বোলিং ব্যর্থতা নাকি অধিনায়কত্ব : কোথায় ভুল হলো পাকিস্তানের?
টানা দুই জয়ে বিশ্বকাপটা দারুণভাবে শুরু করেছিল পাকিস্তান। কিন্তু পরপর তিন পরাজয়ে শুরুর সেই ছন্দ হারিয়ে গেছে তাদের। সর্বশেষ আফগানদের বিপক্ষে হারে প্রশ্ন উঠে গেছে সেমিফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা নিয়ে। অধিনায়ক বাবর আজম ওয়ানডের শীর্ষ ব্যাটার। পেস অ্যাটাককে বলা হচ্ছিল বিশ্বমানের। তবুও বিশ্বকাপে এর প্রতিফলন নেই। কী এমন ভুল হলো পাকিস্তানের? এই ব্যর্থতার কারণই বা কী?
এশিয়া কাপে পাওয়া চোটে নাসিম শাহ নেই বিশ্বকাপে। পেস অ্যাটাকে তাই বাড়তি দায়িত্ব শাহীন শাহ আফ্রিদি-হারিস রউফের।আফ্রিদি নিজের কাজটা ঠিকঠাকই করেছেন এখন পর্যন্ত। কিন্তু অন্যপাশ থেকে সহায়তার অভাবে সেভাবে ইম্প্যাক্ট রাখতে পারছেন না তিনি, যেটা করার কথা ছিল হারিস রউফের।
আফগানিস্তান ম্যাচের কথাই বলা যাক। ফার্স্ট চেঞ্জ হিসেবে হারিস বোলিংয়ে আসেন অষ্টম ওভারে। দিয়ে বসেন ১৭ রান। এর আগে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচেও পাওয়ারপপ্লেতে সেকেন্ড চেঞ্জ হিসেবে বোলিংয়ে এসে দেন ২৪ রান।শুরুতেই ব্যাটিং ঝড়ের মুখে পড়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন হারিস। ৮ উইকেট পেয়েছেন এখন পর্যন্ত, কিন্ত ওভারপ্রতি প্রায় ৭ রান করে দিয়েছেন।
হারিসের রান লিক করা স্পেলগুলো বাড়তি চাপ ফেলছে আফ্রিদির ওপর। আফগান ম্যাচে ২২-তম ওভারে তাই বাধ্য হয়েই বাবর আজম আক্রমণে এনেছিলেন আফ্রিদিকে। এসেছিল প্রথম ব্রেক থ্রুওও। এক ম্যাচ আগে অস্ট্রেলিয়ার রানের চাকাও টেনে ধরেছিলেন সেই আফ্রিদি। হারিস ওভারপ্রতি দশের বেশি রান দিয়েছিলেন সেই ম্যাচে।
হারিসের এমন দেদারসে রান বিলানো দেখে অনেকেই তার গেইম এওয়ারনেস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজের প্ল্যানেও পরিবর্তন আনছেন না। ওয়াসিম আকরাম বলেছেন, কেবল গতি দিয়ে ওয়ানডে টিকে থাকাটা কঠিন হবে হারিসের জন্য। ঘরোয়া ক্রিকেটে আরো পারফর্ম করে আসাটাই তার জন্য ভালো বলে মনে করেন ওয়াসিম। আরেক পেসার হাসান আলী শ্রীলংকার বিপক্ষে চার উইকেট পেলেও শেষ তিন ম্যাচে ২৪ ওভার বল করে নিয়েছেন মাত্র দুই উইকেট। নতুন বলে আফ্রিদিকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য সেটা একেবারেই অপ্রতুল।
স্পিন নিয়েও বেশ ভুগছে পাকিস্তান। শেষ পাঁচ ম্যাচে পাকিস্তানের চার স্পিনার মিলে নিয়েছেন মাত্র উইকেট। চলতি বিশ্বকাপে কমপক্ষে এক উইকেট নেয়া স্পিনারদের মধ্যে এই তিনজনের বোলিং স্ট্রাইকরেটই সবচেয়ে খারাপ। অবশ্য ২০২২ সাল থেকেই পিছিয়ে আছে পাকিস্তানি স্পিনাররা। ওয়ানডে খেলুড়ে ২২টি দলের মধ্যে ১৭-তম ছিল পাকিস্তানি স্পিনারদের সম্মিলিত স্ট্রাইকরেট ৪৮.৬।
পাকিস্তানের গ্রাউন্ড ফিল্ডিংও আছে ব্যর্থতার নেপথ্যে। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ডেভিড ওয়ার্নারের ক্যাচ ফেলে দেন উসামা মীর। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ১৬২ রানের ইনিংস খেলেন ওয়ার্নার। এমনকি আফগানিস্তান ম্যাচেও পাকিস্তানি ফিল্ডাররা বাউন্ডারি লাইনে গড়বড় করেছেন হ্নিসেবে। পাকিস্তানের ব্যাটিং এপ্রোচও প্রশ্নবিদ্ধ। বিশ্বকাপে অন্যান্য দলগুলো যেখানে প্রথম পাওয়ারপ্লেকে টার্গেট করছে রান তোলার জন্য। পাকিস্তান সেখানেই পিছিয়ে আছে। এবারের বিশ্বকাপে প্রথম পাওয়ারপ্লেতে ২৫০ রান তোলা দলগুলোর মধ্যে পাকিস্তানের ব্যাটিং গড়ই সবচেয়ে কম। পাওয়ারপ্লেতে এই বছর নিজেরদের প্রথম ছক্কা পাকিস্তান মেরেছে সেদিন আফগানদের বিপক্ষে। আবদুল্লাহ শফিকের ব্যাটেই এসেছে ১১৬৯ বল পাওয়ারপ্লের প্রথম ছক্কা।
ব্যাটিংয়ে শুরুটা দেখেশুনেই করছে পাকিস্তান। এরপর বাবর-রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে থাকতে হচ্ছে তাদের। এই দুজনের কেউ ব্যর্থ হলেই মিড ওভারে খেলা ঘুরে যাচ্ছে প্রতিপক্ষের দিকে। শাদাব খান সেভাবে ব্যাট হাতে বলার মতো কিছু করতে পারছেন না। ডেথ ওভারের ব্যাটিংয়ে ভরসা কেবল ইফতিখার আহমেদ। পাকিস্তানের ব্যাটিং অর্ডার তাই এক প্রকার এক্সপোজডই বলা চলে প্রতিপক্ষের কাছে
অধিনায়কত্ব নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছেন বাবর আজম। ফিল্ড প্লেসিংয়ের জন্য বোলারদের ব্যর্থতার দায়টাও তাকে দিচ্ছেন অনেকেই। ডানহাতি মিচেল মার্শের বিপক্ষে উসামা মীর মিড ওভারে বল করেছেন অন সাইডে পাঁচজন ফিল্ডার নিয়ে। কিন্ত কোনো গুগলি তাকে করতে দেখা যায়নি। মিচেল মার্শ উইকেটের স্কয়ার রিজিওনে শট খেলতে পছন্দ করেন, এমনটা জানা সত্ত্বেও হাসান আলী স্কয়ার লেগ রেখেছিলেন সার্কেলের ভেতরে। থার্ডম্যানে ফিল্ডার সেট করেছিলেন আউটসাইড এজ বা আপার কাটের কথা ভেবে। বাবর-হাসানের সেই পরিকল্পনা কাজে আসেনি।
মিড অন-মিড অফ সার্কেলের ভেতর আর থার্ড ম্যান বাউন্ডারিতে রেখে লেংথ বল করেছেন পেসাররা। দেখা যায়নি টানা বাউন্সারও। সেই ম্যাচে দুই অজি সেঞ্চুরিয়ান মিচেল মার্শ-ডেভিড ওয়ার্নারের ওয়াগন হুইল বলে দিচ্ছে মাঝের ওভারগুলোতে এমন ফিল্ড প্লেসিংয়ের ফায়দা নিয়েছেন। তাই প্রশ্ন উঠছে বাবর কতটা ভালো ট্যাকটিশিয়ান?
টানা তিন হারে এখন পয়েন্ট টেবিলের পঞ্চম স্থানে পাকিস্তান। সেমিফাইনাল খেলতে চাইলে পা হড়কানো চলবে না একদমই। তবে মাঠের খেলায় ফল আনতে চাইলে হাতে গোনা কজন ক্রিকেটারের ওপর থেকে কমাতে হবে অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা। বিশ্বকাপে পাকিস্তানের প্রায় প্রতি ম্যাচেই দেখা গেছে এমন চিত্র। অধিনায়ক হিসেবে বাবর আজমের জন্য বিশ্বকাপের বাকিটা হয়ে গেছে অগ্নিপরীক্ষা। ব্যাট হাতে পারফর্ম করার চাপ তো আছেই, সাথে আছে দলকে শেষ চারে নিয়ে যাওয়ার আকাশ-সম চাপও।