টিকেটের দাম কমিয়েও কেন দর্শক হারাচ্ছে বার্সেলোনা?
অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে বার্সেলোনার সর্বশেষ হোম ম্যাচে কতজন দর্শক ছিল, জানেন কি? মাত্র ৩৪ হাজার ৫৬৮ জন দেখেছেন সেই ম্যাচ। যা এই মৌসুমে বার্সার সর্বনিম্ন হোম ক্রাউড। অথচ ন্যু ক্যাম্পে বার্সেলোনার ম্যাচ মানেই ছিল ফুল হাউজ শো। প্রায় লাখ খানেক দর্শক-সমর্থক হৈ-হুল্লোড়ে মাতিয়ে রাখতেন মাঠ।বার্সার হোম ম্যাচে এই দর্শক খরার কারণ কী?
২০২৩ সালের ১লা জুন শুরু হয়েছে ন্যু ক্যাম্পের সংস্কার কাজ। তাই এই মৌসুম থেকে বার্সেলোনা হোম গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করছে এস্তাদি অলিম্পিক লুইস কোম্পানিসকে। বার্সেলোনা শহরের মনজুইচ পাহাড়ের কোলে অবস্থিত এস্তাদি অলিম্পিক। যেটা ন্যু ক্যাম্প থেকে ঘণ্টাখানেকের দুরত্বে অবস্থিত।
দর্শক কমে যাওয়ার কারণ কি কেবলই দুরত্ব? মৌসুম শুরুর আগেই ৩০-৪০% বেড়েছিল সিজন টিকেটের মূল্য। ভৌগোলিক অবস্থানের জন্য মোটর বাইক কিংবা কারে করেও মাঠে যেতে পারেন না ভক্ত-সমর্থকরা। নেই স্টেডিয়াম সংলগ্ন পার্কিং ব্যবস্থাও। ১৯২৯ সালে নির্মিত এস্তাদি অলিম্পিকের অবকাঠামোগত কিছু বিষয়াদিও আছে বার্সার দর্শক বিমুখতায়।
টিকেটের মূল্য বৃদ্ধি
এই বছরের এপ্রিলে আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় পুরো মৌসুমের টিকেটের দাম বার্সা বাড়িয়েছিল ত্রিশ থেকে ৪০ শতাংশ। এর চরম প্রভাব পড়েছে বার্সার গ্যালারিতে। এক মাস পর দাম কমালেও ক্লাবের অনেক সিজন টিকেট হোল্ডারই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন এর আগে। ন্যু ক্যাম্পে বার্সেলোনার আছে ৮০ হাজার ২৭৪ জন সমর্থক, যারা পুরো মৌসুমের জন্য টিকেট কিনে নেন। তাদের মধ্যে থেকে এস্তাদি অলিম্পিকে ম্যাচ দেখতে গিয়েছেন মাত্র ১৭ হাজার ৫৫২ জন। যদিও নতুন হোম গ্রাউন্ডে বার্সা সিজন টিকেট হোল্ডারদের জন্য বরাদ্দ রেখেছিল ২৭ হাজার ৩৮৫টি আসন। এছাড়া আবহাওয়ার কথা ভেবেও সিজন টিকেট নবায়ন করেননি অনেকে। মনজুইচ পাহাড়ি এলাকা হওয়াতে ডিসেম্বর থেকে মার্চে জাঁকিয়ে শীত পড়ে সেখানে।
পার্কিং সংকট
স্টেডিয়াম পাহাড়ের ওপর আর পর্যটন এলাকা হওয়াতে ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে সেখানে যাওয়ার সুযোগ নেই। কেউ খেলা দেখতে চাইলে গাড়ি পার্ক করে রাখতে হয় পাহাড়ের নিচের অংশে, ফিরা গ্রান ভিয়া নামক জায়গায়। একই কারণে প্রতি হোম ম্যাচে বার্সার কোচিং স্টাফ, ফুটবলারদের সবাই আসেন টিম বাসে করে। ন্যু ক্যাম্পে খেলা থাকলে তারা যেতেন ব্যক্তিগত গাড়ি করেই।
ম্যাচ ডেতে ক্লাবের পক্ষ থেকে শাটল বাস সার্ভিস দেয়া হয় দর্শকদের জন্য দুটি জায়গা থেকে। কেউ শাটলে চড়তে না চাইলে পায়ে হেঁটে মাঠে যেতে পারবেন ২০ মিনিটে। আছে এস্কেলেটর লিফটের সুবিধাও। পাহাড়ের নিচ থেকে গ্যালারি পর্যন্ত পৌঁছানোটা হ্যাপা মনে হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সেটা ভুলিয়েও দিতে পারে। বার্সেলোনার সেরা ভিউ পয়েন্টটা মনজুইচেই। পাখির চোখে ৫৭৩ ফুট উঁচু থেকে দেখে নেয়া যায় শহরটাকে। ঢাল বেয়ে নামার সময়টায় পাওয়া যায় আরো দারুণ ভিউ।
অবকাঠামোগত সমস্যা
অবকাঠামো বেশ পুরনো হওয়াতে সংস্কার করা হয়েছে এস্তাদ্দি অলিম্পিকেও। তবে বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে গ্যালারিতে।৫৪ হাজারের বেশি দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই স্টেডিয়ামের দশ শতাংশ আসন থেকেই ম্যাচ দেখা যায় না ভালোমতো।অ্যাথলেটিক ট্র্যাক লাগোয়া গ্যালারি থেকে মাঠের ভিজিবিলিটি সবচেয়ে কম। মোট ধারণক্ষমতা ৫৪,৩৬৭ জন হলেও গ্যালারি থেকে ম্যাচের শতভাগ ভিজিবিলিটি পান ৪৯,৪৭২ জন। বাকি দশ ভাগ অর্থাৎ ৪,৮৯৫টি আসন থেকে মাঠের ভিজিবিলিটি নেই বললেই চলে। যে কারণে গ্যালারির নিচের দিকের এই অংশের প্রায় হাজার পাঁচেক টিকেট অবিক্রিতই থাকছে। গ্যালারির এই অংশটুকু ক্লাব কতৃপক্ষ ঢেকে দিয়েছে ক্লাবের ব্র্যান্ডিং করা তেরপল দিয়ে।
কম আসন বরাদ্দ পাচ্ছে বার্সেলোনার সমর্থক গোষ্ঠীগুলোও। এ নিয়ে ক্লাব বরাবর অভিযোগ জানিয়েছে বার্সেলোনার সমর্থক গ্রুপ গ্রাদা অ্যানিমাচিও। তাদের দাবি সিজন টিকেট হোল্ডার ও ম্যাচ দেখতে আসা পর্যটকদের প্রাধান্য দিতে গিয়েই তাদের জন্য আসন কমিয়ে এনেছে ক্লাব। ন্যু ক্যাম্পে তাদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল ১২০০ আসন, এস্তাদি অলিম্পিকে তারা বরাদ্দ পেয়েছে মোট ৫৭০টি আসন।
সব মিলিয়ে নতুন হোম গ্রাউন্ডের পুরো ধারণক্ষমতা এখনো পুরোপুরি কাজে লাগেনি। ৫০ হাজার দর্শক এসেছিল কেবল এই মৌসুমের এল ক্লাসিকোতে। রিয়াল বেটিস, শাখতার, পোর্তোর বিপক্ষে ম্যাচগুলো দেখেছে চল্লিশ হাজারের বেশি দর্শক। কাদিজ, আলাভেসের ম্যাচগুলোতে ছিল ৩৪ থেকে ৩৯ হাজারের মতো দর্শক।
ন্যু ক্যাম্পে কবে ফিরবে ফুটবল?
ন্যু ক্যাম্পের সংস্কার কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাব্য সময় ২০২৪ সালের নভেম্বরে। ১২৫ বছর পূর্তির প্রাক্কালে ন্যু ক্যাম্পে ফুটবল ফেরানোর কথা বার্সেলোনার। যদিও তখন পুরো স্টেডিয়ামের ৬৬ শতাংশ গ্যালারিতে বসে খেলা দেখতে পারবেন দর্শকরা।শতভাগ সক্ষমতা পেতে অর্থাৎ এক লাখের বেশি দর্শক একসাথে খেলা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।
এস্তাদি অলিম্পিক লুইস কোম্পানিসে ফুটবলারদের যাবতীয় সুবিধাদি নিশ্চিত করাটা ছিল বার্সার আসল চ্যালেঞ্জ।সেটা আপাতত উৎরে গেছে ক্লাবটি। ফুটবলাররাও মানিয়ে নিয়েছেন বেশ। তবে দর্শকদের সবাই মানিয়ে নিতে পারেননি এখনো। ন্যু ক্যাম্পের গ্যালারী আবার হৈ-হুল্লোড়ে মাতাতে তাদের অপেক্ষা এবার আগামী বছরের নভেম্বর পর্যন্ত।