিওলা নিজেই অভিযোগটা জানেন, সেটা স্বীকারও করেছেন। বড় ম্যাচে তিনি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে ভালোবাসেন, যেটার মাশুল সবচেয়ে বেশি দিয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগে। গত কয়েক মৌসুমেই এরকম উদাহরণ আছে। ২০২০ চ্যাম্পিয়নস লিগে লিঁওর সাথে ম্যাচে গার্দিওলা নামাননি মাহরেজ, ফোডেন, দেভিড সিলভা, বের্নাদো সিলভাদের কাউকে। থ্রি ম্যান ব্যাক নিয়ে খেলতে নেমেছিল সিটি। স্টার্লিং যদিও অবিশ্বাস্য মিস করেছিলেন, তাতে গার্দিওলার কিছু করার ছিল না। তবে ম্যাচ শেষে প্রশ্ন উঠেছেন, গার্দিওলা ভুল দল নামিয়েছেন কি না। 

    পরের চ্যাম্পিয়নস লিগে সেই প্রশ্ন উঠেছে আরও জোরেশোরে। চেলসির সাথে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। গার্দিওলা কোনো ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডাড় ছাড়াই নামলেন। রদ্রি ও ফার্নান্দিনহো দুজনেই বেঞ্চে। ইলকে গুন্ডোয়ানকে দায়িত্ব দেওয়া হলো একটু নিচে নেমে ডিফেন্সিভ কাভার দেওয়ার জন্য। কিন্তু গুন্ডোয়ানের ন্যাচারাল পজিশন সেটা নয়। সেই ফায়দা নিল চেলসি। হ্যাভাররের গোলটা এসেছিল সিটির এই পজিশনাল ভুল থেকে। 

    এর আগে ২০১৫ সালে বায়ার্নের হয়ে বার্সার বিপক্ষে তিনি সেমিফাইনালে নামান থ্রি ম্যান ব্যাক। যদিও এর আগে পুরো টুর্নামেন্টে তিনি ডিফেন্সে চারজন নিয়েই খেলে এসেছিলেন। এরকম উদাহরণ আসলে অনেক আছে। লিভারপুলের বিপক্ষে লাপোর্তকেকে লেফটব্যাক খেলানো, ম্যান ইউনাইটেডের বিপক্ষে ২০২০ সালের দুজন ফলস নাইন নিয়ে নামা... অনেকই দেওয়া যাবে।

    তার সাবেক সহকর্মীদের কাছে জানতে হয়েছিল গার্দিওলার এই ভুল নিয়ে। ডমেনেক তরেন্ত গার্দিওলার সাথে কাজ করেছিলেন বার্সা বি দলে। তার মতে, শতকরা ৯৯ ভাগ কোচই বড় ম্যাচে কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। কিন্তু গার্দিওলা উলটো। তিনি প্রতিপক্ষ নিয়ে বড় ম্যাচে অনেক বেশি ভাবেন। এবং সেই ভাবনা থেকেই তিনি এমন কিছু করেন, যেটা বড় ম্যাচে অপ্রত্যাশিত। তরেন্ত মনে করিয়ে দিয়েছেন, এমন নয় গার্দিওলা চ্যাম্পিয়নস লিগে বড় ম্যাচ জেতেননি। যেগুলো জিতেছেন, সেখানে তার ট্যাকটিকস নিয়ে কিন্তু বেশি কথা হয় না। রিয়ালের বিপক্ষে এক দশক আগে একটা ম্যাচে লিওনেল মেসিকে ফলস নাইন খেলানোর সাহস দেখিয়েছিলেন। যে ম্যাচে ৬ গোল দিয়েছিল বার্সা, যেটা সম্ভবত লিখে দিয়েছে আধুনিক ফুটবলের গতিপথও।

    বায়ার্নের থমাস মুলার আরেকটা ইন্টারেস্টিং কথা বলেছেন। গার্দিওলা নিজের দল কৌশল নিয়ে এমনভাবে চিন্তা করেন, সেটা লং টার্মে দলের জন্য ভালো। এজন্য মাঝারি বা দুর্বল দলের বিপক্ষে তার দল সবসময় ভালো করে। লিগে তার সাফল্যের হারও বেশি। কারণ তখন তার ফিলোসফিতে খেলেন, সেটাতে সাফল্যও আসে। কিন্তু বড় ম্যাচে বিশেষ করে ্যচাম্পিয়নস লিগে অনেক সময় প্রতিপক্ষের শক্তিকে বেশি বড় করে দেখেন। ফলে নিজের সহজাত সেট আপ থেকে সরে আসেন। সেটাতে মাঝে মাঝে হিতে বিপরীত হয়। আবার টনি ক্রুসের মতো কেউ কেউ মনে করেন চ্যাম্পিয়নস লিগে জেতার জন্য একটু ভাগ্যও দরকার হয়। সেটা কখনো কখনো গার্দিওলা পান না। 

    তবে গার্দিওলা আভাস দিয়েছেন, পরীক্ষা নিরীক্ষা তিনি থামাবেন না। সামনে তাই এমন আরও অনেক চমকই দেখা যেতে পারে।