অলরাউন্ড বীরত্বগাঁথা: ফিরে দেখা সাকিব আল হাসানের সেরা পাঁচ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স
চট্টগ্রামে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ম্যাচে বাংলাদেশের স্বস্তির জয়ে আরও একবার কান্ডারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন সাকিব আল হাসান। বাংলাদেশের হয়ে ওয়ানডেতে ২৫তম বারের মত ম্যাচ সেরা হয়েছেন তিনি। ক্যারিয়ারে অসংখ্য ম্যাচ তো ব্যাটে-বলে জিতিয়েছেন বটেই, অনেক হেরে যাওয়া ম্যাচেও শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়ে গিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তিনি যেন আক্ষরিক অর্থেই এসেছেন ‘সুপারম্যান’ হয়ে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩০০ ওয়ানডে উইকেটের মাইলফলক তো ছুঁয়েছেন বটেই; সেই সাথে ওয়ানডেতে সর্বোচ্চ বার ম্যাচে ৫০ রান ও ৪ উইকেটের রেকর্ড গড়েছেন তিনি (৪ বার)। তার এই অসামান্য অলরাউন্ড বীরত্বের সৌজন্যে ফিরে দেখা যাক তার ক্যারিয়ারের সেরা পাঁচ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স।
১০৬ (১১৩), ১০-০-৫৪-৩
মিরপুর, ২০১০
প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড
সেই বিখ্যাত নিউজিল্যান্ড সিরিজের সবচেয়ে স্নায়ুক্ষয়ী ম্যাচই বলা যায় সেটা। মিরপুরে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ গুটিয়ে গেল ২৪১ রানে। তার মধ্যে ১০৬ রানই এল সাকিবের ব্যাট থেকে! দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান যখন ৩৭ তখন নিশ্চয়ই বলে দিতে হয় না যে কত বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েও ৯৩.৮ স্ট্রাইক রেটে এই সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছিলেন তিনি। সেই ম্যাচে অধিনায়ক হয়ে থাকা সাকিব বল হাতেও দেখালেন ঝলক। শেষ দুই ওভারে যখন নিউজিল্যান্ডের প্রয়োজন ২৪ রান সেদিন তখন ৪৯তম ওভার করতে এসেছিলেন সাকিব। সেই ওভারে ড্যারিল টাফিকে ফেরালেন, তার আগের বলেই ন্যাথান ম্যাককালামও ফিরলেন রান আউট হয়ে; আর সাকিব গুনলেন ৮ রান। ম্যাচটা সেখানেই ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সাকিব। বাংলাদেশ ম্যাচটা জিতেছিল ৯ রানে। সেঞ্চুরির পর ৩ উইকেট নিয়ে সেদিন ম্যাচ সেরা হয়েছিলেন সাকিব।
৭৫ (৭১), ১০-০-৩৫-৪
চট্টগ্রাম, ২০২৩
প্রতিপক্ষ ইংল্যান্ড
এই ম্যাচের স্মৃতি তো তাজাই। ব্যাটিংয়ে সাকিবের শেষদিকের একাকী লড়াইটা নিশ্চয় মনে আছে আপনার। ফিফটি করা ব্যাটারদের মধ্যে তারই কেবল স্ট্রাইক রেট ছিল ১০০-এর ঊর্ধ্বে। এরপর বল হাতে যা করলেন তা অনেকদিন মনে রাখবে বাংলাদেশ। বিশেষ করে জেমস ভিন্সকে যেই অসামান্য অফ ব্রেকে স্তব্ধ করে দিলেন ম্যাচটাও যেন সেখানেই বাংলাদেশের দিকে ঘুরিয়ে ফেলেছিলেন সাকিব। ৪র্থ উইকেট নিয়ে তো হয়ে গেলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে ওয়ানডেতে ৩০০ উইকেট শিকারি; সেই সাথে হয়েছেন ৩০০ ওয়ানডে উইকেট শিকারি দ্রুততম বাঁহাতি স্পিনার। এমনকি ৬০০০ ওয়ানডে রান ও ৩০০ ওয়ানডে উইকেটের মাইলফলকটাও ছুঁয়েছেন দ্রুততম সময়ে। ম্যাচ সেরা তো হয়েছেন বটেই; নিজের ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্সটাও দেখালেন অন্দরমহলের কোন্দল ও সমালোচনাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে।
১০১ (৯৯), ১০-০-৪১-৪
চট্টগ্রাম, ২০১৪
প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ে
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই পারফরম্যান্সকে তালিকায় দেখে কিছুটা বিস্মিত হতে পারেন। হয়তো ২০১৯ বিশ্বকাপে আফগানিস্তানের বিপক্ষে তার ফিফটি ও ফাইফারকেও এখানে স্থান দিতে পারেন। তবে চট্টগ্রামের এই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে যেই বিপদে পড়ে বাংলাদেশ শুরু করেছিল সেটাই এই সাকিব-শো'কে আরও তাৎপর্যবহ করে তোলে। শুরুতে ব্যাটিংয়ে নেমে বাংলাদেশ ৩ উইকেট খুইয়েছিল মাত্র ৩১ রানে। সেখান থেকে মুমিনুল হককে নিয়ে ইনিংস মেরামতের কাজটা শুরু করেছিলেন সাকিব। দলীয় ৭০ রানের মাথায় মুমিনুলও ফিরলে কাজটা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে সেখান থেকেই মুশফিকুর রহিমের সাথে ১৪৮ রানের জুটি গড়েন সাকিব। দারুণ এক সেঞ্চুরিতে যেই ভিত গড়ে দিয়েছিলেন তার ওপর দাঁড়িয়ে শেষে ঝড় তুলেছিলেন সাব্বির রহমান। বল হাতে নিয়ে সাকিব নিজেই সেই সংগ্রহ জিম্বাবুয়ের ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন রাজা, সিবান্দা, মিরে ও নিয়ুম্বুকে ফিরিয়ে। বলা বাহুল্য এখানেও ম্যাচ সেরা সাকিব।
৮-০-৫৪-২, ১২৪* (৯৯)
টনটন, ২০১৯
প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ
২০১৯ বিশ্বকাপের অতিমানবীয় সাকিবের মহিমায় বিশ্ব মঞ্চ আরও একবার ভাস্বর হয়েছিল ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচে। বিশ্বকাপে দারুণ শুরুর পর টানা দুই ম্যাচ হেরে বাংলাদেশ তখন খেই হারাতে বসেছে। ইংল্যান্ডের মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস আক্রমণের জন্য অনেকেই তাদের এগিয়ে রেখেছিলেন। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে নাস্তানাবুদ করার পর অস্ট্রেলিয়াকেও চেপে ধরেছিল তাদের পেসাররা। সেসব কী অবশ্য সাকিবকে ছুঁতে পারে! প্রথমে ব্যাট করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩০০-পেরুনো সংগ্রহ পেলেও ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা এভিন লুইসের পর নিকোলাস পুরানকে ফিরিয়েছিলেন সাকিব। ৩২২ রানের লক্ষ্যে মাঠে নামলেন ৮.২ ওভারে। সেখান থেকে এই রান তাড়াকে যে এভাবে হাতের মোয়া বানিয়ে ফেলবেন সেটা হয়ত ক্যারিবিয়ানরাও ঠাহর করতে পারেনি। সেদিন লিটনও দিয়েছিলেন যোগ্য সঙ্গ। তবে সাকিবের ৯৯ বলে ১২৪* রানের গোছানো ইনিংসটা কাজটা সহজ করে দিয়েছিল তার জন্য। বিশ্বমঞ্চেও এটা বোধহয় তর্কসাপেক্ষে সাকিবের সেরা ওয়ানডে ইনিংস।
৫৮ (৫১), ৮-০-৪১-৪
মিরপুর, ২০১০
প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড
‘বাংলাওয়াশ’ শব্দটা যেই সিরিজ থেকে লোকের মুখে মুখে ঘুরতে শুরু করল সেই সিরিজ তো সহজে ভোলার নয়। সেই সিরিজের প্রথম ওয়ানডেতে রুদ্ধশ্বাস জয়ে অসামান্য অবদান রেখেছিলেন সাকিব আল হাসান। ব্যাট হাতে টপ ও মিডল অর্ডারে শাহরিয়ার নাফীস ছাড়া সেদিন কেউই ৬০ স্ট্রাইক রেটেও ব্যাট করতে পারেননি। সেখানে পাঁচে নেমে তিনি খেললেন ১১৩.৭২ স্ট্রাইক রেটের ইনিংস। মিলস-ন্যাথান ম্যাককালাম-ভেট্টোরিদের এক হাত নিয়ে সেদিন খেললেন সময়োপযোগী এক ইনিংস। দলীয় ২২৮ রানে সর্বোচ্চ সংগ্রহ তারই। বল হাতেও সেদিন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি তিনিই! শুধু তাই না, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম যখন লাগামছাড়া হয়ে উঠছিলেন, তখন ৪৫ বলে ৬১ রান শেষে সাকিবই থামিয়েছিলেন তাকে। এর আগে জেসি রাইডারকে ফিরিয়ে প্রথম শিকার এনে দেওয়া সাকিব স্নায়ু ধরে রেখে পরে ফিরিয়েছিলেন গ্র্যান্ট এলিয়ট ও ন্যাথান ম্যাককালামকে। ডি/এল মেথডে ৯ রানের সেই জয়ে স্বাভাবিকভাবেই ম্যান অফ দ্য ম্যাচও সাকিব।