• লা লিগা
  • " />

     

    মেসির বার্সায় ফেরা: কতটা বাস্তবতা, কতটা কল্পনা?

    মেসির বার্সায় ফেরা: কতটা বাস্তবতা, কতটা কল্পনা?    

    ২০২১ সালে যখন লিওনেল মেসি ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি বার্সেলোনা ছেড়ে পিএসজিতে যাচ্ছেন, পুরো ফুটবল বিশ্ব থমকে গিয়েছিল। পিএসজিতে মেসির দুই বছরের চুক্তি শেষ হতে যাচ্ছে এই জুনে। চুক্তি নবায়ন করার সম্ভাবনা খুবই কম। সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্রের মতো অনেক দেশের ক্লাবই এখন মেসির স্বাক্ষরের জন্য ছুটছে। এই দৌড়ে সবচেয়ে সরব অবশ্য মেসির সাবেক ক্লাব বার্সা। বার্সার সভাপতি, কোচ, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে ভক্তরা, সবাই একরকম আশায় আছেন মেসির প্রত্যাবর্তনের। 

    তবে কি ২০২১ সালের মতোই সবাইকে অবাক করে দিয়ে এই গ্রীষ্মে আবার বার্সায় ফিরবেন মেসি? এরচেয়েও বড় প্রশ্ন- অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ফুটবলীয়; সবদিক মিলিয়ে মেসির প্রত্যাবর্তন কি আসলেই সম্ভব? 

     

    পিএসজিতে মেসির বর্তমান অবস্থা  

    ২০২১ সালে পিএসজির হয়ে দুই বছরের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন মেসি। তবে সেই চুক্তিতে আরও বাড়তি একবছরের কথা উল্লেখ ছিল। ক্লাব ও খেলোয়াড়, দুই পক্ষই সম্মতি দিলে আরও এক বছরের জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে নবায়ন হয়ে যাবে এই চুক্তি। তবে বর্তমানে ক্লাব সেই চুক্তি নবায়ন করার চেষ্টা চালিয়ে গেলেও মেসির পক্ষ থেকে তেমন সাড়া নেই। 

    বিশ্বকাপের আগে অবশ্য মেসি চুক্তি নবায়নের দিকেই ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে গত কয়েক মাসে বদলেছে পরিস্থিতি। বায়ার্ন মিউনিখের কাছে হেরে আরও একবার চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শেষ ষোলো থেকে বিদায় নিয়েছে ক্লাবটি। এ নিয়ে দ্বিতীয় বছরের মতো পিএসজি ভক্তদের দুয়ো শুনতে হয়েছে মেসিকে। ক্লাবের সার্বিক পরিস্থিতি ও ভক্তদের ব্যবহার মিলিয়ে মেসি-শিবির যে চুক্তি নবায়নের চিন্তা আর করছে না, সেটা এই পর্যায়ে স্পষ্ট। 

    তবে কোনো সম্ভাবনাই এখনো পর্যন্ত উড়িয়ে দেয়নি মেসি-শিবির। মেজর লিগ সকারের ক্লাব ইন্টার মায়ামিতে যোগ দেওয়ার গুঞ্জন এক বছর ধরেই চলছে। সম্প্রতি সৌদি ক্লাব আল হিলালও এসেছে বিশাল অফার নিয়ে। মেসিকে মৌসুমে ৪০০ মিলিয়ন ইউরোর বেশি বেতন দিতে প্রস্তুত তারা। সাবেক ক্লাব বার্সা, বা শৈশবের ক্লাব নিউওয়েলসে ফিরে যাওয়াটা সবসময়ই একটি সম্ভাবনা। 

     

    বার্সেলোনা মেসিকে ফেরত চায়? 

    গত মাসের শেষদিনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে বার্সার সহ-সভাপতি রাফায়েল ইয়ুস্তে স্বীকার করেছেন, মেসিকে ফিরিয়ে আনতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ক্লাব। 

    ক্লাব সভাপতি হুয়ান লাপোর্তাও পূর্বে এই ব্যাপারে ইঙ্গিত দিয়েছেন। গত মাসেই এক সাক্ষাৎকারে লাপোর্তা বলেন, “বার্সার সাথে মেসির সম্পর্ক আবার ভালো করার চেষ্টা করছি আমি। দেখা যাক কী হয়, মেসি জানে বার্সার দরজা সবসময়ই তার জন্য খোলা।” 

    মেসির সাবেক সতীর্থ ও বর্তমান বার্সা কোচ জাভিও সম্প্রতি মুখ খুলেছেন মেসির সম্ভাব্য প্রত্যাবর্তন নিয়ে। “মেসি ফিরে আসলে মাইকেল জর্ডানের মতোই লাস্ট ড্যান্স হবে একটা,” বলেন জাভি। মেসির সাবেক সতীর্থ ও বর্তমান বার্সা অধিনায়ক সার্জিও বুস্কেটসও বলেছেন, মেসি ফিরলে তাকে  স্বাগত জানাবে সতীর্থরা। 

    বুধবার ন্যু ক্যাম্পে হওয়া এল ক্লাসিকোর দশম মিনিটে বার্সা সমর্থকদেরও দেখা যায় ‘মেসি, মেসি’ চিৎকার করে কলরব তৈরি করতে। 

     

    মেসি কি ফিরে আসতে চান? 

    মেসি বা তার এজেন্ট এখনো এই ব্যাপারে এখনো প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। তবে গত মাসে বার্সেলোনার রাস্তায় দেখা যায় মেসি ও তার স্ত্রী আন্তনেলা রকুজ্জোকে, শোনা যায় সাবেক সতীর্থ সার্জিও বুস্কেটস ও জর্ডি আলবার সঙ্গে ডিনারও করেছেন তারা। অ্যাথলেটিক জানিয়েছে, বার্সায় ফেরার গুঞ্জনকে ভালোভাবেই দেখছে মেসি-শিবির। 

    মেসির সবচেয়ে কাছের বন্ধুদের একজন সার্জিও আগুয়েরো। মেসির ভবিষ্যৎ নিয়ে তার সাম্প্রতিক উক্তিও যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করেন। 

    “ফুটবলার মেসির জন্ম হয়েছে বার্সায়। তার সেখানেই অবসর নেওয়া উচিত। আমার মনে হয়, যদি লাপোর্তা চেষ্টা করে, মেসিকে ব্যক্তিগতভাবে ফোন করে, তাহলে এটা হওয়া সম্ভব। আমার মতে মেসির ফেরার সম্ভাবনা ৫০-৫০,” বলেন মেসি। 

    মেসির সাথে বার্সার (শহর ও ক্লাব, দুটোরই) সম্পর্ক নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই। ২০২১ সালে অশ্রুসিক্ত অবস্থায় বিদায় নেওয়ার সময়, এবং পরে আরও একবার বলেছেন, অবসর নেওয়ার পর বসবাস করতে আবার বার্সা শহরেই ফিরে আসবেন। 

     

    মেসির বেতন কত হতে পারে? 

    এটা একটা বড় প্রশ্ন। ২০২১ সালে ক্লাব ছাড়ার আগে বেতন ৫০ শতাংশেরও বেশি কমিয়ে এনে ছোট একটি চুক্তিতে সম্মত হয়েছিলেন মেসি। সেই চুক্তি অনুযায়ী ১০ মিলিয়ন ইউরো বেতন পেতেন এই আর্জেন্টাইন। 

    তবে এই বেতনও বার্সার দেওয়ার সামর্থ্য আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। লা লিগা প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের তেবাস জানিয়েছেন, বর্তমান ওয়েজ বিল থেকে বার্সাকে এখনো ২০০ মিলিয়ন ইউরোর মতো ছাঁটতে হবে, নতুন খেলোয়াড় কেনার আগে।  তবে মেসির ব্যাপারে কিছুটা নমনীয় তেবাস। বেতন কমিয়ে মেসির ফিরে আসা সম্ভব বলেই মনে করছেন তিনি। 

    বৈশ্বিকভাবে লা লিগার জনপ্রিয়তা যেভাবে হ্রাস পেয়েছে, প্রিমিয়ার লিগের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কথা চিন্তা করে মেসির ফেরাকে সবুজ বাতি দিতেও পারে লা লিগা। 

    বার্সার স্পোর্টিং ডিরেক্টর মাতেও আলেমনি গত ফেব্রুয়ারি মাসে জানিয়েছেন, অর্থনৈতিকভাবে সঠিক রাস্তাতেই আছে বার্সা। শুধু জেরার্ড পিকে ও আন্তোয়ান গ্রিজমানের প্রস্থানেই ওয়েজ বিল থেকে ৯০ মিলিয়ন ইউরো খারিজ করেছে তারা। মৌসুম শেষে চুক্তি শেষ হয়ে আসবে সার্জিও বুস্কেটসেরও। এই ক্লাব লেজেন্ড চুক্তি নবায়ন করলেও সেটি হবে আগের চেয়ে অনেক কম বেতনে। মেসিকে জায়গা দিতে হলে আরও কিছু খেলোয়াড় বিক্রি করতে হবে বার্সার। 

    লোনে থাকা ক্লেমেন লংলে, সামুয়েল উমতিতি ও সার্জিনো ডেস্টকে ইতোমধ্যে স্থায়ীভাবে বিক্রির চেষ্টা করছে তারা। আসছে গ্রীষ্মে ফ্রেঙ্কি ডি ইয়ং ও আনসু ফাতিকেও বিক্রির চেষ্টা করতে পারে কাতালান ক্লাবটি।  

     

    রাজনৈতিক দিক: বার্সার সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এই দলবদল কেমন প্রভাব ফেলবে? 

    রেফারি কেলেঙ্কারি নিয়ে এই মুহূর্তে বেশ ভুগছে বার্সেলোনা। স্পেনের আদালতে তাদের নামে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ইউয়েফাও ইতোমধ্যে তাদের তদন্ত শুরু করেছে, যেই তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে রেলিগেশনের মতো বড়সড় কোনো শাস্তিও পেতে পারে ক্লাবটি। 

    এদিকে অর্থনৈতিকভাবেও বার্সার অবস্থা বেশ ভঙ্গুর। কিন্তু এরপরও ন্যু ক্যাম্পের সংস্কারকাজ শুরু করতে যাচ্ছে ক্লাবটি। আগামী মৌসুমের পুরো সময় ন্যু ক্যাম্পে খেলবে না বার্সা। খেলবে শহরের এক প্রান্তে অবস্থিত এস্তাদি অলিম্পিক লুইস কম্পানিসে, যার ধারণ ক্ষমতা ৫৫ হাজার। এই স্টেডিয়াম পরিবর্তনের জন্যই ৯০ মিলিয়ন ইউরোর মতো লোকসান দেখতে পারে ক্লাবটি।  

    মেসির প্রত্যাবর্তন ভক্তদের স্টেডিয়াম-মুখী করার পাশাপাশি ক্লাবের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন এনে দিতে পারে। শুধু ক্লাব না, মেসির প্রত্যাবর্তন লা লিগার অর্থনীতিকেও আবার চাঙা করে তুলতে পারে। এবং এর দোহাইয়ে রেফারি কেলেঙ্কারির কালিমা থেকেও সময়ের জন্য রেহাই পেতে পারে ক্লাবটি। 

     

    ফুটবলীয় দিক: মাঠে মেসির প্রত্যাবর্তন বার্সাকে কীভাবে প্রভাবিত করবে? 

    ফুটবলীয় দিক থেকে মেসির এক-দুই মৌসুমের জন্য ফেরা কতটা সুফল বয়ে আনবে, তা নিয়ে তর্ক আছে। জাভির অধীনে রক্ষণে বেশ মজবুত হয়ে যাওয়া বার্সা সামনে ঠিক এতটা ছন্দে নেই। বিশ্বকাপের পর থেকে তেমন গোল পাচ্ছেন রবার্ট লেভানডফস্কি, উসমান ডেম্বেলে যথারীতি ইনজুরড। এই মুহূর্তে মেসিকে কেন্দ্র করে আক্রমণ সাজানোটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে ক্লাবের জন্য। কেননা, মেসি-লেভানডফস্কির বয়স ও ডেম্বেলের ফিটনেসের কথা চিন্তা করে এক মৌসুম পরেই আবার পুরো ফ্রন্টলাইন পরিবর্তন করতে হতে পারে তাদের, যেটির সামর্থ্য হয়তো তাদের নেই। আর মেসিকে দলে জায়গা দিতে হলে গেমটাইম কমে যেতে পারে পেদ্রি ও গাভির। ক্লাবের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার জন্য যেটি ঠিক সুসংবাদ না।