টাকা দিয়েই সাফল্য কিনেছেন, বড় ক্লাব ছাড়া অচল: গার্দিওলাকে নিয়ে কিছু 'মিথ' ও সেগুলোর খন্ডন
কদিন আগেই হ্যাটট্রিক প্রিমিয়ার লিগ জিতেছেন পেপ গার্দিওলা, সামনে হাতছানি দিচ্ছে এফএ কাপ ও চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি। এই সময়ের তো বটেই, সর্বকালের সেরা কোচদের তালিকায়ও তাকে রাখবেন অনেকে। কিন্তু গার্দিওলাকে নিয়ে নিন্দুকরা বলেন, বড় ক্লাবে না গেলে তিনি সাফল্য পেতেন না, কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করেও তার চ্যাম্পইয়নস লিগ বেশি নেই। কিন্তু এসব অপবাদের সত্যতা কতটা?
গার্দিওলা অনেক বেশি টাকা খরচ করেন!
গার্দিওলাকে নিয়ে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, অঢেল টাকা আছে বলেই তিনি একের পর এক শিরোপা জিতেছেন। ম্যান সিটির দায়িত্ব নেওয়ার পরেই এই কথা তাকে বেশ শুনতে হয়েছে। তেলের আশীর্বাদে সিটি দলবদলে টাকা দুই হাতে খরচ করেছে। তবে ভুলে গেলে চলবে না, প্রিমিয়ার লিগের বড় ক্লাবগুলো ম্যান সিটির চেয়ে কম নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো বেশিই খরচ করেছে। গত পাঁচ বছরে প্রিমিয়ার লিগের মোট ব্যয়ের হিসেব দেখলেই তা পরিষ্কার হবে।
ক্লাব | টাকা |
চেলসি | ১১৬৭ মিলিয়ন পাউন্ড |
ম্যান ইউনাইটেড | ৭৬৮ মিলিয়ন পাউন্ড |
ম্যান সিটি | ৬৭০ মিলিয়ন পাউন্ড |
আর্সেনাল | ৬৩৪ মিলিয়ন পাউন্ড |
লিভারপুল | ৫২৩ মিলিয়ন পাউন্ড |
ম্যান ইউনাইটেড | ৫২৩ মিলিয়ন পাউন্ড |
সিটির তেল ব্যবসায়ীদের চেয়ে ম্যান ইউনাইটেড আর চেলসির আমেরিকান ও রাশিয়ান মালিক এই সময়ে অনেক বেশি খরচ করেছে খেলোয়াড় কেনার জন্য। শুধু এই মৌসুমেই ৩০০ মিলিয়নের বেশি খরচ করেছে চেলসি, কিন্তু শীর্ষ দশেই জায়গা করে নিতে পারছে না।
আবার খেলোয়াড় বিক্রি করে ম্যান সিটির চেয়ে টাকা আর কেউ বেশি কামাতে পারেনি। প্রিমিয়ার লিগে ব্রাইটন, লেস্টারের মতো ক্লাব কম খরচে খেলোয়াড় কিনে বা অ্যাকাডেমির খেলোয়াড় বিক্রি করে অনেক বেশি দামে বিক্রি করে। কিন্তু এই ব্যাপারে সিটিও কম যায় না। স্রেফ খেলোয়াড় বিক্রি করেই তারা ৫০০ মিলিয়নের বেশি আয় করেছে।
খেলোয়াড় বিক্রি করে মোট আয়
ক্লাব | খেলোয়াড় |
ম্যান সিটি |
৫৪৯ মিলিয়ন পাউন্ড |
চেলসি | ৫১০ মিলিয়ন পাউন্ড |
লেস্টার | ৩০৩ মিলিয়ন পাউন্ড |
লিভারপুল | ২৫১ মিলিয়ন পাউন্ড |
ম্যান ইউনাইটেড | ১৮৬ মিলিয়ন পাউন্ড |
সিটি যে শুধু খেলোয়াড়দের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করেছে এটা অনেকেই বলে, কিন্তু সেই খেলোয়াড়দের আরও ভালো বানিয়ে গার্দিওলা যে আরও বেশি দামে বিক্রি করতে পারেন, সেটা ভুলে যান অনেকেই। লিভারপুল থেকে স্টার্লিং সিটিতে এসে খেলোয়াড় হিসেবে আরও ভালোই শুধু করেননি, তাকে মোটা দামে কিনেছে চেলসি। সিটিতে ভালো করতে না পারলেও লেরয় সানে বায়ার্নে গেছেন চড়া দামে, জেসুস-জিংচেংকোদের কিনতেও মোটা টাকা খরচ করেছে আর্সেনাল। ফেরান তোরেসও বার্সায় গেছেন বেশ ভালো অংকে। এই মৌসুমেই হুলিয়ান আলভারেজকে মাত্র ১৫ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে নিয়ে এসেছেন রিভার প্লেট থেকে। সেই আলভারেজ আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ জিতেছেন। ম্যানুয়েল আকাঞ্জিকে এই জানুয়ারির আগে অনেকেই চিনতে না। তাকে ডর্টমুন্ড থেকে ১৫ মিলিয়নে আনার পর এখন গার্দিওলার রক্ষণের বড় ভরসা। এমনকি এই দলের আকে, জন স্টোনস, বার্নাদো সিলভা, রদ্রিরা গার্দিওলার সিটিতে আসার আগে কতটা বড় তারকা ছিলেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। আর এখন নিজের পজিশনে এদের বলা হচ্ছে বিশ্বসেরা।
কেনা | বিক্রি | |
রাহিম স্টার্লিং |
৪৯ | ৫২ |
লেরয় সানে | ৪৬.৫ | ৬৪ |
ফেরান তোরেস | ২১ | ৬৩ |
গ্যাব্রিয়েল জেসুস | ২৭ | ৪৫ |
অলেগ জিংচেংকো | ১.৭ | ৩৪ |
গার্দিওলা বোরিং টিকিটাকা চালু করেছেন!
গার্দিওলার দলকে নিয়ে আরেকটি বড় অপবাদ, তিনি স্পেনে বোরিং টিকি টাকা চালু করেছেন। যে টিকি টাকার অভিশাপ নাকি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে স্পেন বা বার্সা। এই ধারণা যে ভুল, সেটা অবশ্য এখন না বললেও চলে। গার্দিওলা নিজেই তার আত্মজীবনী পেপ কনফিডেনশিয়ালে লিখেছেন, স্রেস উদ্দেশ্যহীন পাসিং ফুটবল তিনি ঘৃণা করেন। আর টিকিটাকা মানে উদ্দেশ্যহীন পাসিং ফুটবল নয় মোটেই। গার্দিওলার দর্শনকে বলা যায় জুগেও দে পজিশিওন ফুটবল। পজেশনভিউত্তিক এই দর্শনের মূল কথা হচ্ছে বল দখলে রেখে স্বাধীনভাবে খেলা, কিন্তু উদ্দেশ্যহীন পাসাপাসি মোটেই নয়। গার্দিওলা এও বলেছেন, আধুনিক ফুটবলে পর পর দুই মৌসুমে একই ট্যাকটিকস নিয়ে খেলারও সুযোগ নেই। এটা ভুলে গেলে চলবে না, গার্দিওলার এই দর্শন থেকে এখনকার অনেক কোচই উদ্বুদ্ধ হয়েছেন। এমনকি গত কয়েকটা বিশ্বকাপজয়ী দলে গার্দিওলার প্রত্যক্ষ প্রভাবও রয়েছে। এমনকি পাসিং ফুটবল দিয়ে ইংল্যান্ডে তিনি কিছু করতে পারবেন না, এমন কথাও উঠেছিল। সেটার উত্তর এখন সবার জানা ।
গার্দিওলার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ অনেক কম!
গার্দিওলাকে নিয়ে আরও একটা বড় অভিযোগ, এত বছরের ক্যারিয়ারের তার চ্যাম্পিয়নস লিগ মাত্র দুইটি। একটু মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, ফুটবল ইতিহাসেই তার চেয়ে বেশি চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের কীর্তি আছে শুধু কার্লো আনচেলত্তি, বব পেইজলি বা জিনেদিন জিদানের। এবারে জিতলে গার্দিওলা ছুঁয়ে ফেলবেন তাদের। জোসে মরিনিও থেকে শুরু থেকে এমনকি সর্বকালের সেরা কোচ হিসেবে অনেকেই যাকে মনে করেন, সেই অ্যালেক্স ফার্গুসনেরও মাত্র দুইটি চ্যাম্পিয়নস আছে।
গার্দিওলা 'ওভারথিংক' করেন
এবং সব আর চেয়ে বড় যে অভিযোগ শোনা যায় গার্দিওলা বড় ম্যাচে ওভারথিংক করেন। যেটাকে সহজ ভাষায় 'পাকনামি' বলা যায়। এই কাজটা তিনি আগে করেছেন অবশ্যই। সর্বশেষ যে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে গার্দিওলা খেলেছিলেন, সেখানেই তার কোনো ডিফেন্সিভ মিড না নামানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে সমালোচনা হয়েছিল। এবারের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে বড় ম্যাচে সেই অর্থে কোনো পরীক্ষাই করেননি, ঝুঁকি নেওয়া দূরে থাক। সেমিফাইনালের প্রথম লেগে রিয়ালের সাথে কোনো বদলি নামাননি, বদলি করেননি লাইপজিগের বিপক্ষেও ম্যাচে। দ্বিতীয় লেগেও প্রথম লেগের দলটা নামিয়েছেন। এবার লিগে আর্সেনালের সাথে মহাগুরুত্বপূর্ণ দুই ম্যাচেও কোনো পরীক্ষা করেননি। লিগে ছোট ম্যাচে কিছু করলেও বড় ম্যাচে পরীক্ষিতদের ওপর ভরসা রেখেছেন। এ থেকে বোঝা যায় এই অপবাদ থেকেও ধীরে ধীরে সরে আসছেন তিনি।
ছোট দলের দায়িত্ব নিলে ব্যর্থ হতেন
পেপের বিরুদ্ধে আরেকটা অভিযোগ, তিনি বড় দল, বড় খেলোয়াড়দের দায়িত্ব পেয়েছেন বলেই এত সফল। ছোট দলের দায়িত্ব নিলে এত সফল হতেন না। পালটা যুক্তি হিসেবে বলা যায় গার্দিওলা প্রথম যখন বার্সাকে নিয়ে লিগ জিতেছিলেন বার্সা তার আগের বছর একটা পালাবদলের মধ্যে গিয়েছিল। মেসি, ইনিয়েস্তা,জাভিদের শেষ নয়, শুরুটা গার্দিওলার হাত ধরে। গার্দিওলা চলে যাওয়ার পর বার্সা মাত্র একবার লিগ জিতেছে। আবার উলটো দিকে এটাও ঠিক বড় দলের দায়িত্ব পেলে সেটা সামলানোর ক্ষমতাও সবার থাকে না। এমেরি, ময়েসরা ছোট দলে যতটা সফল, বড় দলে ততটা নন। তাই গার্দিওলাকে বড় দল সামলানোর জন্যও সম্ভবত আপনার কৃতিত্ব দেওয়া উচিত। স্টার্লিং যখন সিটিতে এসেছিলেন, তখন তাকে নিয়ে অনেক প্রশ্ন ছিল। প্রায় বাতিলের খাতায় চলে যাওয়া সেই স্টার্লিং এরপর নতুন জীবন পেয়েছেন সিটিতে। গার্দিওলার অধীনে অনেক খেলোয়াড়ই বলেছেন, তারা আগের চেয়ে খেলাটাকে আরও ভালো বুঝতে শিখেছেন। এসবের জন্য তিনি কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন।