• আইপিএল ২০২৩
  • " />

     

    শরণার্থী নাভিনের জেদ এবং আফগান পেস বিপ্লব

    শরণার্থী নাভিনের জেদ এবং আফগান পেস বিপ্লব    

    বাউন্ডারিতে ফিল্ডিংয়ে যান নাভিন, গ্যালারি থেকে ভেসে আসে ‘কোহলি, কোহলি’ চিৎকার। কোহলির সাথে বাকবিতন্ডায় জড়িয়েছিলেন মাঠে। সেই আগুনে ঘি ঢেলেছে পরে কোহলি আর নাভিনের ইনস্টাগ্রাম পোষ্ট। নাভিনের দল হারে, কোহলি খোঁচা দিয়ে দেন পোষ্ট। কোহলির দল হারলে নাভিন। কোহলির বিশাল ভক্তকূলের চোখে তাই নাভিন বনে গেছেন ভিলেন। কোহলি বনাম নাভিন। ব্যাপারটা যেন এ পর্যায়েই চলে গেছে। আর সেসবে ঢেকে গেছে বোলার নাভিনের সাফল্য। 

    নূর আহমেদের আবির্ভাব ক্রিকেটবিশ্বকে আবার চমকেই দিয়েছে। আফগানিস্তান থেকে একের পর এক লেগি উঠে আসছে। হার্শা ভোগলে একদিন জানতে চাইলেন রশিদ খানের কাছে, আর কত লেগি লুকিয়ে আছে আফগানিস্তানে? রশিদ জানালেন, হাজারখানেকের বেশি তো হবেই! স্পিনের বলেই ক্রিকেটবিশ্বে আফগানিস্তানের পরিচিতি। 

    পেসার হলে বড় বড় লিগে সুযোগ পাবে না, স্পিনার হলে সব লিগে খেলতে পারবে, এমন একটা ধারণা নাকি আছে আফগানিস্তানে। নাভিন বলেছিলেন সে ‘মিথ’ তিনি ভাঙ্গতে চান। বিশ্বের সব লিগ খেলে সবার বড় আইপিএলেও পা রেখেছেন। ৮ ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট। ইকোনমি ৭.৮২, গড় বিশের কম। আইপিএলের প্রথম মৌসুমেই এমন পারফর্ম্যান্স! অথচ সেসব যেন পড়ে আছে সেই ‘কোহলি বনাম নাভিন’ পর্দার আড়ালে। লেগ স্পিনে সুখ্যাতি অর্জন করা আফগানিস্তানে পেসের ফুলও ফোটাচ্ছেন নাভিন। যে নাভিন বোলিং পছন্দ করতেনই না, একটা সময় যে নাভিন আফগানিস্তানেই থাকতে চাননি। 

    ***

    জন্ম হয়েছিলে আফগানিস্তানের কাবুলে, কিন্ত বেড়ে উঠা হয়নি সেখানে। শৈশব কাটাতে হয়েছে পাকিস্তানে শরণার্থী হয়েই। সেখানে ক্রিকেটপ্রেমের জন্ম হলেও সেভাবে খেলা হয়নি। ছুটির দিনেই যা টেপ-টেনিসে খেলতেন। ব্যাটিংটাই পছন্দ করতেন তখন, বোলিংয়ে ভারী অনাগ্রহ ছিল। আফগানিস্তানে আবার যখন ফিরলেন, তখনই কেবল পরিচয় ক্রিকেট বলের সঙ্গে। 

    একদিন হুট করে বাবাকে বলে উঠলেন, ক্রিকেটার হতে চান। বাবা তো ডাক্তার, পড়াশোনায়ই মনযোগ দিতে বললেন। ভাইকে বুঝালেন, ভাই কীভাবে যেন বুঝিয়ে ফেললেন বাবাকে। স্কুল শেষে ন্যাশনাল ক্রিকেট একাডেমিতে যাওয়ার রুটিন শুরু হলো নাভিনের। তেমনই এক দিন, একাডেমিতে গিয়ে দেখতে পেলেন লম্বা এক লাইন, জানতে পেলেন অনূর্ধ্ব-১৬ দলের ট্রায়াল চলছে। ট্রায়ালের অর্থ পর্যন্ত না বুঝতে পারা নাভিন বোলিং করলেন তিনটা। কোচ বললেন, থ্যাঙ্ক ইউ। নাভিন ভাবলেন, হলো না বুঝি! পরে নিজের নামটা দেখতে পেলেন ৫০ জনের তালিকায়, সুযোগ পেয়ে গেলেন মূল স্কোয়াডেও। 

    ১১ বছর বয়সী নাভিন গেলেন মালয়েশিয়ায় এসিসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যালেঞ্জ কাপ খেলতে। ঐ টুর্নামেন্টটার কথা নাভিন মনেই করতে চান না। তিন ম্যাচে পেয়েছিলেন এক উইকেট। ঘর থেকে ফোন এলে বলতেন, বোলিং হচ্ছে ভালো। উইকেট কয়টি? জানতে চাইলে নিরাশা হাজির হত নাভিনের জীবনে। ভালো বোলিং করেও উইকেট পাচ্ছিলেন না। টুর্নামেন্ট শেষে তাই এতটাই হতাশা ঘিরে ধরেছিল নাভিনকে, পেস বোলিং ছেড়ে দেওয়ার চিন্তাও চলে এসেছিলো মাথায়। 

    দুই বছর পর আবার সে টুর্নামেন্টেই গিয়েছিলেন, ফিরেছেন ১৫ উইকেট নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা হয়ে। এরপর ২০১৪ সালের এসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ প্রিমিয়ার লিগে নিয়েছেন ১৬ উইকেট। সবার থেকে বেশি, রশিদ খানের থেকে বেশি। ২০১৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের দলে ছিলেন, কোন ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। তখনই নিজেকে আল্টিমেটাম দিয়ে দেন নাভিন, পরিবার নিয়ে বসেন, জানিয়ে দেন ক্রিকেটে আর একটি বছরই দেবেন কেবল। মাঠ, মাঠের বাইরে দিবেন ১১০%। ভালো করলে ফল আসবে, তবেই খেলা চালিয়ে যাবেন, নতুবা সমাপ্তি। পরিবার থেকে বলা হয়েছিল, ওসব লাগবে না, সমর্থন আছে তাদের। কিন্ত তিনি যে নাছোড়বান্দা। মনস্থির করেই রেখেছিলেন, কিছু একটা করতেই হবে। ব্যাক্তিগত ট্রেনার রেখে জিমে ঘাম ঝরিয়েছেন। ক্রিকেটে জান-প্রাণ সঁপেই দিয়েছিলেন। ক্রিকেটে কিছু না হলে, বিদেশে পড়াশোনা অথবা কাজের জন্য যাওয়ার পরিকল্পনাও করে ফেলেছিলেন। থাকতেই চাননি আফগানিস্তানে। 

    ২০১৬ সালের ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টে খেললেন এরপর। যেখানে নাভিনের থেকে বেশি উইকেট পেয়েছিলেন একমাত্র রশিদ খান। ১৭ বছর বয়সী নাভিনের ডাক পড়ে যায় আফগানিস্তান জাতীয় দলে। সেই ‘জেদি’ নাভিনের অভিষেক হয় মিরপুরে বাংলাদেশের বিপক্ষে। জাতীয় দলে যদিও পাকাপোক্ত হতে পারেননি তখন, পরের সিরিজেই বাদ পড়েছিলেন। 

    তবে ২০১৮ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে আফগানিস্তান গিয়েছিল নাভিনের নেতৃত্বেই। নাভিনের ক্রিকেট জীবনের শুরুর সময়ে যে টুর্নামেন্টে খেলতে গেলে কোয়ালিফায়ার পর্বের মোড়কে কয়েক ধাপ পেরিয়ে আসতে হতো আফগানিস্তানকে, সে টুর্নামেন্টই তারা শেষ করে চতুর্থ হয়ে। ওই বছরেই আফগানিস্তান প্রিমিয়ার লিগও শুরু হয়ে যায়। নাভিন সেখানে তার বোলিংয়ের ঝলক দেখিয়ে পরের বছর আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির খাতাও খুলে ফেলেন। ধীরে ধীরে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট জগতেও পা পড়ে যায় তার, বিপিএলের দল সিলেট থান্ডারে ডাক আসে প্রথমে। এরপর লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ, সিপিএল, টি-টেন, ব্লাস্ট, বিগ ব্যাশ, পিএসএল- একে একে সব লীগ শেষে ‘স্বপ্নের জায়গায়’ পা রাখা, আইপিএল। 

    ***

    আফগানিস্তানের বাইরের দুনিয়া দেখবেন। নানা দেশ ঘুরে বেড়াবেন, শখ ছিল নাভিনের। ফ্র্যাঞ্চাইজির দুনিয়ায় চলাফেরা তার সে শখ পূরণ করে দিচ্ছে। তবে আইপিএলে এসে বিরাট কোহলির সঙ্গে বাকবিতন্ডায় জড়ানোর পর গেছেন যে ভেন্যুতেই, সবখানেই শোনা গেছে তার দিকে তেড়ে আসা ‘কোহলি, কোহলি’ চিৎকারের কথা। নাভিনের সেসবে আসে যায় না, বরং তার জন্য নাকি তা অনুপ্রেরণার উৎস। পারফরম্যান্সেও অবশ্য কোন ছেদ পড়েনি। 

    আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে আইপিএলে সুযোগ পাওয়াই কম বড় ব্যাপার নয়! আর সেখানে প্রথমবার এসেই নাভিন বল হাতে যা দেখিয়েছেন, তাতে মুগ্ধ হয়েছেন অনেক বিশ্লেষকই। ক্রিজের দুর্দান্ত ব্যাবহার, নানান জাতের স্লোয়ার, ভ্যারিয়েশনের বেড়াজালে ব্যাটারদের আবদ্ধ করা- মুগ্ধ করার মত আছে অনেক কিছুই। গেলবার আফগান আরেক পেসার ফজল হক ফারুকি পেয়েছিলেন আইপিএলের আঙ্গিনায় প্রবেশাধিকার, এবছর নাভিন উল হক। এতদিন স্পিনাররাই আফগানিস্তানের সুনাম বাড়িয়েছিলেন, সময়ের সাথে যোগ দিচ্ছেন পেসাররাও। 

    হার্শা ভোগলে ও রশিদ খানের একটা কথোপকথনে নজর দেওয়া যাক। 

    হার্শাঃ তুমি একবার বলেছিলে, একটা একাডেমিতে গিয়েছ, গিয়ে দেখতে পেলে প্রায় ২৫০ রিস্ট স্পিনার। 

    রশিদঃ হ্যাঁ, আড়াই শর মতো হবে। এখন আরও বাড়বে। তখন ছিল আইপিএলে আমার প্রথম আসর। সেটার এমনই প্রভাব আসলে ছিল আফগানিস্তানে। আমি আরও ৫-৬ বছর খেলে ফেলেছি আইপিএলে, এখন তা আরও বেশি। 

    রশিদ খানে অনুপ্রাণিত কত তরুণ বল হাতে স্বপ্ন দেখছে আফগানিস্তানে। পেসাররাও এখন বিশ্বমঞ্চে নাম কুড়াচ্ছেন। আফগানিস্তানে পেসারদের নিয়ে যে ধারণা, নাভিন উল হক তো তা ভুল প্রমাণও করেছেন। দেখিয়েছেন আফগানিস্তানের পেসাররাও এখন সর্বোচ্চ মঞ্চে উঠতে পারে। স্পিনের সাথে সামনের সময় কি তাহলে হবে আফগানি পেসেরও?