বাংলাদেশ তো খেলে আপনার সঙ্গেও
দুই ম্যাচ হেরে গেছি বলেই কিন্ত আমরা খারাপ দল হয়ে যাইনি। দ্বিতীয় ওয়ানডের পর মেহেদী হাসান মিরাজের বলা এ কথাটা আপনার কাছে তখন হয়তো একরকম লেগেছে। এখন তৃতীয় ওয়ানডে শেষে হয়তো অন্যরকম।
বাকি দুই ফরম্যাটের বেলায় প্রশ্ন করারই প্রয়োজন নেই। কিন্ত বাংলাদেশ কী আসলেই ওয়ানডেতে ভালো দল হয়ে উঠেছে? সে প্রশ্নের উত্তর কি আপনি এখনই দিয়ে দিতে পারেন কোনও দ্বিধা-দ্বন্দ ছাড়াই? সুপার লিগে তৃতীয় হয়ে বিশ্বকাপে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা বাংলাদেশকে নিয়ে এখন অনেকেরই স্বপ্ন দূর-বহুদূরের। বাংলাদেশ কাছে আসতে চায় বিশ্বকাপের, বিশ্বকাপটাই তো নিজেদের করে নেওয়ার স্বপ্ন আছে মনে মনে অনেক বাঙালীর।
সেই তারা প্রথম ম্যাচে কী দেখতে পেল, তাদের দলটা দুমড়ে-মুচড়ে গেল আফগানিস্তানের বোলিংয়ের সামনে। চট্টগ্রামে প্রথম ওয়ানডের পিচে বাউন্স বেশ অসম ছিল, মাঝেমধ্যেই বল নিচু হয়ে আসছিল। অতটা ব্যাটিং-সহায়ক না হলেও তবু ৪৩ ওভারে ১৬৯ রান! রশিদ-মুজিবদের কীভাবে সামলাবে, সে পথ খুঁজে পাওয়ার আগেই যেন ইনিংস শেষ হয়ে গেল। তার আগে ফারুকিও কম ভোগান্তিতে ফেলেননি!
বাংলাদেশের বিপক্ষে আফগানিস্তানের যেসব বোলার কমপক্ষে পাঁচ উইকেট নিয়েছেন, তাদের মধ্যে একমাত্র ফজলহক ফারুকিরই গড় বিশের কম। ৬ ম্যাচে ১৫.৫৭ গড়ে ১৪ উইকেট নেওয়া ফারুকি বাংলাদেশের নতুন মাথাব্যাথা। বাংলাদেশের সহকারী কোচ কোচ নিক পোথাস, তৌহিদ হৃদয়রা বলে গেছেন, বিশ্বের সেরা স্পিন আক্রমণের একটি আফগানদের। সেই স্পিনত্রয়ীর সাথে ফারুকি, সে বোলিং আক্রমণ তো ভালোই পরীক্ষা নিতে সক্ষম। তবু এত নাজেহাল অবস্থা! যাই হোক, এক ম্যাচই তো! কিন্ত পরের ম্যাচেও যে বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের ছবি বিবর্ণই থেকে গেল। ১৮৯ রানে এবার অলআউট!
অলআউট হওয়ার আগে বোলিংয়ে তো আরও বিশাল আকারের দুর্দশা। আফগানিস্তানের বোলিং শক্তি যেকোন দলেরই খারাপ দিনের কারণ হতে পারে, কিন্ত ব্যাটিং এতটাও শক্তিশালী নয় যে বাংলাদেশ ২৫০ রান দিয়ে ফেলবে, অথচ কোন উইকেট নিতে পারবে না। ৩৬তম ওভারে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে যখন আফগানিস্তান ২৫০ পেরিয়ে গেছে ওপেনিং জুটিতেই, তখনই নিশ্চিত হয়ে গেছে সে ম্যাচে বাংলাদেশের পরিণতি। শেষের দিকে নিয়মিত উইকেট তুলে নিয়ে ৩৩৮ রানে আটকাতে পারলেও তা লক্ষ্যতাড়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল না। দ্বিতীয় ইনিংসে তো পিচ আরেকটু কম ব্যাটিং সহায়ক মনে হয়েছিল। তারপরও বাংলাদেশ কী একেবারে খেলতেই পারবে না! রশিদ-মুজিব-নাবি, স্পিনত্রয়ীর ভূতে যেন আতঙ্কিতই হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশ। প্রথম দুই ওয়ানডেতে ৪৯ ওভারের স্পিনে বাংলাদেশ খেলেছে ৩.৩৮ রান রেটে, ১৫.০৯ গড়ে উইকেট হারিয়েছে ১১টি।
বল একদিকে আর ব্যাট আরেকদিকে, পাড়ার খেলায় প্রচলিত এ কথারই যেন মঞ্চায়ন ঘটছিল সাগরিকায়! হাত দেখে রশিদ-মুজিবকে পড়তে পারা যে কারো জন্যই বড্ড মুশকিল। আদৌ কারা পারেন, জানা নেই! তবে তাদের বিপক্ষে যেভাবে হৃদয়-আফিফরা ব্যাট করেছেন, অন্তত যে দলকে নিয়ে মানুষজন বিশ্বকাপের স্বপ্ন দেখে, সেটি তা হতে পারে না! বল বুঝে উঠার আগেই শান্ত-আফিফ আড়াআড়ি খেলতে গিয়ে আউট, হৃদয় গুগলি বুঝার আগেই লেগব্রেকের জন্য খেলেছিলেন বুঝা যায় তার ব্যাট-প্যাডের বিশাল গ্যাপ দেখে। মুশফিকই শুধু স্বাচ্ছন্দ্যে খেলে গেছেন বলা যায় আফগান স্পিনত্রয়ীকে, সেই সাথে কিছুটা মিরাজও। বাকিরা না পারলেও মুশফিক কীভাবে পেরেছিলেন?
বেশি সামনের লেংথ হলে তো মুশফিক আগ বাড়িয়েই খেলেছেন। নয়তো যত সম্ভব পারা যায়, মুশফিক বেশি করে ব্যাকফুটেই শট খেলার চেষ্টা করেছেন, যাতে বল পিচ করার পরে যথেষ্ট সময় পান বলের টার্ন বুঝার, এবং টার্নের সাথে মানিয়ে খেলতে পারেন যেন। বরাবরই ব্যাকফুটে দুর্দান্ত মুশফিক যতটুকু দেরিতে সম্ভব, তত দেরিতেই খেলার চেষ্টা করেছেন। আবার বাউন্ডারি খুঁজে নিতে দারুণভাবে সুইপেরও ব্যবহার করেছেন। মুশফিকের ৬৯ রানের ইনিংসের বদৌলতে বাংলাদেশ হারের ব্যবধানটাই তবু কমাতে পেরেছিল শুধু। তারপরও ব্যবধানটা থেকে গেছে বিশাল, ১৪২ রানের! এই বাংলাদেশ কী পারবে, আপনার মনের ঘরে হয়তো আগমন ঘটেছে এ সংশয়ের।
দ্বিতীয় ওয়ানডেতে যে ছন্নছাড়া বোলিংয়ের প্রদর্শনী দেখিয়েছিল বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশই তৃতীয় ওয়ানডেতে দেখাল সম্পুর্ণ ভিন্নরুপ। কী দারুণ পরিকল্পনা, কী দারুণ বাস্তবায়ন। গুরবাজ ও রহমত শাহকে দুর্দান্ত দুই বাউন্সারে ফিরিয়েছে বাংলাদেশ। তাসকিন-শরিফুল মিলে নিয়মিত বাউন্সারে ব্যাকফুটে রেখেছেন আফগান ব্যাটারদের। টাইট লাইন-লেংথের বোলিংয়ের সাথে বাউন্সারের দারুণ মিশ্রণে কী পরিকল্পিত বোলিংই না করেছিলেন দুই পেসার। পাওয়ারপ্লেতেই নেই আফগানিস্তানের টপ চার ব্যাটার। আফগানদের যে রানে টাইগাররা অলআউট করলো, ১২৬ রানে এর আগে কখনই পারেনি তারা। লিটনের ফিফটিতে সাত উইকেটের বিশাল জয় এবার বাংলাদেশের। এ যেন সেই বাংলাদেশ, যে বাংলাদেশকে নিয়ে তারা স্বপ্ন দেখে বিশালাকারের!
কিন্ত সে স্বপ্ন দেখাটা আপনার বাড়াবাড়ি হচ্ছে না তো? এক-দুই ম্যাচেই বলে ফেলা যায় না, তারপরও দলটা একদিন এমনভাবে খেলে, যা বুঝিয়ে দেয় ‘আমরা ভালো দল না’, সে দলটাই পরে আবার তাদের খেলায় যেন বুঝিয়ে দেয় তারা ‘ভালো’! আপনি কিছুটা হলেও সংশয়ে পড়ে যান, দলটাকে ভালো বলবেন নাকি না।
শুধু প্রতিপক্ষের সঙ্গেই না, বাংলাদেশ তো তাহলে খেলে আপনার সঙ্গেও!