• ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ
  • " />

     

    কেন এই মৌসুমে রবিন হুড মুডে খেলছে লিভারপুল?

    কেন এই মৌসুমে রবিন হুড মুডে খেলছে লিভারপুল?    

    ম্যান ইউনাইটেডকে ৭-০’তে হারানোর পর সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতেই টেবিলের সর্বনিম্ন দল বোর্নমাউথের কাছে হেরে বসল ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল। এই ধারার ফলাফল লিভারপুলের জন্য এখন রুটিনে পরিণত হয়েছে। ম্যান সিটি, ম্যান ইউনাইটেড, টটেনহাম, নিউক্যাসল- এ মৌসুমে লিগের প্রায় সব বড় দলকেই হারিয়েছে লিভারপুল। আবার রেলিগেশন লড়াইয়ে থাকা দলগুলোর বিপক্ষে রুটিন করে পয়েন্ট হারিয়েছে তারা। 

    বড় পরিসরে ব্যাপারটা খেয়াল করলে আপনার মনে হতে পারে, লিভারপুল বড় দলগুলোর কাছ থেকে পয়েন্ট নিয়ে ছোট দলগুলোকে দিয়ে আসছে। কিন্তু লিভারপুলের এই রবিন হুডীয় আচরণের পিছনে কারণ কী? 

    একটি নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে বের করাটা কঠিন। সবাই জানে, এবার নিজেদের পরিচিত রূপে নেই লিভারপুল। গত মৌসুমে মাত্রাতিরিক্ত ম্যাচ খেলা, বড় দুটি শিরোপায় শেষদিনে গিয়ে হারাটা দলের খেলোয়াড়দের শারীরিক ও মানসিক, দুইভাবেই দুর্বল করে দিয়েছে। ম্যানেজারের পাশাপাশি দলের অনেক খেলোয়াড় সরাসরি এ কথা স্বীকারও করেছেন। গত মৌসুমে দলের হয়ে প্রায় সকল ম্যাচে শুরু করা ভার্জিল ভ্যান ডাইক বলেছেন, লম্বা ইনজুরি থেকে ফিরে এভাবে টানা ম্যাচ খেলে যাওয়ায় তার শরীরই ভেঙে গিয়েছিল। এরকম টানা খেলে যাওয়ার চাপ নিতে গিয়ে ঘনঘন ইনজুরিতে পড়ছেন দলের অন্য খেলোয়াড়েরা। সঙ্গে রয়েছে ক্লাবের মেডিকেল ডিপার্টমেন্ট ও ফিটনেস কোচদের মধ্যকার কোন্দল। থিয়াগো, ডিয়গো জটা, লুইস ডিয়াজ মৌসুমের একটি বড় সময় থেকেছেন মাঠের বাইরে। ভ্যান ডাইক, ইব্রাহিমা কোনাতে, ডারউইন নুনেজও চোটের জন্য দলের বাইরে থেকেছেন কয়েক ম্যাচ।   

    শারীরিক ফ্যাটিগ মৌসুমের শুরু থেকেই লিভারপুলের খেলাকে প্রভাবিত করে আসছে। মৌসুমের প্রায় ম্যাচেই প্রতিপক্ষের তুলনায় কম দৌড়েছে অলরেডরা, যা কোনো ইয়ুর্গেন ক্লপ দলের জন্য অস্বাভাবিক এক ব্যাপার। ক্লপের গেগেনপ্রেসিং এক অর্থে ভেঙেই পড়েছে এই মৌসুমে। কিন্তু এরপরও মৌসুমে সিটিকে দুবার হারিয়েছে তারা। ক্লপের শিষ্যরা মৌসুম শুরুই করেছিল সিটিকে কমিউনিটি শিল্ডে হারিয়ে। কিন্তু এরপরই লিগের প্রথম দুই ম্যাচে ফুলহাম ও ক্রিস্টাল প্যালেসের সঙ্গে ড্র করে তারা। 

    লিগ মৌসুমে তাদের প্রথম বড় জয় আসে নিউক্যাসলের বিপক্ষে, ১লা সেপ্টেম্বরে। পরবর্তী জয়ের জন্য দেড় মাস অপেক্ষা করে ক্লপের দল। সেটি আসে আবার সিটির বিপক্ষে। সে পর্যায়ে নিউক্যাসল ও সিটি মৌসুমে আর কোনো ম্যাচই হারেনি। ওদিকে সিরি আ লিডার নাপোলি, তর্কসাপেক্ষে ইউরোপীয় ফুটবলে সময়ের সবচেয়ে ইন ফর্ম, তারাও বিশ্বকাপের আগ পর্যন্ত একটি ম্যাচই হেরেছিল সব প্রতিযোগিতায়। লিভারপুলের বিপক্ষে, চ্যাম্পিয়ন্স লিগে।  

    নিউক্যাসল লিভারপুলের বিপক্ষে হারার পর টানা ১৭ ম্যাচ পার করে না হেরে। অপরাজিত থাকার এই ক্লাব রেকর্ড যাত্রাকে থামায় আবার সেই লিভারপুলই। ফেব্রুয়ারি মাসে সেইন্ট জেমস পার্কে গিয়ে এডি হাউয়ির দলকে হারিয়ে আসে নুনেজরা। এরপর আসে ইউনাইটেডের বিপক্ষে ঐতিহাসিক ৭-০। 

    এখন প্রশ্ন হচ্ছে, দল হিসেবে যদি এতটাই দুর্বল হয়ে যায় লিভারপুল, তাহলে এসব পারফরম্যান্স আসছে কোথা থেকে? একটা দুটা ম্যাচ হলে তাকে ফ্লুক বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু তলানিতে থাকা নটিংহাম ফরেস্ট ও লিডসের বিপক্ষে টানা ম্যাচ হেরে টটেনহাম হটস্পার স্টেডিয়ামে গিয়ে কীভাবে জিতে যায় তারা? কিংবা প্রশ্নটা ঘুড়িয়ে করলে, উজ্জীবিত ইউনাইটেডকে ৭-০ দিয়ে আবার বোর্নমাউথের মাঠে কীভাবে পা হড়কায় তারা?  

    বোর্নমাউথ ম্যাচের পর দলের ইচ্ছাশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ড। বলেছেন, জেতার ইচ্ছা প্রতিপক্ষেরই বেশি ছিল। গত সপ্তাহে ইউনাইটেডের বিপক্ষে জেতার পর আর্নল্ডই বলেছিলেন, ‘এই ম্যাচটা আমরা যেকোনো মূল্যে জিততে চেয়েছি। সবসময়ই চাই’।

    এখানে দুইয়ে দুইয়ে চার মেলালেই একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়। খেলার মোটিভেশন নিয়েও ধারাবাহিক না লিভারপুল। নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো মেনে নিয়েই বড় ম্যাচগুলোকে ঘিরে বিস্তারিত পরিকল্পনা করে নেমেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। সেসব ম্যাচে খেলোয়াড়রাও খেলেছেন সর্বোচ্চটা দিয়ে। কিন্তু ছোট দলের বেলায় লিভারপুলকে প্রায়ই দেখা গেছে ম্যাচের শুরুতেই গোল খেয়ে গিয়ে মেজাজ হারিয়ে ফেলতে। প্রথমে গোল খাওয়ার পর লিগে মাত্র দুটি ম্যাচে জয় নিয়ে ফিরতে সক্ষম হয়েছে তারা (নিউক্যাসল ও লেস্টারের বিপক্ষে)। ব্রেন্টফোর্ড, লিডস, ব্রাইটন, উলভস, বোর্নমাউথ- এদের সবার বিপক্ষেই প্রথমে গোল খেয়ে নেতিয়ে যেতে দেখা যায় ভ্যান ডাইকদের। যে কারণে এই ম্যাচগুলো থেকে এক পয়েন্টও আদায় করতে পারেনি তারা। 

    আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হচ্ছে লিভারপুলের হোম ও অ্যাওয়ে ফর্মের পার্থক্য। বোর্নমাউথের বিপক্ষে যেই সাদা জার্সি পরে নেমেছিল নুনেজরা, সেই অ্যাওয়ে জার্সি গায়ে পুরো মৌসুমে কোনো ম্যাচ জেতেনি তারা। লিগে ১৩টি অ্যাওয়ে ম্যাচের মধ্যে লিভারপুল জয় পেয়েছে মাত্র তিনটিতে। হেরেছে অর্ধেকের বেশি ম্যাচ (৭)। অপরদিকে অ্যানফিল্ডে মাত্র একবার হেরেছে তারা (সেটিও লিডসের ক্রিসেন্সিও সামারভিলের শেষ মুহূর্তের এক ওয়ান্ডার গোলে)। 

    ইউনাইটেডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে ফুটবল বিশ্লেষক গ্রায়েম সুনেস বলেছিলেন, “অ্যানফিল্ডের দর্শকেরা তাদের এই ম্যাচে হারতে দিবে না।” এবং হয়েছেও তাই। কঠিন এই মৌসুমেও হোম অ্যাডভান্টেজ ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছে ক্লপের দল। তবে শীর্ষ চারে থাকতে হলে এখন অ্যাওয়ে ফর্ম নিয়ে কাজ করতেই হবে ক্লপকে। অ্যাওয়ে ফর্মের হিসেবে লিভারপুলের অবস্থান টেবিলের ১১তম স্থানে- ফুলহাম, অ্যাস্টন ভিলা ও ব্রেন্টফোর্ডের পিছনে।      

    লিগে অলরেডদের পরবর্তী দুই ম্যাচ হচ্ছে ম্যান সিটি ও চেলসির মাঠে। আর তৃতীয় ম্যাচে লিগ লিডার আর্সেনালকে আথিতেয়তা দিবে লিভারপুল। মৌসুমে লিভারপুলের শেষ রক্ষা হবে কি না, এই তিনটি ম্যাচই হয়তো তা নির্ধারণ করে দেবে।