ভারতের না হয়েও বিশ্বকাপে খেলছেন যে ভারতীয়রা
রাচিন রবীন্দ্র, ইশ সোধি, কেশভ মহারাজ, বিক্রমজিৎ সিং, তেজা নিদামানুরু, আরিয়ান দত্ত; বিশ্বকাপে আসা এই ছয় ক্রিকেটারের মধ্যে একটি মিল আছে। নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নেদারল্যান্ডসের মতো দলের সঙ্গে ভারতে আসলেও এই ছয়জনই ভারতীয় বংশোদ্ভূত। সোধি, বিক্রমজিৎ ও নিদামানুরু জন্মসূত্রেই ভারতীয়।
তেজা নিদামানুরু
নিদামানারুর জন্ম অন্ধ্র প্রদেশ। যেটি ভারতের দরিদ্রতম প্রদেশগুলোর একটি। সেখান থেকে ভাগ্যের খুঁজেই নিউজিল্যান্ডে পাড়ি দিয়েছিল তার পরিবার। তখন তেজার বয়স মাত্র ছয়। পরিবার বলতে শুধু তার মা। স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে অকল্যান্ডে একটি চাকরি পেয়েছিলেন তিনি। সেই চাকরিও টেকেনি বেশিদিন। ১০ বছর পরই আবার দেশে ফিরে আসতে হয় তার।
১৬ বছর বয়স থেকেই নিজের দেখভাল নিজে করে আসছেন তেজা। অকল্যান্ডে পার্ট টাইম কাজ করে নিজের খরচ জুগিয়েছেন। চালিয়ে গেছেন পড়াশোনাও। তবে ভারত থেকে বয়ে আনা ক্রিকেটের নেশা কখনো ছাড়েনি তাকে।
২০১৮ সালে অকল্যান্ডের হয়ে লিস্ট এ ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। কিন্তু তার পারফরম্যান্স ঘরোয়া ক্রিকেটের পেশাদার চুক্তি পাওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই জীবিকার টানে ঝুঁকেন অন্যত্র।
২০১৯ সালে নেদারল্যান্ডসের এক ক্রিকেট ক্লাব ছয় মাসের চুক্তিতে তাকে খেলোয়াড়-কোচ হিসেবে আনে। ছয় মাস পর যখন নিউজিল্যান্ডে ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ করে এক চাকরির অফার পেয়ে বসেন।
এখানে বলে রাখা ভালো, ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি স্পোর্টস ম্যানেজমেন্ট ও মার্কেটিংয়ে দুটি ড্রিগ্রিও আছে তেজাঁর। হল্যান্ডে খেলার সময় এক প্রতিপক্ষ ক্রিকেটারের সঙ্গে আড্ডাচ্ছলে এই কথা জানিয়েছিলেন তিনি। সেই অ্যামেচার ক্রিকেটার আবার একটি কোম্পানির সিইও। তার ফোন পেয়েই আবার নেদারল্যান্ডস ফিরে যান তেজা, এবার ওয়ার্ক-ভিসায়।
এই চাকরির জন্যই পরে নেদারল্যান্ডস দলে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা পান নিদামানুরু। গতবছর মে মাসে নেদারল্যান্ডসের হয়ে অভিষেক হয় তার। অভিষেক ম্যাচেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে করেন হাফ-সেঞ্চুরি।
বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে তার ৭৬ বলে ১১১ রানের ঝড়ো এক ইনিংসের জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাতে পারে ডাচরা।
ক্রিকেটার হিসেবে এই প্রথম ভারতে ফিরেছেন তেজাঁ। একেবারে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ আসরে খেলতে জন্মভূমিতে ফেরত আসা, এই অভিজ্ঞতাকে ‘পরবাস্তব’ বলেই বর্ণনা করেছেন নিদামানারু।
বিক্রমজিৎ সিং
আরেক নেদারল্যান্ডস তারকা, বিক্রমজিৎ সিংয়ের জন্মও ভারতে। ভারতে চুরাশির শিখ হত্যাযজ্ঞের সময় পাঞ্জাব ছেড়ে অ্যামস্টারডামে পাড়ি দিয়েছিল তার পরিবার। যদিও এরপর বহুবার ভারতে এসেছেন তারা। এরকম আসা-যাওয়ার মাঝেই বিক্রমজিতের জন্ম।
অ্যামস্টারডামে বেড়ে উঠা বিক্রমজিতের ক্রিকেট প্রতিভা প্রথম চোখে পড়ে তৎকালীন ডাচ অধিনায়ক পিটার বোরেনের। বিক্রমজিতকে ১১ বছর বয়সেই অ্যামস্টারডামের ক্লাব ক্রিকেটে খেলার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন তিনি। এরপর চন্ডীগড়ের এক ক্রিকেট একাডেমিতেও অনেকদিন অনুশীলন করেন তিনি।
১৫ বছর বয়সে নেদারল্যান্ডস এ-র হয়ে অভিষেক হয় বিক্রমের। ১৬ বছর বয়সে অভিষেক হয় আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে। গতবছর ওয়ানডেতে অভিষক করেন। এবারের বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারে দলের হয়ে সর্বোচ্চ রান ছিল তারই। নেদারল্যান্ডসের হয়ে দীর্ঘ ক্যারিয়ারই হয়তো অপেক্ষা করছে এই ২০ বছর বয়সীর।
আরিয়ান দত্ত
আরেক ডাচ ক্রিকেটার আরিয়ান দত্তের শেকড়ও পাঞ্জাবে। তার পরিবারও দেশ ছেড়েছিল আশির দশকের শিখ-বিরোধী আন্দোলনের সময়। ২০০৩ সালে জন্মানো আরিয়ান ভারতে খুব একটা না থাকলেও তার ক্রিকেট অনুপ্রেরণা আসে এখান থেকেই। ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতের জয় দেখে প্রথম ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন সাত বছর বয়সী আরিয়ান।
পরে বিক্রমজিতের মতোই পারিবারিক সূত্রে চন্ডিগড় এসে কিছুদিন চালিয়েছিলেন ক্রিকেট অনুশীলন। ছোট বয়সেই হল্যান্ডের ভরবার্গ ক্রিকেট ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামে জায়গা পাওয়া অফ-স্পিনার জাতীয় দলেও ডাক পেয়েছেন টিএনেজার থাকা-অবস্থাতেই। এ বিশ্বকাপেও দলে নিয়মিতদের একজন ২০ বছর বয়সী আরিয়ান।
ইশ সোধি
পাঞ্জাবে জন্মানো আরেক ক্রিকেটার ইশ সোধি একদম ছোটবেলায় পরিবারের সঙ্গে পাড়ি দিয়েছিলেন নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে। অনেকটা তেজা নিদামানুরুর মতোই। তার পূর্ব-পুরুষেরা ছিলেন লাহোরের অধিবাসী, দেশভাগের পর এসেছিলেন ভারতের পাঞ্জাবে।
১৯ বছর বয়সে নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে অভিষেক হওয়া এই লেগ স্পিনারকে এক বছরের মধ্যেই জাতীয় দলে ডাকে কিউয়িরা। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় তার।
ভারতীয় শেকর ও ন্যাচারাল স্পিন বোলিংয়ের জন্য ক্যারিয়ারের প্রথম কয়েক বছর সোধিকে নিউজিল্যান্ড দলে রাখা হয়েছে উপ-মহাদেশে হওয়া সিরিজগুলোতেই।
রাচিন রবীন্দ্র
সোধির নিউজিল্যান্ড সতীর্থ রাচিন রবীন্দ্রের শেকড়ও ভারতে। তার বাবা ছিলেন বড়সড় ক্রিকেট-ভক্ত। রাহুল দ্রাবিড় ও শচীন টেন্ডুলকার, দুই ভারতীয় কিংবদন্তির নামের সন্ধি করে রেখেছিলেন ছেলের নাম।
বাবার ক্রিকেট-মগ্নতা ছড়িয়েছে ছেলের মাঝেও। অনুর্ধ্ব ১৯ থেকেই নিউজিল্যান্ডের হয়ে খেলে আসা এই প্রডিজির ক্রিকেট যাত্রায় ভারত জড়িয়ে আছে আরও একটি কারণে।
বাবার সুবাদে ২০১৩ সাল থেকে প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট সময় বেঙ্গালুরুর একটি ক্রিকেট ক্লাবে অনুশীলন করেছেন রাচিন। স্পিনে বিপক্ষে হাত পাকা করতে। স্পিনের বিপক্ষে তার এই স্কিলসেট ও তাকে নিয়ে কিউয়িদের দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা এবার ভালোই ফল পাচ্ছে ভারত বিশ্বকাপে।