টেস্ট বিশ্বকাপ ফাইনাল: সবাইকে 'ভুল' প্রমাণের পরও যেসব কৌশলের ভুলে আটকে গেল ভারত
সবাই ভুল। রিকি পন্টিং, নাসের হুসেইন, কুমার সাঙ্গাকারা। ভারত সঠিক। পিচ পড়তে পেরেছে ভারত। ভুল হয়েছেন ধারাভাষ্যকারেরা। কিন্ত আসল জায়গায়ই যে ভুল করে বসেছিল ভারত।
প্রথম দিনের সব আলোচনা বরাদ্দ ছিল রবিচন্দ্রন অশ্বিনের জন্য। বিশ্বের নাম্বার ওয়ান বোলার, টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপের এই চক্রে ভারতের নাম্বার ওয়ান, সেই অশ্বিনের নাম একাদশে ‘মিসিং’। রিকি পন্টিং আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বলে দিলেন, পিচে শেষের দিকে টার্ন নিবে, স্পিনাররা সহায়তা পাবে যথেষ্ট। নাসের হুসেইন, কুমার সাঙ্গাকারা, দীনেশ কার্তিক- সকলেরই ছিল একই মত। ভারত কি তাহলে ভুল পথে পা দিল?
ফাইনালের প্রথম দিনের সবুজ পিচ আর মেঘলা আকাশ, অধিনায়ক রোহিতকে টসে জিতে ফিল্ডিং নিতে বলছিল। ভারত ভেবেছে, পিচ খুব বেশি পরিবর্তন হবে না, শেষের দিকে বরং ব্যাটিংয়ের জন্য সহজ হবে। সেকারণেই পরে ব্যাট করতে চাওয়া, পরে আলাদাভাবে জানিয়েছিলেন রোহিত ও কোচ দ্রাবিড় দুজনেই। এমনটাই হয়েছিলও আসলে। ব্যাটিংয়ের জন্য টেস্টের সবচেয়ে ভালো সময় মনে হয়েছে চতুর্থ-পঞ্চম দিন, টেস্টের শেষের দিকে তো মনে হচ্ছিল সময়ের সাথে ‘ফ্ল্যাট’ই হচ্ছে পিচ। ভারত তাহলে পিচের প্রশ্নে সঠিক। তাহলে ভুলটা করলো কোথায়?
***
ট্রাভিস হেডের বাউন্সারে বড়সড় দুর্বলতা ফুটে উঠেছে এই টেস্টে। কিন্ত ভারত তা কাজে লাগাতে একটু দেরিই করে ফেলেছিল! শেষ পর্যন্ত শর্ট বলে আউটও হয়েছেন এক ইনিংসে, তবে দুই ইনিংসেই শর্ট বল কিংবা বাউন্সারে তার ভোগান্তি দেখা গিয়েছিল। দ্বিতীয় ইনিংসে একবার ক্যাচও তুলেছিলেন, মিসটাইমিং তো হয়েছেই আরও কয়েকবার। প্রথম ইনিংসে সিরাজ-শামিদের বাউন্সারে কয়েকটি বাউন্ডারি যদিও আদায় করে নিয়েছিলেন হেড, সেসব আসলে শরীরে তাক করা না বলে আক্রমণাত্মক মনোভাবে থাকা হেডের কোন সমস্যা হয়নি। আক্রমণের জবাব আক্রমণে দিতেই হেডের মন ছিল বলে উইকেটের ভালো সুযোগই ছিল বাউন্সারে।
প্রথম ইনিংসে যখন ভারত শর্ট বলের আক্রমণে যায়, ততক্ষণে হেড ঢুকে গেছেন নব্বইয়ের কোটায়। এত দেরিতে কেন বাউন্সারের আক্রমণ, কমেন্ট্রিতে থাকা রিকি পন্টিংকে তা অবাক করেছিল বেশ। তার মতে শুরুতেই সে পথে যাওয়া উচিত ছিল, নতুন ব্যাটারকে ক্রিজে আসার পরেই দুর্বলতায় আঘাত হেনে নড়বড়ে করার সুযোগ নিতে। কিন্ত ১৬৩ রান করা ম্যাচের নায়ক হেডের বিপক্ষে শুরুতে ভারত হেটেছিল উল্টো পথে। হেডের ইনিংসের প্রথম ৩০ বলে শর্ট লেংথে করেছিল মাত্র ৬টি বল। নিচের ছবিতেই দেখতে পাচ্ছেন যা কেবল ২০ শতাংশ।
হেডের বড় একটা শক্তির জায়গা, আউটসাইড অফের বলগুলোতে সামান্য জায়গা পেলেই মেরে দিতে পারেন অনায়াসে। ভারতের শুরুতে করা গুড লেংথ, ব্যাক অব লেংথের বলগুলো তাই খুব একটা সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়নি হেডের জন্য। রাউন্ড দ্যা উইকেটে এসে সিরাজ-শামিরা যখন চেষ্টা করেছেন, এলোমেলো লাইনের ফায়দাটা চার মেরে ভালোই নিয়েছেন হেড। হেডের ইনিংস ৩০ বল পেরিয়ে যাওয়ার পর একবার দেখানো পিচম্যাপে দেখা যায়, ভারতের শেষভাগে করা ওই বাউন্সার আক্রমণের চিত্র। দেখুন তো, ৪৮ শতাংশ বল শর্ট লেংথে।
পরে সংবাদ সম্মেলনে এসে ভারতের বোলিং কোচ পারাস মাম্ব্রে বলেছেন, শর্ট বলের পরিকল্পনা নিয়ে তারা সজাগ ছিলেন এবং সেটিতে তারা আগে গেলেও পারতেন। কিন্ত সেইসাথে জানিয়েছেন, পিচে যেহেতু পেসাররা মুভমেন্ট পাচ্ছিলেন অধিনায়কের ভাবনায় হয়তো ছিল অন্যকিছু। শুরুতেই তাই তারা সেই পরিকল্পনার দিকে পা রাখেননি।
***
বোলিংয়ে নেমে প্রথম সেশনটা মুভমেন্ট পেয়ে ভালোই কাটিয়েছিল ভারত। প্রথম দিনে ৩২৭ রান দিয়ে ফেলা ভারত কিন্ত একটা সময় ৭৬ রানেই অস্ট্রেলিয়ার ৩ জনকে বিদায় করতে পেরেছিল। সেখান থেকে যে ৪৬৯ রানের পাহাড় গড়েছে অস্ট্রেলিয়া, তাতেই ম্যাচের ফল একপক্ষে হেলে গেছে। ভারতের হার না বলে, আরেকটি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে ব্যর্থতা যদি বলি, সেটির প্রধান কারণ হবে এই প্রথম ইনিংসের বোলিংই।
প্রথম সেশনে ৭৩ রান দিয়েছে ভারত, শেষদিকে ওয়ার্নারের উপহারস্বরুপ উইকেটের দরুণ পেয়েছে দুই উইকেট। টসে জিতে বোলিং নেওয়া ভারত কন্ডিশন মোতাবেক শুরুতেই বড়সড় ধাক্কা বসাতে পারেনি অজিদের বুকে, তাদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যা বড় ভূমিকা রাখতে পারত। দ্বিতীয় সেশনের শুরুতেই লাবুশেনকে আউট করতে পেরেছিল ভারত। সেকারণে তাই ততক্ষণে যা করেছে, সেটিকে ‘ভালো’ না বলার সুযোগ কম।
তবে প্রথম সেশনেই মনে হচ্ছিল শামি-সিরাজ কিছুটা শর্টার লেংথে বল করছেন। তার মানে, সুইংয়ের সহায়তায় বারবার ব্যাটারদের পরাস্ত করলেও ব্যাটের কানায় লাগাতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন তারা, সেই সাথে শর্টার লেংথে করার কারণে স্টাম্পেও আঘাত করেননি যথেষ্ট, যাতে মিটে যায় বোল্ড ও এলবিডব্লিউর সম্ভাবনা। ওয়ার্নারই তো টেস্ট চলাকালীন এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার ফ্রন্ট ফুট ডিফেন্সের ভালোরকম পরীক্ষা নিতে পারেনি ভারত। সেটির কারণ ওই তুলনামূলক কিছুটা পেছনের দিকে বল করাই।
স্মিথ-হেডের জুটিতে যেকারণে আরও ভুগেছে পরে ভারত। ব্রডকাস্ট চ্যানেলের সৌজন্যে এই ভাবনার পক্ষে পরিস্কার চিত্রও মিলেছে। আচ্ছা, নিচের ছবিটায় খেয়াল করুন তো, ভারতীয় পেসারদের করা বলগুলোর মধ্যে ৯১ শতাংশ বলই দেখা যাচ্ছে স্টাম্পে আঘাত করতো না, তার মানে মাত্র ৯ শতাংশ বলই কিন্ত স্টাম্পে আঘাত করতো। এই তথ্য ও ছবি মিলেছে যখন, ততক্ষণে ভারত করে ফেলেছে প্রায় ৮০ ওভার, তাদের ইনিংসের অনেকটুকুই।
তার মানে পুরো ইনিংসের বেশিরভাগ সময়েই ভারতীয় পেসাররা বোল্ড ও এলবিডব্লিউর সম্ভাবনা তৈরি করতে পারেননি। আবার এটিতে উচ্চতার দিকে খেয়াল করলে কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে, খুব বেশি ফুল লেংথের বলও করেনি ভারতীয় পেসাররা, যাতে ব্যাটারদের ড্রাইভ খেলতে প্রলুব্ধ করবে। সুইংময় কন্ডিশনে সেটি উইকেট পাওয়ার ভালো একটা ধরনই আসলে।
তৃতীয় উইকেট তুলে ফেলার পর উমেশ-শার্দুলকে এনেছিলেন রোহিত। উমেশ এসে একেবারেই ছন্নছাড়া বল করে রান বিলাতে থাকেন। যার প্রভাব পড়েছে শার্দুলের উপরও, নয়তো শার্দুলকে প্রায় সময়ই দেখা যায় উইকেটের খুঁজে ব্যাটারদের ফুল লেংথের বল করে প্রলুব্ধ করতে। সুইংয়ে বল বের করিয়ে নিয়ে রান আটকানো, শার্দুলের অনেকটাই প্রধান মনযোগের বিষয় হয়ে গিয়েছিল তখন।
লাবুশেনের উইকেটের লাল বলটা দেখুন তো, আর বাকি বলগুলো দেখুন। লাবুশেনের প্রথম ইনিংসের পিচম্যাপে স্পষ্ট, ভারতীয় পেসাররা কতটা পেছনের দিকে বল করেছেন। শামি-সিরাজরা যেমন গুড লেংথের বল করে গেছেন ঠিক, তবে সেগুলোর বেশিরভাগই বাউন্সের কারণে কিংবা ছেড়ে দেওয়ার মতো বাউন্স হওয়ায় লাবুশেনের কোন সমস্যা হয়নি। ব্যাটারদের যত সম্ভব খেলতে বাধ্য করার যে উদ্দেশ্য, সেটি সাধন হয় না এতে।
অধিনায়ক রোহিত বলেছেন, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনা থেকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলাম আসলে। পিচে যথেষ্ট সহায়তা ছিল। তবে এই পিচে প্রথম ইনিংসে যেভাবে বোলিং করা উচিত ছিল, সেভাবে আমরা করতে পারিনি।’
দ্বিতীয় ইনিংসেই ভারত দেখিয়েছিল, কীভাবে প্রথম ইনিংসে তাদের বোলিং করা উচিত ছিল। শুরু থেকেই আগ্রাসী ভারত শর্ট লেংথের সাথে দুর্দান্তভাবে ফোলার লেংথের মিশ্রণ করে অজি ব্যাটারদের বেধে রাখতে সক্ষম হয়েছিল। প্রথম ইনিংসে ৪৬৯ রান যে অনেক বেশি দিয়েছিল ভারত, সেটি পরে জানিয়ে ভারতের কোচ রাহুল দ্রাবিড় বলেছেন, ‘এটি ৪৬৯ রানের পিচ ছিল না।’ সে পিচে পুরো টেস্টে বোলারদের জন্য সবচেয়ে বেশি সহায়তা ছিল যেদিন, সেই প্রথম দিনে বোলিংয়ের সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি ভারত। পারাস মাম্ব্রেও স্বীকার করেছেন, তারা আরেকটু শৃঙ্খলা দেখাতে পারতেন প্রথম ইনিংসের বোলিংয়ে।
***
এখনও অশ্বিনকে না রাখাটা অনেকের চোখেই ভুল। শচীন টেন্ডুলকারই যেমন টুইট করে জানিয়ে দিয়েছেন, অশ্বিনকে কেন রাখা হলো না, তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। দ্বিপক্ষীয় সিরিজে সাফল্যের সুনাম, কিন্ত বৈশ্বিক টুর্নামেন্টে এসে একের পর এক ব্যর্থতা, সুযোগ থাকলে ভারতের দর্শকেরা সেইসব হারা প্রত্যেক ম্যাচকেই তো আদালতের মঞ্চে হাজির করিয়ে ছাড়ত। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপে দ্বিতীয়বার ভরাডুবিতে যে মামলা হতো, সেখানে ভারতের প্রথম ইনিংসই প্রধান আসামী। প্রথম ইনিংসে স্পিনার অশ্বিনের ভূমিকা বিশাল আকারে প্রভাব ফেলতে পারত, তা কী বলা যায়? রিকি পন্টিংরা যে ভাবনায় বলেছিলেন, শেষের দিকেও তো বড়সড় টার্নের দেখা মেলেনি।
শুধু বাঁহাতি ব্যাটারদের ক্ষেত্রে রবিন্দ্র জাদেজা বড় বড় টার্ন পেয়েছিলেন, সেটির কারণ বাঁহাতিদের আউটসাইড অফে ‘রাফ’ বা পিচের ক্ষত সৃষ্টি হওয়া, সেভাবে যা ডানহাতিদের ক্ষেত্রে তৈরি হয়নি। ন্যাথান লায়নকে তাই এমনিতে বড় টার্ন পেতে দেখা যায়নি। শার্দুলকে যেভাবে টার্নে পরাস্ত করে এলবিডব্লিউ করেছিলেন বা প্রথম ইনিংসে জাদেজার আউটে কিছুটা, সেভাবে গুটিকয়েকবার দেখা গেলেও আদতে পঞ্চম দিনে এসেও বড়সড় টার্ন পাননি ডানহাতি স্পিনার লায়ন।
ভারতের ডানহাতি স্পিনার অশ্বিনের ভূমিকা নিয়ে তাই সন্দিহান থাকতেই হয়, আর প্রথম দিনে তো আরও বেশি। তাই অশ্বিনকে না রাখা, এটির পক্ষে খুব বেশি জোরদার আওয়াজ দেওয়া সম্ভব হবে না নিশ্চয়ই। তবু তিনি রবিচন্দ্রন অশ্বিন বলেই তো এত আলোচনা! পিচের বিষয়ে অন্তত ভারতের দিকে প্রশ্ন তোলার সুযোগ নেই। প্রথম দিন দুয়েকে অশ্বিনকে না রাখায় ভারত ম্যানেজমেন্টের উপর কম অভিযোগ উঠেনি। তবে পিচ পড়তে পারায় তো বাকিদেরই উল্টো ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে ভারত। কিন্ত তাতে কী হবে! আসল কাজটাই যে করতে পারেনি তারা, বল নিয়ে খেলায়, ব্যাট নিয়ে খেলায়।