ট্রাভিস হেড : ফিঞ্চের যোগ্য উত্তরসূরি?
বিশ্বকাপ দল থেকে তাকে চাইলেই বাদ দিতে পারত অস্ট্রেলিয়া। বিশ্বকাপ শুরুর ঠিক আগে যখন ছয় সপ্তাহের জন্য মাঠের বাইরে চলে যেতে হলো, ট্রাভিস হেডের বিশ্বকাপ স্বপ্ন শেষই হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু চোটের পরও হেডকে রেখে দিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া।আসরের প্রথম দুই ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়া হেরে যাওয়ার পর তো মনে হচ্ছিল, হেড সুস্থ হওয়ার আগেই তার দল বিদায় নেয় কি না! কিন্তু পরের সব ম্যাচ জিতে যেমন বিশ্বকাপে ফিরে এসেছে অস্ট্রেলিয়া, তেমনি প্রায় দেড় মাস পর নিজের প্রত্যাবর্তনের দিনে সেঞ্চুরি করে হেডও দেখিয়ে দিয়েছেন, কেন তার জন্য অপেক্ষা করেছে অজিরা।
২৯ বছর বয়সী হেডের জন্ম অ্যাডেলেডে। সেখানেই বেড়ে ওঠা, এবং সেখানেই ঘরোয়া ক্রিকেটের হাতেখড়ি। ২০১৬ সালে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে অভিষেক হলেও তখন ঠিক নজর কাড়তে পারেননি। দীর্ঘদিন বাইরে থাকার পর ২০২২ সালে আবার ওয়ানডে দলে ডাক পান তিনি। ফেরার পর পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচেই করেন সেঞ্চুরি। পরের ম্যাচে করেন ৮৯।
এখানে বলে রাখা ভালো, ক্যারিয়ারের শুরুতে মিডল অর্ডারেই বেশি ব্যাটিং করেছেন হেড। ২০২২ সালে অ্যারন ফিঞ্চ অবসর নেওয়ার পর তাকে নিয়মিত ওপেনার হিসেবে খেলাতে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া। ফেরার পর এখন পর্যন্ত ১৭ ইনিংসে ৬৪ গড়ে মোট ৯০০ রান করেছেন হেড। এই সময়ে দলে তার চেয়ে বেশি রান করেছেন মাত্র দুজন। কিন্তু তাদের চেয়ে ম্যাচ কম খেলেছেন হেড। তার ব্যাটিং গড়ের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, কেন ইনজুরড হেডকেও বিশ্বকাপের দলে রেখেছিল অস্ট্রেলিয়া।
হেডের ইনজুরির রিহ্যাব যে ঠিকমতো হবে, কোনো ঝামেলার জন্য দীর্ঘায়িত হবে না, সে ব্যাপারেও নিশ্চিত ছিল না অস্ট্রেলিয়া। এই ঝুঁকির কথা স্বীকারও করেছেন প্রধান নির্বাচক জর্জ বেইলি, 'ইনজুরি রিহ্যাবে কোনো বিপত্তি দেখা দিলে ট্রাভিসের জন্য ফিরে আসাটা খুবই কঠিন হবে। এই ঝুঁকি সম্বন্ধে অবগত আছি আমরা।'
সেজন্যই হয়তো দলের একমাত্র স্পেশালিস্ট অফ-স্পিনার অ্যাস্টন অ্যাগারকে বাদ দিয়ে আরেকজন স্পেশালিস্ট ব্যাটারকে জায়গা দিয়েছে অজিরা। শেষ মুহূর্তে অ্যাস্টন অ্যাগারের জায়গায় অস্ট্রেলিয়া দলে আসেন মারনাস লাবুশেন।
তবে হেডের ব্যাটিং সক্ষমতা নিয়ে কতটা আত্মবিশ্বাস অস্ট্রেলিয়ার, সেটা বোঝা যায় বেইলির এই কথাতেই, 'সে আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। প্রথম একাদশে সে থাকবেই। যে কারণে টুর্নামেন্টের শেষদিকে যদি সে ফেরে, তা আমাদেরকে খুবই সাহায্য করবে।'
প্রত্যাবর্তনটা কিন্তু মোটেই সহজ ছিল না। নেদারল্যান্ডস ম্যাচের আগে প্রথম অনুশীলনে ফিরেছেন। কিন্তু তখনো হাত ঠিকমতো না সারায় সেই ম্যাচে আর ঝুঁকি নেয়নি অস্ট্রেলিয়া। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে নামেননি। ডাক্তাররা জানিয়েছিল, ৭৫ শতাংশ সেরেছে হাত। এমনকি নিউজিল্যান্ড ম্যাচেও খেলেছেন সেই ৭৫% সুস্থ থাকা হাত নিয়েই।
কিন্তু গ্রুপ পর্ব অর্ধেক শেষ। শেষাংশে তর্কসাপেক্ষে তাদের সবচেয়ে বড় ম্যাচ কিউইদের বিপক্ষেই। এই ম্যাচের ফলাফলের উপর অস্ট্রেলিয়ার সেমিফাইনাল-ভাগ্য অনেক বেশি নির্ভর করছিল। সে কারণেই ষষ্ঠ ম্যাচে এসে হাতে লুকানো ট্রাম্প কার্ডটা খেলে অজিরা। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে নেটে মাত্র ২০ মিনিট অনুশীলন করেছেন হেড। সেখানেও যে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাটিং করেছেন, তা না।
তবে মাঠে নামার সঙ্গে সঙ্গেই যেন বদলে যায় সব। সেন্ট্রাল উইকেটে প্রথম বল থেকেই তার ব্যাট আসতে শুরু করে শটের ফুলঝুরি। শুরুতেই দুটি নো বল করেছিলেন ম্যাট হেনরি। সেই দুই ফ্রি-হিট মাঠছাড়া করেই যেন হেড আত্মবিশ্বাস ফিরে পান।এরপর ওয়ার্নারকে সাথে নিয়ে প্রথম ১০ ওভারে তুলেন ১১৮, যা প্রথম পাওয়ার প্লেতে টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ। ৫৯ বলে সেঞ্চুরি করে পরে ম্যাচসেরার পদকও পেয়েছেন এই ওপেনার।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এটি ছিল হেডের বিশ্বকাপ অভিষেক। তেমন প্রস্তুতি ছাড়া সরাসরি ওপেনিংয়ে ব্যাট করতে নেমে এমন পারফরম্যান্স। অবাক হয়েছেন হেড নিজেও, 'গত কয়েক দিনে যেমন ব্যাটিং করেছি, সেই বিচারে অবাক করার মতোই। নেটে মাত্র কয়েকটা শট খেলতে পেরেছি। কিন্তু ট্রেনিং উইকেট থেকে ম্যাচের উইকেট অনেক আলাদা।'
হেডের পারফরম্যান্সে বেশ সন্তুষ্ট তার কোচ-অধিনায়কও। বিশেষ করে ওয়ার্নারের সঙ্গে তার বোঝাপড়ায়। ম্যাচের পর প্যাট কামিন্স বললেন, তারা এভাবেই খেলতে চান, 'ওপেনিং জুটির ব্যাটিং বেশ ভালো লেগেছে, বিশেষ করে ট্রাভিসের। আমরা এভাবেই আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে চাই, আর তারা (ওয়ার্নার-হেড) সামনে থেকে নেতৃত্ব দেবে।'
ব্যাটিং কোচ মিচেল ডি ভেনুটু বললেন, ম্যাচের আগে আসলে তেমন প্র্যাকটিস করার দরকার পড়ে না হেডের। হাত ঠিক আছে কি না, সেটা নিশ্চিত করতেই সামান্য অনুশীলন করেছিলেন হেড, 'আমরা জানতাম ম্যাচের আগে তার এতো অনুশীলন করার দরকার নেই। তার ব্যাটিং নাচারাল। তার হাত ঠিক আছে কি না, সেটা নিশ্চিত করা ছিল আমাদের দায়িত্ব।'
কোচ-ক্যাপ্টেনের কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস শুনেই বুঝতে পারছেন, অন্তত তারা বিশ্বাস করে, দল ঘোষণার সময় যেই ঝুঁকি নিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, তা ষোল আনাই সফল হয়েছে।