মিডফিল্ডে ট্রেন্ট: ফুটবলে অ্যাটাকিং ফুলব্যাক যুগের সমাপ্তি?
বিগত ২০ বছরে ফুটবলে অনেক ট্রেন্ড এসেছে, খেলার ধরণে অনেক পরিবর্তন এসেছে, অনেক পজিশনই নতুন রূপ ধারণ করেছে। প্রেসিং ফুটবল, সুইপার কিপার, বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার, আরও কত কিছু। কিন্তু এর মধ্যে মাঠের ফুটবলে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে হয়তো ফুলব্যাক পজিশনের বিবর্তনটাই।
ফুলব্যাকরা রক্ষণে বসে থাকবে না, আক্রমণেও উঠবে- প্রথম এই ধারা শুরু হয়েছিল ব্রাজিলে। কাফু ও রবার্তো কার্লোসের মাধ্যমে। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে ব্রাজিল দলের দুই পাশে ত্রাস সৃষ্টি করা শুরু করেছিলেন এই দুই বাঘা ফুলব্যাক। ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালির দুই ফুলব্যাক জিয়ানলুকা জামব্রোত্তা ও ফাবিও গ্রসসোও তার অনুকরণ করার চেষ্টা করেছিলেন।
জাতীয় দলগুলো এখন আর নতুন ধারা সৃষ্টি করে না। তৈরি করে না নতুন ঘরানার ফুটবলার। তবে ক্লাব ফুটবলের দিকে যদি আমরা তাকাই, গত ১৫ বছরে ইউরোপে রাজত্ব করা ক্লাবগুলোই শুধু পেয়েছে সেরা সেরা অ্যাটাকিং ফুলব্যাক।
বার্সেলোনায় ছিলেন জর্ডি আলবা ও দানি আলভেজ। মাদ্রিদে মার্সেলো ও দানি কারবাহাল। বায়ার্নে ডেভিড আলাবা ও ফিলিপ লাম। এবং লিভারপুলে অ্যান্ডি রবার্টসন ও ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ড। পেপ গার্দিওলাও এই ট্রেন্ডের অংশ হতে চেয়েছিলেন। ম্যান সিটিতে এক মৌসুম পার করার পরই, ২০১৮’র গ্রীষ্মে ফুলব্যাকদের পিছনে ১১৮ মিলিয়ন পাউন্ড খরচ করিয়েছিলেন এই কাতালান ম্যানেজার। কিন্তু এই খাতে খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। গার্দিওলার মতো আরও অনেক ম্যানেজারই চেষ্টা করেছেন অ্যাটাকিং ফুলব্যাকদের নিয়ে দল সাজাতে। ট্রেন্ট ও রবার্টসনের সাফল্যের পর প্রিমিয়ার লিগ থেকে রক্ষণাত্মক ফুলব্যাক ব্যাপারটাই যেন উঠে গিয়েছিল।
তবে এই মৌসুমে আবার বদলে গেছে ধারা। কোনো বড় দলই আর দুজন অ্যাটাকিং ফুলব্যাক খেলাচ্ছে না। লিভারপুল মৌসুমের বড় অংশ ট্রেন্ট-রবার্টসনকে আগের মতো খেলালেও, শেষদিকে এসে মত বদলেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপও। দুর্দশাগ্রস্ত এক মৌসুমের শেষ প্রান্তে এসে ট্রেন্টকে মিডফিল্ড ও রবার্টসনকে রক্ষণাত্মক ফুলব্যাক হিসেবে খেলানো শুরু করেছেন ক্লপ। এতে ফলও পাচ্ছে লিভারপুল। ট্রেন্ট মিডফিল্ডে জায়গা করে নেওয়ার পর এখনো কোনো ম্যাচ হারেনি অলরেডরা।
২০২৩ সালে এসে ফুটবলের বাস্তবতাই হয়তো এটি- দুজনকে ফুলব্যাককেই সামনে খেলিয়ে ম্যাচ জেতা সম্ভব না।
অ্যাটাকিং ফুলব্যাকের মহাপ্রয়াণ
২০১০ সাল থেকে, গত ১৩ বছরের পরিসংখ্যান যদি ঘাঁটি আমরা, এই সময়ে ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগে প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে সবচেয়ে বেশিবার বল পেয়েছেন জর্ডি আলবা (৭২৪)। এরপরই আছেন মাদ্রিদের সাবেক লেফটব্যাক মার্সেলো (৫৭৬) ও তার জাতীয় দলের সতীর্থ দানি আলভেজ (৫৫১)। চারে আছেন রবার্টসন (৪৮১), পাঁচে কারবাহাল (৪৭৬)। ক্রসে পারদর্শী ট্রেন্ট এই তালিকায় কিছুটা নিচে (৩২৩), কিন্তু এই সময়ে ৩০০-র বেশি পেনাল্টি এরিয়া টাচ আছে শুধু তিনটি দলেরই- রিয়াল, বার্সা ও লিভারপুল।
আমরা যদি অ্যাসিস্টের পরিসংখ্যান দেখি, ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়ে উঠবে। ২০১০ সাল থেকে মাত্র সাতজন ফুলব্যাক ৩০টির বেশি অ্যাসিস্ট পেয়েছেন। আলবা (৬২), আলভেজ (৫২), মার্সেলো (৪৬), রবার্টসন (৪৪), ট্রেন্ট, কারবাহাল ও ডর্টমুন্ডের পিসচেক (৩৫)।
কিন্তু এই মৌসুমে শুধু লিভারপুল ও ডর্টমুন্ডের ফুলব্যাকরা প্রতিপক্ষ পেনাল্টি বক্সে ৩০টির বেশি টাচ পেয়েছেন। তাহলে হয়েছেটা কী? বড় ক্লাবগুলো আর ফুলব্যাকদের আক্রমণে পাঠাচ্ছে না কেন?
মূল কারণটা খুবই সহজ- উপযুক্ত খেলোয়াড়ের অভাব। বিশ্ব ফুটবলে খুব খেলোয়াড়ই আছেন যারা একসাথে অ্যাটাক ও ডিফেন্ড করতে পারেন, উইঙ্গারদের মতো আক্রমণ ও ডিফেন্ডারদের মতো রক্ষণ সামলাতে পারেন। পুরো ৯০ মিনিট উপরে-নিচে উঠা-নামা করতেও প্রয়োজন অস্বাভাবিক ওয়ার্করেট।
লিভারপুলের জন্য ব্যাপারটা ভাগ্যগুণেই মিলে গিয়েছিল। তাদের একজন ফুলব্যাক উঠে এসেছে ক্লাবের ইয়ুথ সিস্টেম থেকে, আরেকজনকে তারা এনেছিল রেলিগেটেড হাল সিটি থেকে। বার্সার আলবা ও আলভেজ দুজনই বেশ প্রতিভাবান ও অনন্য মাত্রার ফুটবলার। বায়ার্নের আলবা ও লাম ছিলেন দলের সবচেয়ে বুদ্ধিমান খেলোয়াড়। মাদ্রিদের মার্সেলো শুধু তার সময়ের না, ফুটবল ইতিহাসেরই শ্রেষ্ঠ লেফটব্যাকদের একজন। কারবাহালও তার সময়ে ছিলেন একজন ওয়ার্ক-হর্স।
এরকম খেলোয়াড় খুঁজে পাওয়াটা কঠিন। যে কয়জন আছেন, তাদের দাম আকাশছোঁয়া। খুব কম দলেরই সামর্থ্য আছে তাদের দলে ভেড়ানোর। পিএসজি ও সিটি অবশ্য প্রচুর অর্থও ব্যয় করেছে অ্যাটাকিং ফুলব্যাকদের পিছনে। কিন্তু কারণে-অকারণে এই দুই দলের কোনোটিই সেরকম কম্বিনেশন খুঁজে পায়নি।
ফুলব্যাকদের বর্তমান ট্রেন্ড
ফুলব্যাকরা আর আগের মতো উপরে উঠছে না। তাহলে তাদেরকে এখন কীভাবে ব্যবহার করছেন ম্যানেজাররা?
চার ডিফেন্ডারের দলগুলো এখন দুটি কাজ করে। হয় একজন ফুলব্যাককে নিচে রেখে আরেকজনকে উপরে তুলে। সেক্ষেত্রে নিচে থাকা ফুলব্যাক মূলত তৃতীয় সেন্টারব্যাক হিসেবে কাজ করে। অথবা একজনকে নিচে রেখে আরেকজনকে মিডফিল্ডে নিয়ে আসে, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের পাশে।
‘একজন অ্যাটাকিং, একজন ডিফেন্সিভ’ ঘরানার ফুলব্যাক কম্বিনেশনের সবচেয়ে যুতসই উদাহরণ কিরেন ট্রিপিয়ার ও ড্যান বার্ন। নিউক্যাসলের মতো বার্সার ফুলব্যাকরাও একই ঘরানার। বার্সার রাইটব্যাক হিসেবে খেলা রোনাল্ড আরাউহো ও জুলস কুন্ডে দুজনই জাতে সেন্টারব্যাক। বায়ার্নে এখন আলফন্সো ডেভিস ও জোয়াও ক্যান্সেলো দুজন অ্যাটাকিং ফুলব্যাক থাকলেও এই দুজনকে কখনোই একসাথে নামতে দেখা যায় না।
দ্বিতীয় ধরনের উদাহরণ ম্যান সিটি ও লিভারপুল। পূর্বে দুই দলই দুজন অ্যাটাকিং ফুলব্যাক খেলিয়েছে। কিন্তু দুজন ফুলব্যাকই প্রতিপক্ষ অর্ধে থাকার সমস্যা হচ্ছে, সামনে বল হারালে কাউন্টার-অ্যাটাকে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। দুই অ্যাটাকিং ফুলব্যাকের দলগুলো এই সমস্যা সমাধানে সাধারণত আক্রমণের সময় তাদের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডকে নিচে নামিয়ে আনত, দুই সেন্টারব্যাকের মাঝখানে। যাতে করে তিনজন খেলোয়াড় সবসময়ই বলের পিছনে থাকত। এই ট্যাকটিসের সমস্যা হচ্ছে, সিডিএম নিচে চলে আসলে মিডফিল্ডে জনসংখ্যা কমে যায় দলের, মিডফিল্ডের বলের লড়াইয়ে হারার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
পেপ গার্দিওলা ও ইয়ুর্গেন ক্লপ এই সমস্যা সমাধানে নতুন এক ট্যাকটিস হাতে নিয়েছেন। তারা একজন ফুলব্যাককে মিডফিল্ডে নিয়ে আসেন, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের পাশে। লিভারপুলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ট্রেন্ট রাইটব্যাক পজিশন থেকে মিডফিল্ডে উঠে এসে ফ্যাবিনহোর সঙ্গে একটি ডাবল-পিভট তৈরি করেন। আর রবার্টসন ভ্যান ডাইক ও কোনাতেকে নিয়ে তিনজনের রক্ষণ দেয়াল তৈরি করেন।
এই ট্যাকটিকাল লাইনাপ লিভারপুলের জন্য জাদুর মতো কাজ করেছে। আগে প্রতিপক্ষের কাউন্টার অ্যাটাকের সময় লিভারপুলের রক্ষণে থাকতেন শুধু তিনজন (দুই সিবি ও ফ্যাবিনহো)। এখন তিন ডিফেন্ডারের পাশাপাশি থাকেন ট্রেন্ট-ফ্যাবিনহোও। আর ট্রেন্ট মিডফিল্ডে আসায় মধ্যমাঠেও মুশকিল আসান হয়েছে অলরেডদের। তর্কাতীতভাবে লিভারপুলের সবচেয়ে সৃজনশীল ফুটবলার ট্রেন্ট। অথচ মধ্যমাঠে সৃজনশীলতার অভাবে পুরো মৌসুম ভুগেছে তারা। এখন ট্রেন্ট মিডফিল্ড এসে বল ডিস্ট্রিবিউশনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিয়েছেন। তার পাসিং সক্ষমতা ও মাঠের যেকোনো জায়গায় চলাফেরা করার স্বাধীনতা দলের আক্রমণকে অনেক সচল করে তুলেছে।
রাইটব্যাক হিসেবে পুরো মৌসুমে মাত্র দুটি অ্যাসিস্টের দেখা পেয়েছিলেন ট্রেন্ট। আর্সেনালের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে মিডফিল্ডে চলে আসার পর প্রথম পাঁচ ম্যাচেই তিনি পেয়েছেন ছয় অ্যাসিস্ট।
সিটির ট্যাকটিস কিছুটা আলাদা। ফুলব্যাকদের উপর ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে এই ট্যাকটিস শুরু করেছিলেন পেপ গার্দিওলাই। মৌসুমের মাঝখানে ক্যান্সেলোকে ছেড়ে দিয়ে ফুলব্যাক খেলানোই বন্ধ করে দেন তিনি। নতুন ফরমেশনে চার ডিফেন্ডারের একজন (জন স্টোনস) চলে আসেন মিডফিল্ডে, রদ্রির পাশে। আর নিচে থাকা তিন ডিফেন্ডারের ক্ষেত্রেও সেন্টারব্যাকদেরই বেশি প্রাধান্য দেন গার্দিওলা। যে কারণে নাথান আকে, রুবেন ডিয়াজ ও ম্যানুয়েল আকানজিকে সাধারণত দেখা যায় রক্ষণ ত্রয়ী হিসেবে।
এই ফরমেশনে মিডফিল্ডও নেয় একটি হাইব্রিড রূপ, যাকে বলা হয় ‘বক্স মিডফিল্ড’। রদ্রি ও স্টোনস থাকেন ডিফেন্সিভ পিভট হিসেবে, আর তাদের সামনে থাকেন গুন্ডোগান ও ডি ব্রুইনা। লিভারপুলের ক্ষেত্রে ট্রেন্ট ও ফ্যাবিনহোর সামনে থাকেন কার্টিস জোন্স ও হেন্ডারসন। সিটির মতো লিভারপুলের দুই নাম্বার টেন আসলে ঠিক যুতসই না। তবে ইয়ুর্গেন ক্লপ পরিকল্পনা করছেন অ্যালেক্সিস ম্যাক অ্যালিস্টার ও ম্যাসন মাউন্টকে দলে ভেড়াতে। কোন পজিশনের জন্য, সেটা বুঝতেই পারছেন।
আর্সেনাল এই দুই ঘরানারা কোনোটাতেই পড়ে না। তাদের ট্যাকটিসকে দুই ঘরানার সমন্বয় বলা চলে। দুই ফুলব্যাকের কেউই ঠিক সাইডলাইন ধরে খেলেন না, উইঙ্গারদেরও ওভারল্যাপ করেন না। কিন্তু তাদেরকে ডিফেন্সিভ ফুলব্যাক বলা যাবে না। রাইটব্যাক বেন হোয়াইট জাতে সেন্টারব্যাক হলেও ঠিক নিচে বসে থাকেন না। এবার দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রোগ্রেসিভ পাস এসেছে তার পা থেকে। জিনচেঙ্কো আক্রমণ-মনস্ক। তার সিংহভাগ টাচ আসে প্রতিপক্ষের অর্ধে। কিন্তু তিনিও কখনো প্রতিপক্ষের বক্সে প্রবেশ করেন না। দুই ফুলব্যাক বেশি উপরে না উঠায় কাউন্টারে ধরা খাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে আর্সেনালের।
মাদ্রিদের ফুলব্যাক সিস্টেমও এই দুই ঘরানার মধ্যে পড়ে না। মৌসুমজুড়ে তারা চার-পাঁচজনকে খেলিয়েছে ফুলব্যাক পজিশনে। কিন্তু কারবাহাল, ভাস্কেজ, আলাবা, মেন্ডি, কামাভিঙ্গাদের কেউই দুটির বেশি অ্যাসিস্ট পাননি লিগে।