তামিমের ইউ টার্ন : বাংলাদেশের লাভ না ক্ষতি?
‘গেম অফ থ্রোন্স’ বা ‘ব্রেকিং ব্যাড–এর মতো থ্রিলারকেও হার মানাবে তামিম ইকবালের অবসর সংক্রান্ত নাটকীয়তা। চট্টগ্রামে কান্নাভেজা চোখে জাতীয় দলকে বিদায় বলেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এর একদিন পরই প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকের পর ঢাকায় সেই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করলেন। তামিম ইকবালের এই এই ‘ইউ-টার্ন’-এর পর সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, বাংলাদেশ দলের এতে লাভ হলো নাকি ক্ষতি?
আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিটাই বেশি মনে হবে আপনার কাছে। তামিমের এই অবসর কাণ্ডের পর দলের মনোযোগটা স্বাভাবিকভাবেই নড়ে যাওয়ার কথা। আফগানিস্তানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাংলাদেশ যেভাবে উড়ে গেছে, তাতে বোঝা গেছে তাদের মনোযোগ মাঠেই ছিল না। যদিও পরের ওয়ানডেতে আবার দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ
কিন্তু বিশ্বকাপের যেখানে তিন মাসও বাকি নেই, সেখানে দলের অধিনায়ককে নিয়ে এমন অনিশ্চয়তা দলের জন্য ভালো কিছু নয়। তবে বাংলাদেশ দলের জন্য শেষ পর্যন্ত এই ব্যাপারটা আশীর্বাদও হয়ে আসতে পারে। কিন্তু কীভাবে?
তামিমকে নিয়ে যে নাটক হলো, সেটার বড় কারণ ছিল তামিমের ফিটনেস ও ফর্ম। ব্যাট হাতে গত কিছুদিন ধরেই সময়টা ভালো যাচ্ছে না তার। কোমর আর পিঠের ইনজুরিও ভোগাচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে। সর্বশেষ ৯ ইনিংসে মাত্র একটি ফিফটি তার। গত বছর চোটের জন্য মিস করেছেন ভারতের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ এবং বেশ কিছু টেস্ট। অবসর নেওয়ার দুই দিন আগে তামিম বলেছিলেন, তিনি শতভাগ ফিট নন। বিতর্কের শুরুটাও সেখান থেকেই।
অবসরের সিদ্ধান্ত তুলে নেওয়ার পরেই তামিম বলেছেন, সামনের দেড় মাস ফিটনেস নিয়ে কাজ করবেন। ডাক্তার দেখানোর জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যাচ্ছেন সামনেই। এশিয়া কাপের আগে এখনো মাস দেড়েকের মতো সময় হাতে আছে তার। বাংলাদেশের জন্য বড় সমস্যা হচ্ছে তামিম যদি ফিট না হয়ে ওঠেন, তাহলে তার বিকল্প কে হবেন?
তামিম না থাকায় আফগানিস্তান সিরিজের দুই ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়ে নাঈম শেখ কাজে লাগাতে পারেননি। দুই ম্যাচে তার স্কোর ৯, ০। এদিকে সৌম্য সরকার অনেক দিন ধরেই দলের বাইরে, রানেরও বাইরে বটে। এমার্জিং কাপে ভালো করলে হয়তো সুযোগ মিলতে পারে তার। এর বাইরে জাকির হাসান বা রনি তালুকদার এখনো ওয়ানডেতে নিজেদের প্রমাণ করতে পারেননি বা সুযোগ পাননি। বিশ্বকাপে মূল ওপেনার কে হবেন সেটা অনেক দূরের কথা। ব্যাকআপ ওপেনার হিসেবেই কে থাকবেন সেটাই বড় একটা দুশ্চিন্তার কারণ নির্বাচকদের জন্য।
পরিসংখ্যানও বলছে গত বিশ্বকাপের পর থেকে ওয়ানডেতে ওপেনিংয়ে নেমে তামিম-লিটন ছাড়া আর কেউই রান করতে পারেননি। নাজমুল হোসেন শান্ত তিন নম্বরে নেমে রান পেলেও ওপেনার হিসেবে তিনি ব্যর্থই।
২০১৯ বিশ্বকাপের পর বাংলাদেশের ওপেনারদের পারফরম্যান্স
ব্যাটার |
ম্যাচ |
রান |
স্ট্রাইকরেট |
গড় |
তামিম ইকবাল |
৪০ |
১৪৪২ |
৮১.৮৮ |
৪০.৫ |
লিটন দাস |
৩৬ |
১৩২৮ |
৮৮.৮৭ |
৪১.৫ |
আনামুল হক বিজয় |
৫ |
১২৯ |
৯৪.৮৫ |
২৫.৮ |
সৌম্য সরকার |
২ |
২৬ |
৭৪.২৮ |
১৩ |
নাঈম শেখ |
৩ |
১০ |
৩২.২৫ |
৩.৩৩ |
রনি তালুকদার |
১ |
৪ |
২৮.৫৭ |
৪ |
কিন্তু ব্যাটিংয়ের সাথে তামিমের অধিনায়কত্ব যোগ হওয়ায় পুরো ব্যাপারটি হয়ে গেছে আরও জটিল। ২০২১ সালে স্থায়ীভাবে ওয়ানডে অধিনায়কের দায়িত্ব পান তামিম। এরপর তার অধীনে বাংলাদেশ দক্ষিণ আফ্রিকার মাঠে গিয়ে ঐতিহাসিক সিরিজ জিতেছে। একটা সময় যিনি অধিনায়কত্ব উপভোগ করতেন না, গত কিছুদিনে তার এই জায়গায় উন্নতি চোখে পড়ার মতো। তার অধীনে ৩৭ ম্যাচের ১৪টিতে হারলেও ২১টিতেই জিতেছে বাংলাদেশ।
তবে এই জায়গায় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন রেখে দিয়েছেন তামিম। অবসরের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের পর জানিয়েছেন, তিনি অধিনায়কত্ব করবেন কিনা, সেটা নিয়ে কথা বলবেন আবার দলে ফেরার পর। অবশ্য তামিমের কাছের লোকজন তাকে অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে পুরোপুরি ব্যাটিংয়ে মন দিতে বলেছেন। বিসিবিকে দেওয়া তামিমের বার্তায়ও সেই আভাসই পাওয়া গেছে। তামিম যদি অধিনায়কত্ব ছেড়েই দেন, তাহলে সম্ভবত সাকিব আল হাসানের ওপরেই এসে পড়বে সেই দায়িত্ব। এমনটা হলে বাংলাদেশের তিন ফরম্যাটের অধিনায়কই হবেন সাকিব।
কিন্তু অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেওয়া তামিমের জন্য বড় একটা ঝুঁকি হতে পারে। অধিনায়ক না থাকলে দলে তিনি আর ‘অটোমেটিক চয়েস’ নন। পারফর্ম করতে না পারলেই প্রশ্ন উঠবে দলে জায়গা নিয়ে। আর তখন ফিটনেস ইস্যু সামনে আসলেও তামিমের অন্তর্ভূক্তি পড়ে যাবে প্রশ্নের মুখে। তবে তামিম অধিনায়ক থাকুন আর না থাকুন, বিশ্বকাপের আগে দলে ফেরাটা তার কারিয়ারের সবচেয়ে বড় ‘অ্যাসিড টেস্ট’। রান করতে না পারলে তুমুল সমালোচনা সইতে হবে তাকে। বিশ্বকাপে তার পারফরম্যান্স একদমই বলার মতো নয়। এজন্য তামিমকে নিয়ে হয়েছে প্রচুর সমালোচনা, সোশ্যাল মিডিয়ায় বয়ে গেছে ট্রলের স্রোত।
বিশ্বকাপে তামিম ইকবাল
ম্যাচ : ২৯
রান : ৭১৮
গড় : ২৪.৭৫
স্ট্রাইক রেট : ৭৩.১১
সেঞ্চুরি : ০
ফিফটি : ৪
তামিম সেই ঝুঁকিটা নেওয়ার জন্য অধিনায়কত্ব কি ছেড়ে দেবেন? যদি বিশ্বকাপেও ফিট আর ইনফর্ম তামিমকে দেখা যায় তাহলে সেই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জণ্য শাপেবরও হতে পারে।