ম্যাক্সওয়েলের মরণ কামড়ে ঘায়েল আফগানিস্তান
২০২৩ বিশ্বকাপ, গ্রুপ পর্ব, অস্ট্রেলিয়া-আফগানিস্তান (টস-আফগানিস্তান/ব্যাটিং)
আফগানিস্তান - ২৯১/৫, ৫০ ওভার (ইব্রাহিম ১২৯*, রশিদ ৩৫*, রহমত ৩০, হেজলউড ২/৩৯, ম্যাক্সওয়েল ১/৫৫, জাম্পা ১/৫৮)
অস্ট্রেলিয়া - ২৯৩/৭, ৪৬.৪ ওভার (ম্যাক্সওয়েল ২০১*, মার্শ ২৪, ওয়ার্নার ১৮, রশিদ ২/৪৪, নাভিন ২/৪৭, ওমরযাই ২/৫৭)
ফলাফল - অস্ট্রেলিয়া ৩ উইকেটে জয়ী
১৮.৩ ওভারের মাথায় নিশ্চয় অনেকেই টিভি বন্ধ করে, মাঠ ছেড়ে অন্য কাজে লেগে পড়েছিলেন। গ্লেন ম্যাক্সওয়েল হয়ত সেই সমর্থকদের জীবন ভর আক্ষেপ করার উপলক্ষ গড়ে দিলেন, সেই সাথে আফগানদের জন্য হয়ে এলেন দুঃস্বপ্নের ভয়ংকরতম দৈত্য-দানব হয়ে। বিশ্বকাপ ইতিহাসে রান তাড়ায় সর্বসেরা ইনিংসটাই হয়ত খেললেন ম্যাক্সওয়েল। সেঞ্চুরির বহু আগে থেকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রায় এক পায়ে খেলেই প্রথম নন-ওপেনার হিসেবে ডাবল সেঞ্চুরি করে অবিশ্বাস্য জয়ে অস্ট্রেলিয়াকে তুললেন সেমিতে।
২৯২ রানের লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা হয়েছিল ভয়াবহ। নাভিন-উল-হকের প্রথম ওভারেই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়ে রানের খাতা খোলার আগে ট্র্যাভিস হেড ফিরলে প্রতি আক্রমণের চেষ্টা করেন উইকেটে আসা মিচেল মার্শ। তবে নাভিনকে আক্রমণ করতে থাকা মার্শ থামেন সেই পেসারের ভেতরে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউর শিকার হয়ে ১১ বলে ২৪ রান শেষে। এরপরে ডেভিড ওয়ার্নারেরও জেন মতিভ্রম হয়। ওমরযাইয়ের বলে হাঁটু গেড়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ২৯ বলে ১৮ রান শেষে স্টাম্প খুইয়ে ফিরলে তার পরের বলেই ফেরেন ইংলিস। এরপরের বল থেকেই শুরু হয় রূপকথার। হ্যাটট্রিক বলে অল্পের জন্য বেঁচে যান ম্যাক্সওয়েল।
তার ডাকেই সাড়া দিতে দেরি করে লাবুশেন ২৮ বলে ১৪ রানে রান আউট হয়ে ফিরলে উইকেটে এসে রশিদকে একেবারেই পড়তে না পারা স্টয়নিস থামেন তারই বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে এলবিডব্লিউ হয়ে। রশিদের শিকার হয়েই এরপর অস্ট্রেলিয়াকে মহাবিপদে ফেলে ফেরেন স্টার্ক; রশিদ অবশ্য এই উইকেটটার জন্য ধন্যবাদ দিবেন সামনে ঝাপিয়ে দুর্দান্ত ক্যাচ নেওয়া আলীখিলকে। ৯১ রানে ৭ উইকেট হারিয়ে বসা অস্ট্রেলিয়াকে তখন চোখ রাঙাচ্ছে বিশাল পরাজয়। অস্ট্রেলিয়ার কফিনে তখন পেরেক ঠুকে দেওয়ার সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি আফগানরা। রূপকথার নায়কদের তো ভাগ্য দেবতার করুণাটাও লাগে; এদিন ভাগ্য দেবতা ম্যাক্সওয়েলকে দিলেন দুহাত ভরে। রশিদের বলে স্লগ সুইপ করতে গিয়ে বল এক্সট্রা কাভারের দিকে ভাসালেও রশিদ-শহীদির ভুল বুঝাবুঝিতে সেই যাত্রায় বেঁচে যান তিনি। পরের ওভারে নূরের বল শর্ট ফাইন লেগের ওপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে মুজিবকে ক্যাচ অনুশীলনের সুযোগ করে দিয়েও বেঁচে যান ম্যাক্সি। ম্যাচটাও মুজিব ফেলে দিলেন ওখানেই।
মাঝে রিভিউ নিয়ে বেঁচে যাওয়া ম্যাক্সওয়েল এরপর ফিফটি পান ৫১ বলে। অন্য প্রান্ত প্যাট কামিন্স সযত্নে সামলে রাখলে বল বুঝে, হিসেব কষে বাউন্ডারি বের করার পাশাপাশি সঠিক সময়ে প্রান্ত বদল করতে থাকলেন ম্যাক্সওয়েল। তবে সত্তর পার করা কোমরের ব্যথাটা পেয়ে বসে তাকে। সেই ব্যথা নিয়েই ৭৬ বলে সেঞ্চুরি করে ফেলেন ম্যাক্সওয়েল। দল তখনও একশোরও বেশি রান দূরে। রান নিতেই তখন বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। তখন শুরু করলেন জায়গায় দাঁড়িয়ে বল বুঝে বাউন্ডারি বের করা; ছাড়লেন না কাউকেই। তবে রশিদকে তার মাথার ওপর দিয়ে উড়িয়ে মেরে অন্য পায়ে ভর দিতে না পেরে ১৪৭ রানে থাকার সময় আবারও মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন, জাম্পা তখন তৈরি হয়ে বাউন্ডারি দড়িতে এসে প্রস্তুত। তবে চিকিৎসা নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও শুরু করলেন বাউন্ডারি হাঁকানো। ওই এক পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে ডিপ থার্ড ম্যানের ওপর দিয়ে রিভার্স করে যেই ছয়টা মারলেন তাতেই যেন গুঁড়িয়ে দিলেন আফগানদের মনোবলের বিন্দুমাত্র যা অবশিষ্ট ছিল তার সবটুকুই। ব্যথা মাথাচাড়া দিয়ে উথলে ৪৬-তম ওভারে যখন স্পিন পেলেন দলের তখনও প্রয়োজন ২১ রান; ম্যাক্সি সিদ্ধান্ত নিলেন এই ওভারেই করবেন এসপারওসপার। যেই মুজিবের ক্যাচ মিসে পেয়েছিলেন জীবন সেই মুজিবের কষ্ট বহুগুণে বাড়িয়ে মারলেন ৬,৬,৪,৬! ম্যাচ শেষ ওখানেই! ১২৮ বলে পেলেন ডাবল সেঞ্চুরি, গড়লেন কোনও অস্ট্রেলিয়ানের হয়ে সর্বোচ্চ রানের ওয়ানডে ইনিংসের রেকর্ড; আর ক্রিকেট বিশ্ব দেখল অবিশ্বাস্য এক ইনিংস।
ওপেনিং সঙ্গী রহমানউল্লাহ গুরবাজকে নিয়ে শুরু থেকেই ছন্দে ছিলেন এদিন ইব্রাহিম। আরও একবার ভালো শুরু করে গুরবাজ ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়্যা লেগে ক্যাচ তুলে ২৫ বলে ২১ রানে ফিরলেও থামেননি ইব্রাহিম। আত্মবিশ্বাস যেন ঠিকরে পড়ছিল তার ব্যাট থেকে, যার ফলশ্রুতিতে ফিফটি পেয়ে যান ৬২ বলে। উইকেটে আসা রহমত শাহ যোগ্য সঙ্গ দিলে দল শতরান পেয়ে যায় ২০.২ ওভারে। তবে গুরবাজের মত রহমতও উইকেটটা উপহার দিয়েই আসেন এক অর্থে; ম্যাক্সওয়েলকে তুলে মারতে গিয়ে মিড অনে ক্যাচ দিয়ে ৩০ রানে থামেন তিনি। অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহীদি এদিন আরও একবার নিজেকে মেলে ধরার ইঙ্গিত দিলে মাঝে চেপে ধরে অজি বোলাররা। ৩৮-তম ওভারে দলের রান যখন ১৭০+ তখন মিচেল স্টার্ককে বেরিয়ে এসে খেলতে গেলে দারুণ ইয়র্কারে স্টাম্প খুইয়ে ২৬ রানে থামেন শহীদি।
উইকেটে এসে আজমতউল্লাহ ওমরযাই কাভারের উপর দিয়ে স্টার্ককে যেই ছয় মারলেন তাতে ভয়ংকর হয়ে ওঠার আভাস দিলেও জাম্পার শিকার হয়ে ১৮ বলে ২২ রানে থামেন তিনি। তার আক্রমণে অবশ্য সেঞ্চুরির হাতছোঁয়া দূরত্বে চলে এসে আর পা ফস্কাননি ইব্রাহিম। হেজলউডের বল কাভারে সরাসরি ঠেলে দিয়ে সিঙ্গেল বের করতে গিয়ে রান আউট হতে পারতেন; তবে ওভারথ্রোতে আরও এক রান নিয়ে গড়ে ফেলেন ইতিহাস। ১৩১ বলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি দিয়ে হয়ে যান বিশ্বকাপে প্রথম আফগান সেঞ্চুরিয়ান। পরে ১০ বলে ১২ রান করে হেজলউডের কাছে স্টাম্প খুইয়ে নবী থামলেও হেলমেট ছাড়াই খেলতে নেমে রশিদ দেখান কব্জির জোর। স্টার্কের করা শেষ ওভারে তো এক চার, দুই ছয়ে একাই নিলেন ১৬ রান! শেষ ৫ ওভারে ৬৪ রান তুলে রশিদ ১৮ বলে ৩৫* রান ও ইব্রাহিম ১৪৩ বলে ১২৯* রানে মাঠ ছাড়লে আফগানরা পেয়ে যায় লড়াইয়ের রসদ।