• Other
  • " />

     

    ১১১ বছরে প্রথমবার: পেলে-নেইমারের সান্তোস কেন রেলিগেশনে?

    ১১১ বছরে প্রথমবার: পেলে-নেইমারের সান্তোস কেন রেলিগেশনে?    

    ম্যাচের শেষ বাশি বাজার সাথেসাথে মাঠে উড়ে আসল বাজি, গ্যালারিতে পুড়ছিল ফ্লেয়ার, ফুটবলাররা মাঠে নুইয়ে পড়ে কাঁদছেন, সমর্থকেরা অশ্রু লুকাচ্ছেন হাত দিয়ে। সান্তোস এফসির ঘরের মাঠে ভিল্লা বেলমিরোতে এমন দৃশ্যর অবতারণার নেপথ্যে সুখকর কোনো ঘটনা নেই। আছে ক্ষোভ, হতাশা আর ব্রাজিলের শীর্ষ পর্যায়ে ফুটবল থেকে অবনমনের দুঃখ। 

    পেলে, নেইমার, রবিনহোদের সেই বিখ্যাত সান্তোস নিজেদের ১১১ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নেমে গেছে ব্রাজিলের দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবল সিরি বি তে।  ১৭-তম অবস্থানে থেকে লিগ শেষ করা সান্তোস নিজেদের শেষ ম্যাচে ২-১ ব্যবধানে হেরেছে ফোর্তালেজার বিপক্ষে। সেই হারে এড়াতে পারেনি রেলিগেশন। টানা পাঁচ ম্যাচ ছিল জয়হীন। 

    এই অবনমন মেনেই নিতে পারছেন না সান্তোস সমর্থকেরা। প্রিয় ক্লাবের বিপক্ষে মাঠেই তারা স্লোগান তুলেছিলেন, নির্লজ্জ দল বলে। সমর্থকদের সেই ক্ষোভের আগুন ছড়িয়েছে ভিল্লা বেলমিরোর আশেপাশের এলাকাতেও। জায়গায় জায়গায় ফুটেছে বাজি, পুড়েছে পার্ক করে রাখা অনেক গাড়িও। এমন রাত আসুক সান্তোসের কোনো সমর্থকই চাননি। ব্রাজিলের ফুটবলে এমন দৃশ্য অস্বাভাবিক নয়। তবে সান্তোসের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ইতিহাস সম্পর্কিত বলেই সমর্থকদের এভাবে ক্ষোভপ্রকাশ।

    সান্তোসের ইতিহাস

     

    খুব বড় ক্লাব না হলেও সান্তোসের আছে ফুটবলের  বর্ণাঢ্য ইতিহাস। যার নায়ক ছিলেন প্রয়াত কিংবদন্তি পেলে।পেলের প্রয়াণ দিবসের কিছুদিন আগেই নিজেদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন বিন্দুতে নামল সান্তোস। ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর মারা যান পেলে। 

    ব্রাজিলের হয়ে তিনটা বিশ্বকাপ জিতেছেন পেলে। সেই তিন আসরেই পেলে ছিলেন সান্তোসের ফুটবলার। তার খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ারে ১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে ব্রাজিলে এক চেটিয়া রাজত্ব ছিল সান্তোসের। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫- এই পাঁচ বছরে টানা জিতেছে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপ যেটা বর্তমানে ব্রাজিলের সিরি’ আ নামে পরিচিত। সেই স্বপ্নমুয় সময়েই  দুটি করে কোপা লিবার্তেদোরস,ইন্টারকন্টিনেন্টাল শিরোপা ও চারবার স্টেট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল সান্তোস।

     

    সান্তোসের এই ড্রিম রানের ট্র্যাকে দৌড়াতে পারেনি ব্রাজিলের আর কোনো ক্লাবই। বিশ্বজোড়া খ্যাতিও এনে দিয়েছিলেন পেলেই। প্রায় দুই দশকে সান্তোসের জার্সিতে বিশ্বের নানান জায়গায় খেলে বেড়িয়েছেন তিনি।ব্যাংকক থেকে বোস্টন, হাইতি থেকে ইংল্যান্ডের প্লাইমাউথ; সবখানেই ছিল সান্তোস আর পেলের জয়জয়কার। এক কথায় বললে ব্রাজিলিয়ান ফুটবলের চলতি-ফিরতি বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছিল সান্তোস।

    ১৯৬২ সালে ব্রাজিলের দ্বিতীয় বিশ্বকাপজয়ী স্কোয়াডেও ছিল সান্তোসের ফুটবলারদের ছড়াছড়ি। ২২ জনের স্কোয়াডের সাতজনই খেলতেন সান্তোসে। পেলে তো ছিলেনই। তার সাথে ছিলেন পেপে, জিতো, কুতিনিও, কার্লোস আলবার্তো, মাউরো রামোসের মতো ফুটবলাররা।

    সব ধরণের প্রতিযোগিতা মিলিয়ে সান্তোস জিতেছে ১৭টা ট্রফি। যদিও সান্তোসের সেই ড্রিম রান, কিংবা সকল অর্জন এখন সোনালী অতীত। সর্বশেষ লিগ জিতেছে ২০০৪ সালে। ল্যাটিন আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন্স লিগ খ্যাত কোপা লিবার্তেদোরসের শিরোপা জেতারও পেরিয়ে গেছে এক যুগের বেশি।

    সান্তোসের এই অবনতির কারণ কী? 

    প্রশাসন, আর্থিক কাঠামো থেকে শুরু করে, ম্যানেজার কিংবা ফুটবলার; সবকিছুতেই যেন তালগোল পাকিয়ে রেখেছে সান্তোস। ২০২১ সালে ক্লাব প্রেসিডেন্ট হিসেবে আন্দ্রেস রুয়েদা দায়িত্ব নেয়ার পর সান্তোস লিগ শেষ করেছিল মিড টেবিলে থেকে। আর এবার তো বাদই পড়ে গেছে ব্রাজিলিয়ান সিরি আ থেকে। কোচ নিয়োগেও বেঁধেছে বিপত্তি। গত মৌসুম থেকে এবারের শেষ ম্যাচ পর্যন্ত সান্তোস খেলেছে আলাদা আলাদা পাঁচজন কোচের অধীনে। এবং তাদের ফুটবল কিংবা -ট্যাকটিক্যাল দর্শন একে অন্যের চেয়ে আলাদা।

    টানা এই ভিন্ন দর্শনের ফুটবল খেলতে গিয়ে খাবি খেয়েছেন ফুটবলাররও। যার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবটা পড়েছে মাঠের খেলায়। এই মৌসুমের শুরতে ২১ জন নতুন ফুটবলার দলে এনেছিল সান্তোস। তাদের মধ্যে কেবল তিনজন খেলেছেন ফোর্তালেজার বিপক্ষে মৌসুমের শেষ ম্যাচে। মৌসুমের শুরুতে সান্তোসের প্রথম ম্যাচে খেলেছিলেন সেই ২১ জনের পাঁচ জন। শেষ হতে হতে সেই পাঁচ জনের কেউই নেই আর সান্তোসের স্কোয়াডে। মৌসুম ঘুরতে না ঘুরতেই তাদের কেউ চলে গেছে লোনে, কাউকে বিক্রিও করে দিয়েছে সান্তোস। ঐতিহ্যবাহী সান্তোসের নিম্নমুখী পারফর্ম্যান্সের জন্য দায় আছে প্লেয়ার স্কাউটিং ও স্কোয়াড ডেপথের।

    ক্লাবের ইয়ুথ সিস্টেম থেকেও উঠে আসছে না তেমন কোনো প্রতিভাবান ফুটবলার।অথচ এই ক্লাবের ইয়ুথ সিস্টেম থেকে উঠে এসেই বিশ্বজোড়া খ্যাতি পেয়েছেন নেইমার। বার্সেলোনা, পিএসজি ঘুরে এখন থিতু হয়েছেন সৌদি ক্লাব আল হিলালে। রদ্রিগো গোয়েস খেলছেন ইউরোপের শীর্ষ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে। 

    সহসাই বাড়ছে না ক্লাব একাউন্টের ব্যালেন্স। দ্য অ্যাথলেটিক জানাচ্ছে, সান্তোসের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আছে সর্বমোট ৭০০ মিলিয়ন ব্রাজিলিয়ান রিয়াল। মার্কিন ডলারে সেটা ১৪২ মিলিয়ন।

    সিরি বি তে কী অপেক্ষা করছে সান্তোসের জন্য?

    দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যাওয়াতে ফেডারেশন থেকে এতদিন পাওয়া অর্থের পরিমানও কমবে। সাথে কমে যাবে দর্শক সমর্থন, যেখানে নেই শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলের চাকচিক্য। সান্তোসের এই অবনমনের পর  নেইমার ইন্সটাগ্রাম পোস্টে লিখেছেন সান্তোস সবসময়ই সান্তোস থাকবে। আমরা আবারও হাসব। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ভঙ্গুর কাঠামো নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে উঠে আসতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হবে সান্তোসকে। পেলে-নেইমারদের সান্তোস কি পারবে আগামী মৌসুমে সিরি আ’তে ফিরে আসতে?