গ্রীষ্মের দলবদলে কেমন করল প্রিমিয়ার লিগের 'শীর্ষ সাত'
এবারের গ্রীষ্মকালীন দলবদলে রেকর্ড ২.৪৪ বিলিয়ন পাউন্ড খরচ করেছে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো, যা ইউরোপের বাকি সব লিগের সম্মিলিত খরচের তুলনায় বেশি। এমনকি সৌদি লিগেরও তিনগুণ।
এই প্রতিবেদনে লিগের ‘শীর্ষ সাত’ দলের দলবদল কেমন গেল, তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরা হলো-
নিউক্যাসল
যারা এলেন: সান্দ্রো টোনালি, হার্ভি বার্নস, টিনো লিভ্রামেন্টো, লুয়িস হল।
যারা গেলেন: অ্যালান সেইন ম্যাক্সিমিন, ক্রিস উড।
রেলিগেশন লড়াই থেকে এক মৌসুমের মধ্যে শীর্ষ চারে জায়গা করে নিয়েছে নিউক্যাসল। এর পিছনে বড় ভূমিকা পালন করেছে ক্লাবের হিসেবি ও স্মার্ট সব দলবদল। গত মৌসুমের ধারা মেনে এবারও দলের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোয় নতুন সংযোজন এনেছে নিউক্যাসল। বিদায় নেওয়া সেইন ম্যাক্সিমিনের জায়গায় এসেছেন লেস্টারের হার্ভি বার্নস। মিডফিল্ডকে আরও সমৃদ্ধ করতে এসেছেন এসি মিলানের সান্দ্রো টোনালি। টোনালি-গিমারেস-জোয়েলিংটনের মিডফিল্ড বলতে গেলে লিগের সবচেয়ে হার্ড-ওয়ার্কিং মিডফিল্ড। দুই বয়স্ক ফুলব্যাক ড্যান বার্ন ও কিরেন ট্রিপিয়ারের ভবিষ্যৎ রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে এসেছেন দুই চেলসি গ্র্যাজুয়েট। লিভ্রামেন্টো ও লুয়িস হল, দুজনই চেলসিকে বর্ষসেরা একাডেমি খেলোয়াড়ের পদক জিতেছেন পূর্বে।
সব মিলিয়ে এই গ্রীষ্মের দলবদল নিউক্যাসলের একাদশকে আরও সমৃদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, প্রিমিয়ার লিগ; সপ্তাহে দুই টুর্নামেন্টে খেলার মতো ডেপথ এই স্কোয়াডে আছে কি না, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
তবে দলটা যেহেতু নিউক্যাসল, মৌসুম ঠিকমতো শুরু না হলে জানুয়ারিতে আরও কিছু বড়সড় দলবদল যে আসবে তা বলেই দেওয়া যায়।
রেটিং: ৭/১০।
ম্যান ইউনাইটেড
যারা এলেন: রাসমাস হইলান্ড, ম্যাসন মাউন্ট, আন্দ্রে ওনানা, সোফিয়ান আমরাবাত, সার্জিও রেগুইলন।
যারা গেলেন: অ্যান্থনি ইলাঙ্গা, অ্যালেক্স টেলেস, ডেভিড ডি হেয়া, ফ্রেড।
ডি হেয়ার চুক্তি নবায়ন না করে উইন্ডোর শুরুতে শিরোনামে আসা ইউনাইটেড শেষ পর্যন্ত একজন বল-প্লেয়িং গোলকিপারকে দলে ভিড়িয়েছে। আন্দ্রে ওনানার পর দলের নাম্বার নাইনের শূন্যতা পূরণ করতে এসেছেন আটালান্টা বিস্ময়-বালক রাসমাস হইলান্ড। অ্যাটাকিং মিডফিল্ডে গভীরতা যোগ করার জন্য এসেছেন ম্যাসন মাউন্ট, ডিফেন্সিভ মিডে কাসেমিরোর বিকল্প হিসেবে এসেছেন মরক্কান মিডফিল্ডার আমরাবাত।
প্রোফাইল অনুযায়ী এই দলবদলগুলো ইউনাইটেডের গত চার বছরের অন্যান্য সাইনিংগুলোর সাথে ভালোভাবেই যায়। কিন্তু সিভি ভালো থাকলেও ভ্যান ডি বিক, সাঞ্চো, অ্যান্টনির মতো বেশ কিছু সাইনিং তাদের ট্রান্সফার ফির প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। মাউন্ট, হইলান্ড, আমরাবাতদের নিয়েও সে সন্দেহ তাই থেকেই যাচ্ছে।
টেন হাগ দায়িত্ব নেওয়ার পর এক বছরে ৪০০ মিলিয়ন ইউরোর উপর খরচ করেছে ইউনাইটেড, ঢেলে সাজিয়েছে পুরো দল। কিন্তু এরপরও ম্যান সিটির সঙ্গে ব্যবধান খুব একটা কমাতে পারেনি তারা।
রেটিং: ৬/১০।
টটেনহাম হটস্পার
যারা এলেন: জেমস ম্যাডিসন, পেদ্রো পোরো, মিচি ভ্যান ড্যান ভেন, ব্রেনান জনসন, মানর সোলোমন।
যারা গেলেন: হ্যারি কেইন, হ্যারি উইংকস, লুকাস মউরা।
ক্লাবের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় কিংবদন্তি হ্যারি কেইন বিদায় নিয়েছেন এবার। দলের শীর্ষ স্কোরারকে রিপ্লেস করতে কোনো স্ট্রাইকারও কেনেনি স্পার্স। গ্রীষ্মের শুরুতে ডাক উঠেছিল চেয়ারম্যান ড্যানিয়েল লেভির পদত্যাগেরও। কিন্তু এই হতাশা ও বিষণ্ণতার মাঝে হটস্পার স্টেডিয়ামে আশার আলো নিয়ে এসেছেন নতুন ম্যানেজার অ্যাঞ্জ পস্তেকগলু। এই অজি কোচের পরামর্শে এবার নয়টি লো-কি সাইনিং করেছে স্পার্স। ম্যাডিসন, ভ্যান ড্যান ভেন, মানর সোলোমনের মতো সিংহভাগ সাইনিং ইতোমধ্যে মানিয়ে নিয়েছেন দলে। আর নাম্বার নাইন হিসেবে শুরুর কয়েক ম্যাচ রিচার্লিসনকে খেলানোর পর দলের আক্রমণভাগের নেতৃত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে সন হিউয়েঙ মিনের উপর। নাইন হিসেবে প্রথম ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করেছেন এই কোরিয়ান।
চার ম্যাচে ১০ পয়েন্ট, এরকম দুর্দান্ত শুরুই ইঙ্গিত করছে এ মৌসুমে হয়তো হ্যারি কেইনকে মিস করবে না স্পার্স। হয়তো নতুন এক স্পার্সের জন্ম দিবেন পস্তেকগলু।
রেটিং: ৭/১০।
আর্সেনাল
যারা এলেন: ডেকান রাইস, কাই হ্যাভার্জ, ইউরিয়েন টিম্বার, ডেভিড রায়া।
যারা গেলেন: গ্রানিত শাকা, ম্যাট টার্নার, ফ্লোরিয়ান বালোগান।
গত মৌসুমে শিরোপা লড়াইয়ে থাকার পর এবারও দলে বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে আর্সেনাল। এবার ব্রিটিশ রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে ডেকান রাইসকে (১১৬ মিলিয়ন ইউরো) কেনার পর ৭৫ মিলিয়ন ইউরোয় চেলসির কাই হ্যাভার্জকে দলে ভেড়ায় তারা। সেন্টার-ব্যাক পজিশনে গভীরতা যোগ করতে আসেন আয়াক্সের ইউরিয়েন টিম্বার (৪০ মিলিয়ন ইউরো)। এই নিয়ে গত তিন মৌসুমে ৬০০ মিলিয়ন ইউরোর মতো খরচ করে দল গুছিয়েছেন মিকেল আরতেতা। লক্ষ্য একটাই, লিগ শিরোপা।
রাইসের অন্তর্ভুক্তি নিসন্দেহে আর্সেনাল মিডফিল্ডে আরও সক্রিয় করবে। তবে মিডফিল্ডে শাকার জায়গা নেওয়া হ্যাভার্জের প্রাথমিক ফর্ম ও ইউরিয়েন টিম্বারের দীর্ঘ ইনজুরির পর প্রশ্ন থাকছে, গত মৌসুমের চেয়ে কি আসলেই বেশি শক্তিশালী দল নিয়ে নেমেছে আর্সেনাল?
রেটিং: ৬/১০।
চেলসি
যারা এলেন: মইসেস কাইসেডো, ক্রিশ্চোফার উঙ্কুঙ্কু, অ্যালেক্স দিসাসি, নিকোলাস জ্যাকসন, লেসলি উগোচুকো, রবার্ট সানচেজ, অ্যাঙ্গেলো।
যারা গেলেন: কাই হ্যাভার্জ, ম্যাসন মাউন্ট, মাতেও কোভাচিচ, কালিদু কুলিবালি, ক্রিশ্চিয়ান পুলিসিক, এডওয়ার্ড মেন্ডি, এনগোলো কান্তে, সিজার আজপিলিকুয়েতা, রুবেন লফটাস-চিক।
গত মৌসুমের ধারা মেনে এবারও ভুরি ভুরি দলবদল করেছে চেলসি। টড বোয়েহলি ক্লাবে আসার পর তিন উইন্ডোতে তাদের দলবদলের খরচ ১ বিলিয়ন ইউরো ছাড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাদের স্কাউটিং নীতি অনুযায়ী সব ইউরোপজুড়ে থাকা সব তরুণ প্রতিভাদেরই দলে ভিড়িয়েছে চেলসি। নতুন ম্যানেজার মরিসিও পচেত্তিনোও তার দীর্ঘ স্কোয়াড থেকে একটি একাদশ গুছিয়ে এনেছেন। তবে সমস্যা হচ্ছে, দলে আগাগোড়া পরিবর্তন আনায় প্রতিদ্বন্দ্বিতার মেজাজ অনেকটা হারিয়ে বসেছে ক্লাবটি। বর্তমানে চেলসির সবচেয়ে পুরনো খেলোয়াড় হচ্ছেন ২৩ বছর বয়সী রিস জেমস। সুতরাং বুঝাই যাচ্ছে, দলে অভিজ্ঞতার অভাব স্পষ্ট। এই অনভিজ্ঞ দল নিয়ে শীর্ষ পর্যায়ে লড়াই করতে আরও এক-দুই মৌসুম অন্তত লাগবে পচেত্তিনোর।
রেটিং: ১২/১০ (?)
লিভারপুল
যারা এলেন: অ্যালেক্সিস ম্যাক আলিস্টার, ডমিনিক শবজলাই, ওয়াটারু এন্ডো, রায়ান গ্রাভেনবার্খ।
যারা গেলেন: রবার্তো ফিরমিনো, জর্ডান হেন্ডারসন, ফাবিনহো, জেমস মিলনার, নাবি কেইটা, অ্যালেক্স অক্সালেড চ্যাম্বারলিন, ফাবিও কারভালিও।
২০২২-২৩ মৌসুমের মাঝখানেই সবাই বুঝতে পেরেছিল লিভারপুলের স্কোয়াডে বড়সড় পরিবর্তন প্রয়োজন, বিশেষ করে মিডফিল্ডে। ম্যানেজার ইয়ুর্গেন ক্লপও মিডফিল্ড রিবিল্ডের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছেন ফেব্রুয়ারি মাস থেকেই। সেই কথা রেখে এই গ্রীষ্মে তাদের মিডফিল্ড পুরোপুরি পরিবর্তন করেছে লিভারপুল। দলের সকল সিনিয়র মিডফিল্ডারকে বিদায় দিয়ে মিডফিল্ডারদের নতুন সেট কিনেছে তারা। আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী সেন্টার-মিড অ্যালেক্সিস ম্যাক-আলিস্টারের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন হাঙ্গেরিয়ান প্রতিভা ডমিনিক শবজলাই। অনেক নাটক শেষে কাইসেডো, লাভিয়া কাউকে না পেলেও একজন স্টুটগার্ড থেকে একজন অভিজ্ঞ ডিফেন্সিভ মিড আনতে সক্ষম হয়েছে ক্লাবটি। মিডফিল্ডে বাড়তি গভীরতা দিতে এসেছেন আয়াক্সের সাবেক বিস্ময়-বালক গ্রাভেনবার্খ।
ফাবিনহোর মতো ট্যাকটিকালি জুতসই কোনো নাম্বার সিক্স এখন দলে না থাকলেও শুরুর কয়েক ম্যাচ বলছে, প্রপার নাম্বার সিক্স ছাড়াও যথেষ্ট শক্তিশালী লিভারপুল। ম্যাক আলিস্টার-শবজলাই ইতোমধ্যে মানিয়ে নিয়েছেন। জোন্স, এলিয়ট, গ্রাভেনবার্খের মতো অন্য তরুণ মিডফিল্ডাররাও লড়াই করবেন একাদশে জায়গার জন্য।
মিডফিল্ড রিবিল্ড ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে অলরেডরা। কিন্তু রক্ষণে গভীরতার অভাব, বিশেষ করে সেন্টার-ব্যাক পজিশনে, এবং একজন প্রপার নাম্বার সিক্সের অভাব মৌসুমের এক পর্যায়ে এসেছে ভোগাতে পারে তাদের। রেটিং: ৭/১০।
ম্যান সিটি
যারা এলেন: জস্কো ভার্দিওল, মাতেও কোভাচিচ, জেরেমি ডকু, ম্যাথিয়াস নুনেস।
যারা গেলেন: রিয়াদ মাহরেজ, ইলকাই গুন্দোগান।
ট্রেবল জেতার সুখস্মৃতি ও ১১৫ অভিযোগের দুঃস্মৃতি নিয়ে এই গ্রীষ্মে আরও ২৪০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করেছে ম্যান সিটি। শিরোপা জিতে গেলেও প্রতি মৌসুমে দল ‘রিফ্রেশ’ করার ধারায় এবার বিশ্ব রেকর্ড ফিতে দলে ভিড়িয়েছে ডিফেন্ডার জস্কো ভার্দিওলকে (৯০ মিলিয়ন ইউরো)। বিদায় নেওয়া রিয়াদ মাহরেজের জায়গায় জেরেমি ডকু ও বিদায়ী অধিনায়ক ইলকায় গুন্ডোগানের জায়গায় এসেছেন দুজন মিডফিল্ডার- মাতেও কোভাচিচ, ম্যাথিয়াস নুনেস।
সেন্টার-ব্যাক নির্ভর সিটির নতুন ফরমেশনে ভার্দিওল বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। বাকি সাইনিংরা হয়তো একাদশে জায়গা করে নিতে কিছুটা সময় নিবেন। সব মিলিয়ে, ট্রেবলজয়ী সিটি স্কোয়াডে যথার্থ মূল্যই যোগ করবেন এবারের সাইনিংরা।
রেটিং: ৮/১০।