রিংকু সিং : দুই কামরার বাড়ি থেকে পাঁচ ছক্কার নায়ক
নায়ক হতে পারতেন বিজয় শংকর। উইনিং হিরো হতে পারতেন রান তাড়ায় নেমে গুজরাট টাইটান্সের বোলারদের ওপর চড়াও হওয়া ভেঙ্কটেশ আইয়ার। কিংবা দারুণ এক হ্যাটট্রিক করে কলকাতা নাইট রাইডার্সের কাছ থেকে জয় ছিনিয়ে নিতে চাওয়া গুজরাটের বদলি অধিনায়ক রশিদ খানও। কিন্তু সবাইকে পার্শ্ব চরিত্র বানিয়ে শেষ ওভারের পাগলাটে ব্যাটিংয়ে টানা পাঁচ ছক্কায় কলকাতার জয়ের নায়ক রিংকু সিং। আইপিএল তো বটেই, স্বীকৃত ক্রিকেটে এমন অবিশ্বাস্য ব্যাটিং দেখেননি আপনি নিশ্চিত।
শেষ বলে ছক্কা মেরে ম্যাচ জেতানোর নজির আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তো আছেই, আইপিএলেও আছে ঢের। আইপিএলের গত আসরেই রাহুল তেওয়াটিয়া টানা দুই ছক্কা মেরে গুজরাটকে ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে বেন স্টোকসকে টানা চার ছক্কা মেরে শিরোপা জিতিয়ে কার্লোস ব্রাথওয়েট হয়ে গেছেন ক্রিকেটের পৌরাণিক গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র। যুবরাজ সিংয়ের ছয় বলে ছয় ছক্কার মাহাত্ম্য আজও অমলিন। কিন্তু রিংক সিংয়ের সেই বীরত্ব একটু বেশিই স্পেশাল।
দুইশোর বেশি রান তাড়ায় শেষ ওভারে জয়ের জন্য কলকাতার লাগত ২৯ রান। উমেশ যাদব প্রথম বলে সিংগেল নিয়ে স্ট্রাইক দিলেন রিংকুর হাতে। ইয়াশ দয়ালের টানা তিন ফুলটসে ওয়াইডিশ লং অফ, ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগের পর আবারও ওয়াইডিশ লং অফ দিয়ে তিন ছক্কা মেরেছেন বাঁহাতি রিংকু। শেষ দুটা ছয় রীতিমতো অবিশ্বাস্য ঢংয়ে মেরেছেন। ব্যাকফুটে দাঁড়িয়ে নির্বিকার মুখভঙ্গিতে ক্রস ব্যাটেড দুটো ফ্ল্যাট শটে লং অনের সীমানা পার।
বয়সভিত্তিক দলের নিজের বন্ধু ইয়াশ দয়ালের ওপর তাণ্ডব বইয়ে রিংকু ছুটেছেন ডাগ আউটের দিকে। অধিনায়ক নিতিশ রানা ছুঁটে এসে জড়িয়ে ধরেছেন তাকে, অবিশ্বাসের দৃষ্টি চোখে। সবাই অবিশ্বাস করলেও রিংকু নিজের ওপর বিশ্বাস রেখেছিলেন। ম্যাচ প্রেজেন্টেশনে বলেছেন, ‘আগের বছরও এমন পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম, লক্ষ্ণৌর বিপক্ষে সেদিন না পারলেও বিশ্বাস ঠিকই ছিল নিজের ওপর।’
এমন দুর্দান্ত, নখ কামড়ানো উত্তেজনার ম্যাচ জেতানোর পর রিংকু ভোলেননি নিজের পারিবারিক ইতিহাস। অকপটে মাইক্রোফোনের সামনে বলেছেন, ‘আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। আজ যে কয়টা ছক্কা মাঠের বাইরে গেছে, যে কয়টা শটে ম্যাচ জিতিয়েছি; আমি উৎসর্গ করলাম আমার কৃষক পরিবারের জন্য। যাদের পরিশ্রম-সাহসে আমি আজ এখানে।’
অভাব-অনটনের লম্বা একটা পথ পাড়ি দিয়েছেন রিংকু, সাথে ছিল তার পরিবার। উত্তর প্রদেশের আলীগড়েই দুই কামরার এক বাড়িতে তার বেড়ে ওঠা বাকি দুই ভাইবোনের সাথে। বাবা খানচন্দ্র সিং এলপিজি সিলিন্ডার ডেলিভারি করতেন বাইসাইকেলে করে বাড়ি বাড়ি গিয়ে। সেটা দিয়ে যা আসত, পাঁচজনের সংসার চালাতে কষ্টই হতো তার। স্টেট ক্রিকেটের বিভিন্ন টুর্নামেন্টে খেলে রিংকু যা পয়সা পেতেন সেটা দিয়ে দিতেন পরিবারের ভরণপোষণে। স্থানীয় এক টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হয়ে মোটর সাইকেল জিতেছিলেন পুরস্কার হিসেবে। সেটা নিজের বাবাকে দিয়েছিলেন ডেলিভারির কাজে ব্যবহারের জন্য।
ক্রিকেটটাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। কিন্তু অল্পবিস্তর যা উপার্জন করতেন সেটা দিয়ে চাহিদা মিটছিল না। এর ওপর পরিবারের মাথায় ছিল বড়সড় ঋণের বোঝা। সেই দেনার দায়ে ক্রিকেটটাও বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল তার। দুটো পয়সা বেশি উপার্জনের আশায় বড় ভাইয়ের কথায় একদিন রিংকু গিয়েছিলেন এক কোচিং সেন্টারে ধোয়া মোছার চাকরি করতে। ধাতে সইল না তার। ক্রিকেটের ব্যাটের জায়গায় তার হাতে ধোয়া মোছার সরঞ্জাম থাকবে, বিধাতাও বোধহয় চাননি। তাই সেই চাকরি ছেড়ে আবার মাঠে ফিরলেন রিংকু।
২০১৭ আইপিএলে তাকে ১০ লাখ রুপি ভিত্তিমূল্যে দলে নিল তৎকালীন কিংস ইলেভেন পাঞ্জাব (বর্তমান নাম পাঞ্জাব কিংস)। সেবার ম্যাচ খেলা হয়নি একটিও। পরের মৌসুমে পাঞ্জাব তাকে ছেড়ে দিলে দলে ভেড়ায় কলকাতা। ভিত্তিমূল্য ছিল সেবার ২০ লাখ রুপি। নিলামে কলকাতার সাথে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের কাড়াকাড়িতে দাম উঠল ৮০ লাখ রূপি। আইপিএলের সেই নিলামে সুদিন ফিরল রিংকুদের। কিন্তু মাঠের ক্রিকেটে আড়ালেই রইলেন। মাঠে নামার সুযোগ যা এলো, সেটাও বেশিরভাগ বদলি ফিল্ডার হিসেবে। প্রথম তিন মৌসুমে কেকেআরের জার্সিতে খেলছেন সর্বসাকুল্যে ১০ ম্যাচ। ২০২১ সালে কনুইয়ের ইনজুরিতে মাঠের বাইরেই ছিলেন।
তবুও ছেড়ে দেয়ার পর কলকাতা তাকে আবার নিয়েছিল ২০২২ সালের নিলামে; মূল্য সেবার ৬০ লাখ রূপি। রিংকু নিজেকে চিনিয়েছেনও আইপিএলের গত আসরেই। ২৮ বলে ৩৫, ১৬ বলে ২৩, ২৩ বলে ৪২ রানের ক্যামিও গুলোতে ভরসা দিলেন টিম ম্যানেজমেন্টকে। তবে সেরা একাদশে রিংকু নিজের জায়গাটা পাকা করেছিলেন লক্ষ্ণৌর বিপক্ষে ১৫ বলে ৪০ রানের ইনিংস খেলে। দলকে ম্যাচটা প্রায় জিতিয়েই দিচ্ছিলেন। তার লফটেড শট খুঁজে নেয় এভিন লুইসের হাত। দারুণ সেই ক্যাচে কেকেআরকে ছিটকেই দিয়েছিলেন লুইস।
সেদিন কলকাতার সাথে রিংকু হেরেছিলেন। এর আগে মাস তিনেকের জন্য নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আবুধাবি টি-টোয়েন্টিতে খেলার জন্য। তবে নানান ঘাত-প্রতিঘাতের পর এই তরুণ জিতে গেছেন জীবনযুদ্ধে। ক্রিকেটকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছেন, নিজের পরিবারকে টেনে তুলেছেন অন্ধকার থেকে। পদে পদে অপেক্ষমান কঠিন বাস্তবতার বাধাগুলো যেভাবে পেরিয়েছেন, ঠিক তেমনি গতকাল অবাস্তব-অপার্থিব ব্যাটিংয়ে আরও এক পা এগিয়ে নিয়ে গেলেন কলকাতাকে। জন্ম দিলেন দুর্দান্ত এক ক্রিকেটীয় রূপকথার।
গতকাল শেষ বলটা যদি মাঝব্যাটে না লাগত, যদি ছক্কা না হতো, তখন হয়তো আরেকবার আইপিএলে ট্র্যাজিক হিরো হতেন রিংকু, আরও একটা ম্যাচ হারতো কলকাতা। কিন্তু অদৃশ্য একটা জয়ের মালা ঠিকই উঠতো রিংকুর গলায়। কারণ এরচেয়ে বড় যুদ্ধটা তো তিনি জিতে এসেছেন।