• আইপিএল ২০২৩
  • " />

     

    ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার : কী, কেন, কীভাবে?

    ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার : কী, কেন, কীভাবে?    

    ক্রিকেটেও এবার বদলি খেলোয়াড়ের আগমন ঘটে গেল। এর আগেও যদিও বদলি খেলোয়াড় ছিল, সেসব মাথায় আঘাতজনিত কারণে ‘কনকাশন সাবস্টিটিউট’, বদলি ফিল্ডার, এসবই। এবারের আইপিএলে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের নামে যে বদলি খেলোয়াড়ের নিয়ম চালু হয়েছে, সেটি কীভাবে কাজ করে, পূর্বের ইতিহাস, জেনে নেওয়া যাক আদ্যোপান্তই…

    কীভাবে কী?

    টসের সময় যে একাদশ বিনিময় করেন দুই অধিনায়ক, এতে এখন অতিরিক্ত পাঁচজন খেলোয়াড়ের নামও দিবেন, যাদের মধ্য থেকে একজনকে নামাতে পারবেন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে।

    কখন নামানো যাবে?

    ওভারের ধরাবাঁধা নেই আসলে, যেকোন সময়ই। ইনিংসের শুরুতে, ওভার শেষে, উইকেট পড়লে, ব্যাটার রিটায়ার করলে। যদিও ওভারের মাঝখানে উইকেট পড়লে বা রিটায়ার করলে কোনও বোলারকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে নামালে তিনি ওই ওভারে বোলিং করতে পারবেন না, তবে পরের ওভার থেকেই পারবেন।

    সবকিছু করতে পারবে?

    হ্যাঁ, একজন ব্যাটার তার ব্যাটিং করে ফেলেছেন, তার জায়গায়ও বদলি খেলোয়াড় নামানো যাবে। আবার কোন বোলার তার পুরো কোটার চার ওভারই করে ফেলেছেন, সেই বোলারের জায়গায়ও কাউকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে নামানো যেতে পারে এবং ওই ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারও সম্ভব হলে পুরো কোটার চার ওভারই করতে পারবেন।

    যাকে তুলে নেওয়া হলো, তার কী হবে?

    যার জায়গায় ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারকে মাঠে নামানো হবে, ওই খেলোয়াড় ম্যাচে আর কোন ভূমিকাই রাখতে পারবেন না। এমনকি বদলি ফিল্ডার হিসেবেও নামার সুযোগ থাকবে না।

    দেশি-বিদেশি সকলের ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যাবে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার?

    হ্যাঁ। কিন্ত একটা শর্ত আছে, বিদেশি কোন ক্রিকেটারকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে নামাতে চাইলে শুরুর একাদশে চারজন বিদেশি থাকতে পারবেন না, চারজনের কম বিদেশি থাকলেই কেবল সম্ভব। ধরুন, চারজন বিদেশি একাদশে আছেন, তার মধ্যে একজনের জায়গায় আরেকজন নামানো হলো, তাহলে তো ম্যাচে অংশ নেওয়া বিদেশি সংখ্যা হয়ে যায় পাঁচ। আইপিএল কতৃপক্ষ সবসময়ই চেয়ে এসেছে, ম্যাচে যেন বিদেশি চারজনই থাকেন, যাতে দেশিদের সুযোগ কমে না যায়। সেজন্য একাদশে চারজনের কমসংখ্যক বিদেশি রেখেই তবে বিদেশি অন্য কাউকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে নামানো যাবে। 

    ১১ জনই ব্যাটিং করবেন তো?

    ব্যাটিং করে ফেলা একজনের জায়গায় আরেকজনকে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার হিসেবে নামালেন, তিনি ব্যাটিং করতে পারবেন, কিন্ত সবশেষে ওই দলে ১১ জনের বেশি ব্যাটিং করতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে কাউকে না কাউকে ব্যাটিং থেকে বাদ দিতেই হবে।

    এর আগে এমন কিছু ছিল?

    ছিল, তবে ভিন্ন রুপে। ২০০৫ সালে সুপার-সাব নামে বদলি খেলোয়াড় ব্যবহারের একটা নিয়ম ছিল। যেটি এক বছরের বেশি সময়ও টিকতে পারেনি। এর পেছনে দায়ী ওই সুপার-সাবের নিয়ম। যেখানে একজন সুপার-সাব নামানোর নিয়ম ছিল, এবং টসের আগেই সেই সুপার-সাব কে হবেন, তা উল্লেখ করে দিতে হতো। এতে কী হতো, টসে জেতা দলগুলো সুবিধা পেয়ে যেত। কীভাবে?

    ধরুন, আপনি একজন ব্যাটার সুপার-সাব হিসেবে নিলেন। এখন আপনি চাইবেন তাকে কোনও বোলারের জায়গায় নামাতে, যার বোলিংয়ের সার্ভিস আপনার পাওয়া শেষ। কিন্ত সেজন্য তো আগে বোলিং করে ফেলতে হবে, তাহলে ওই বোলারের বোলিং শেষে ব্যাটিংয়ের সময় নামিয়ে ফেললেন সুপার-সাবের ওই ব্যাটারকে। তার মানে টস জিতে আপনি চাইবেন বোলিং করতে, এখন টস হেরে গেলেন, সুপার-সাবের কী করবেন তাহলে?

    আবার ধরেন সুপার-সাব হিসেবে বোলার নিলেন, যেকোনে একজনের ব্যাটিং শেষে তার জায়গায় ওই বোলারকে নামাবেন। সেজন্য তো দরকার আগে ব্যাটিং, যাতে ওই ব্যাটারের ব্যাটিংয়ের অবদান পেয়ে যান। টসে হেরে পেয়ে গেলেন বোলিং, কী করা যায়? অনেক সময়ই আসলে এভাবে অব্যবহৃত থেকে যেত টসে হারা দলের সুপার-সাব। এখন বলতে পারেন, সুপার-সাব হিসেবে অলরাউন্ডার কেন নিচ্ছেন না? ব্যাটে-বলে সমান পারদর্শী অলরাউন্ডার কিন্ত খুঁজে পাওয়া মুশকিল, আর এমন কেউ থাকলে তো সে আপনার একাদশেই থাকবে। তো একটা বিভাগে একটু দুর্বল, আরেকটা বিভাগে তুলনায় শক্তিশালী, এমন অলরাউন্ডারকে সুপার-সাব হিসেবে রাখলেও তো আছে টসের গুরুত্ব। আপনি চাইবেন তার শক্তিশালী অংশই কাজে লাগাতে, কিন্ত টস হেরে গেলে? 

    সমস্যা বেঁধে গিয়েছিল এই টসের আগে সুপার-সাবের নাম দেওয়া নিয়ে। টসের পরে হলে তো সেই অনুযায়ী সুপার-সাব নিতে পারার সুযোগ ছিল। এই টসের অত্যাধিক প্রভাব এবং টসের আগে বদলি খেলোয়াড়ের নাম দিতে হবে- এই কারণে এ নিয়মের সমালোচনা আসতে থাকে চারদিক থেকে। রিকি পন্টিং, গ্রায়েম স্মিথ, প্রয়াত কোচ বব উলমার, সুপার-সাবের পক্ষে ছিলেন না কেউই। অনেকে বলছিলেন, খেলা হয়ে যাচ্ছিল ১১ জন বনাম ১২ জনের। টসে হারা দলের সুপার-সাব যে অনেক সময় অব্যবহৃতই থেকে যেত!

    এই নিয়মটাও তাই আর থাকেনি। সুপার-সাব চালুর এক বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তা বন্ধ করে দেয় আইসিসি। যদিও এই সুপার-সাব ছিল শুধুই ওয়ানডেতে!

    এমন আর কোন কিছু?

    ২০২০-২১ মৌসুমে, বিগ ব্যাশের দশম আসরে চালু হয়েছিল বদলি খেলোয়াড় ব্যবহারের একটা নিয়ম, যেটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘এক্স-ফ্যাক্টর’। সেটির নিয়মে অবশ্য বেশ কিছু পরিবর্তন ছিল, ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের তুলনায়। এক্স-ফ্যাক্টরে বড় পার্থক্য ছিল, যে খেলোয়াড় ব্যাটিং করে ফেলেছেন, তার জায়গায় বদলি নামাতে পারবেন না। যে এক ওভারের বেশি বোলিং করে ফেলেছে, তার জায়গায়ও না। ব্যাটিং করেননি, এক ওভারের বেশি বল করেননি, এমন কারো জায়গায়ই কেবল ‘এক্স-ফ্যাক্টর’ প্লেয়ার নামাতে পারবেন। আরেকটাও শর্ত ছিল, ম্যাচের বয়স ১০ ওভারের বেশি হওয়ার পরে এক্স-ফ্যাক্টর বদলি নামানো যাবে। অর্থাৎ, প্রথম ইনিংসের ১০ ওভার শেষ হওয়ার আগে বদলি খেলোয়াড় নামানো যাবে না।

    এই নিয়মটাও খুব একটা সাড়া জাগাতে পারেনি। শেষপর্যন্ত সেটিও অস্তিত্ব হারায়, ২০২২-২০২৩ মৌসুমের বিগ ব্যাশের ১২তম আসরের আগেই তা বন্ধ হয়ে যায়।

    এমন পরিকল্পনা আইপিএলে এলো কীভাবে?

    আইপিএল বলেছে, এই ফরম্যাটে কৌশলগত ব্যাপার-স্যাপার বাড়াতেই এই নিয়ম এনেছে। এর জন্য তারা পরীক্ষা করেছে তাদের ঘরোয়া ক্রিকেটে। ভারতের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট, সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে ২০২২ সালেই ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ চালু করেছিল বিসিসিআই। সেখানের সাথে এখনকার আইপিএলের ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের বড় পরিবর্তন, সৈয়দ মুশতাক আলীতে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নামাতে হতো দুই ইনিংসেরই ১৪তম ওভার শেষ হওয়ার আগেই। যার মানে প্রথম ইনিংস, কিংবা দ্বিতীয় ইনিংস, ১৪ ওভার শেষ হয়ে গেলে আর ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নামানো যাবে না। সৈয়দ মুশতাক আলী ট্রফিতে খুব বেশি ব্যবহারও হতে দেখা যায় এটি। স্পোর্টস্টারের তথ্যমতে, ওই মৌসুমেই ২৬২ জন ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার ব্যবহার করেছিল দলগুলো। গণমাধ্যমের বরাতে ওই সময়ই আসলে জানা গিয়েছিল, আইপিএলেও এমন কিছু আনার পরিকল্পনা বিসিসিআইয়ের। এরপর দলগুলো ও কোচদের মতামত নেয় তারা। বড় পরিবর্তন যেটা এনেছে, সেটি ওভারের সীমা না রাখা। ১৪ ওভারের ভিতরে করতে হবে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার, সে নিয়ম বাদ দেওয়ায় মহেন্দ্র সিং ধোনি বলেছেন ব্যাপারটা আরও সহজ হয়ে উঠেছে। 

    কেন এই নিয়ম?

    আইপিএল তো বলেছেই, ট্যাকটিকাল বিষয়াদির মাত্রা আরও বাড়াতে। এর বাইরেও বড় একটা কারণ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করাও। রাতের খেলাগুলোতে শিশিরের কারণে পরে ব্যাট করা দলগুলো বাড়তি সুবিধা পেয়ে যায়। সেজন্য টস হেরে গেলে কিছুটা ব্যাকফুটে চলে যায় দলগুলো, ওই টসে হারা দল ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার ব্যবহার করে তা মোকাবিলা করতে পারার সুযোগ পাবে। আবার অনেক সময়, সময়ের সাথে পিচের চরিত্রও তো পাল্টে যায়, পূর্বানুমানের সাথে মিলে না, তখন দলগুলো ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার এনে দলে পরিবর্তন আনতে পারবে। কোন প্লেয়ার হুট করে ইনজুরিতে পড়ে গিয়ে ব্যাট করতে না পারলেও তো বিপদ। আইপিএলের প্রথম ম্যাচেই যেমন দেখা গিয়েছিল, প্রথমে ফিল্ডিং করার সময়ে উইলিয়ামসন হাটুতে ইনজুরি পান, এরপর দ্বিতীয় ইনিংসে তার জায়গায় গুজরাট নামাতে পারে এক ব্যাটারকে, ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের সুবাদে সাই সুদর্শনকে নামায় তারা।

    টসের পরে দল দেওয়া…

    ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার চালুর কথা আইপিএল দলগুলোকে নিলামের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। এবারের আইপিএল শুরুর কয়েকদিন আগেই নতুন নিয়মের কথা জানায়, টসের পরে দিতে পারবে দল। ঠিক টসের পরে বলতে এটা বুঝাচ্ছে না যে, টসের সময়ে এক দল দিয়ে পরে তাতে পরিবর্তন আনতে পারবে। আসলে অধিনায়ক টসের সময়ে দুটি তালিকা নিয়ে যাবেন, ব্যাটিং প্রথমের জন্য সেখানে থাকবে একটি একাদশ এবং প্রথমে ফিল্ডিংয়ের জন্য আরেকটি একাদশ রাখার সুযোগ থাকবে। এবং অবশ্যই সেসব টিমশিটে উল্লেখ থাকবে পাঁচ ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারেরও নাম। টসের ফলাফলে যে সিদ্ধান্ত পাবেন, সে অনুযায়ী একাদশ বিনিময় করবেন দুই অধিনায়ক। প্রথমে ব্যাটিং হলে একরকম দল নামানোর সুযোগ থাকছে, পরে হলে অন্যরকম। ইমপ্যাক্ট প্লেয়ারের পাশাপাশি এই নিয়মের আসাতে দলগুলো আরও সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। আগে ব্যাটিং করলে সে অনুযায়ী টিম ধরুন দিল ব্যাটিং-হেভি, পরে সেখান থেকে ব্যাটিং করে ফেলা একজনের জায়গায় নামিয়ে দিল বোলার একজন।

    ভবিষ্যত কী?

    এককথায় বলতে গেলে, সময়ের হাতেই ছেড়ে দিন না! তবে ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ম ক্রিকেটার, কোচ, দর্শক- সকলে সানন্দেই গ্রহণ করছে। ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ও ধারাভাষ্যকার, সঞ্জয় মাঞ্জরেকার তো ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার নিয়ে বলে দিয়েছেন, গেম-চেঞ্জার! অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার ও কোচ টম মুডি অবশ্য এখনই এর ভবিষ্যত নিয়ে কিছু বলতে চান না।